Site icon খিচুড়ি

লাল শাড়ি

নিঝুম রাত, বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে, হঠাৎ আশেপাশে কোথাও বজ্রপাতের শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল, ঘরে একটা অল্প পাওয়ারের ডিম লাইট জ্বলছে বিধায় ঘড়িটা দেখতে কোন সমস্যা হলোনা, দেয়াল ঘড়িতে তখন রাত ২ টা বেজে ২০ মিনিট , কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে পুনরায় ঘুমাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু নাহ ঘুম আর ধরলোনা…।

তাই উঠে বসে বাঁ দিকের জানলার একটা পাল্লা খুলে দিলাম সাথে সাথে বৃষ্টির ছাঁট এসে শরীরে আছড়ে পরল, বেশ ভালই লাগল বৃষ্টির ঠাণ্ডা পরশ… চারিদিক আলোকিত করে আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠল, সেই আলই দেখতে পেলাম বাড়ির পশ্চিম কোনের আম গাছটার নিচে কেও একটা দারিয়ে রয়েছে, আমার কেমন জানি একটু ভয় ভয় লেগে উঠল এই রাত বিরেতে ঝর বাদলের সময় বাইরে আবার কে দাড়িয়ে রয়েছে।

পরক্ষনেই মনে হল চোখের ভুল, ব্যাপারটা পরিষ্কার করার জন্য বালিশের তলা থেকে লাইটটা বের করে সোজা আম গাছটার নিচে আলোটা ফেললাম, সত্যিই একটা মানুষ দাড়িয়ে রয়েছে এবং সেটা ২১-২২ বছরের একটা যুবতি মেয়ে, পরনে একটা লাল শাড়ি সেটা ভিজে গায়ের সাথে সেপ্টে গেছে, মাথার চুল গুলা কিছুটা এলোমেলো হয়ে রয়েছে, আস্তে আস্তে মেয়েটা ঘার ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, ওমনি আমার জানটা তড়াক করে উঠল… আরে এ যে সুমি??!!

কিন্তু ও এখানে কেন? ব্যাপারটা তেমন একটা ভাল ঠেকল না আমার কাছে, মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে রয়েছে, চোখের চাহনিতে কিছু একটা বলতে চাই, পরনে সেই লাল শাড়িটা…

কলজেই প্রথম পরিচয় দুজনের, এক নবীন বরন অনুষ্ঠানে ওকে লাল শাড়িতে প্রথম দেখেই ভাল লেগে যাই, ধীরে ধীরে সেটা এক সময় ভালবাসায় রূপ নেয়…।

আমি তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র, পড়ালেখায় অত একটা ভাল ছিলাম না, তবুও কোনদিন ফেইলের মুখ দেখিনি, বাবা গ্রামের একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন, বাবাকে সবাই চৌধুরী নামেই চিনত, মোটামুটি উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়াই পড়ালেখা নিয়ে অত একটা মাথা ঘামাতাম-না, আমরা দুভাই ছিলাম আমার বড় রফিক ভাই তখন ঢাকার একজন নাম করা ডাক্তার, আমি ছোট হওয়াই আদরটা একটু বেশিই ছিল তাই বাবা আমাকে পড়ালেখার ব্যাপারে তেমন কিছু বলতেন না।

এভাবেই একে একে কেটে যাচ্ছিল সুখের দিন গুলি, তারপর এক সোনালি সকালে নবীন বরন অনুষ্ঠানে পরিচয় হয়ে গেল সুমির সাথে ও তখন ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের ছাত্রী, একই কলেজে পরতাম দুজনেই, আমি তেমন একটা কলেজে যেতাম না, কিন্তু সুমির সাথে পরিচয়ের চার মাস পর যখন সম্পর্কটা প্রেমে রূপ নিলো, তখন থেকে প্রায় দিনই কলেজে যেতাম পড়ালেখার জন্যে না সুধু ওকে দেখার জন্য যেতাম, ওদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূর ছিল, আর ওর বাবা ভীষণ রাগি একজন লোক তাই কোনদিন ওদের বাড়ির ত্রি সীমানাও মারাইনি…যদিও সুমি আমাদের বাড়িতে দুবার এসেছিল,

কিছুদিন জেতে না জেতেই কিভাবে জানি আমার আব্বা আমদের সম্পর্কের কথাটা জেনে ফেলেন, আব্বা আমাকে অনেক বুঝালেন আর এ কথাও বললেন আর কোন দিন যদি তুই সুমির সাথে কথা বলেছিস তাহলে তকে কেটে ফেলব, কিন্তু সে সব কথা আমার গায়েই লাগল না, কেননা আমি তখন প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি …।

আস্তে আস্তে কলেজ টপকে ভার্সিটির বারান্দাই পা রাখলাম, তখনও সুমির সাথে আমার প্রতিদিনই কথা হত, একে একে পেরিয়ে গেল চার চারটি বছর, সুমি তখন পূর্ণ যুবতি একটা মেয়ে, দিনে দিনে ও কেমন জানি একটা হুরে পরিণত হয়ে গেছিল, ওর বারিতে তখন পুরা দমে পাত্র দেখা দেখি চলছিল…ও আমাকে সে ব্যাপারে অবগত করল, আমি ওকে সান্ত্বনা দিলাম.. বললাম ধৈর্য ধর, একটা উপাই হবে।

হঠাৎ ও একদিন আমাকে পিড়াপিড়ি সুরু করল পালিয়ে বিয়ে করার জন্য, আমি মোটেও রাজি হচ্ছিলাম না দেখে ও বিস খাবে বলে ভয় দেখাতে লাগল , আমার ভেতরে একটা ভয় ডুকে গেল…সত্যিই যদি ও বিস খেয়ে ফেলে তাহলেইতো সর্বনাশ, কি আর করা অনেকটা নিরুপায় হয়ে ওর সিদ্ধান্তে রাজি হলাম,

সুযোগ বুঝে একদিন বৃষ্টি ঝরা অন্ধকার রাতে দুজনেই পা বাড়ালাম অজানার উদ্দেশ্যে,

জানিনা আমাদের গন্তব্য কথাই? একবার মনে হল বাড়িতে ফিরে যাই, পরক্ষনেই সুমির মুখের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে গেলাম, যে মেয়ে নিজের মা বাবাকে ছেরে আমাকে বিশ্বাস করে ঘর ছেরে এভাবে চলে এসেছে আমি তাকে ধোঁকা দিতে পারিনা।

দুজনেই হাটার গতি বারিয়ে দিলাম, যে করেই হোক আগে বন ছেরে রাস্তাই উঠতে হবে, কিন্তু কে জানত ঐ রাস্তাই যে আমদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে, দশ মিনিট হাটার পর মেইন রাস্তাই উঠলাম আর অমনি জোরাল টর্চের আলো এসে আমাদের চেহারাই আছরে পরল…সেই সাথে শুনতে পেলাম সুমির বড় ভাই রাশেদের বাজখাই গলা” এই হারামির বাচ্চা আমার বোন কে নিয়ে কোথাই পালাচ্ছিস? এতটুকু বলেই আমার গাল বরাবর ঝেরে দিল আধা হালি চর, হাত তো না যেন গজারি কাঠ, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, ধপাস করে মাটিতে বসে পরলাম, রাশেদ ভাই সুমিকে টানতে টানতে বারির দিকে নিয়ে চলে গেল, তারপর প্রায় একমাস বাবা আমাকে গৃহবন্দি করে রাখেন, যেদিন বাবা আমাকে বারিতে আবদ্ধ করলেন তার সপ্তা খানেক পরই আমার কানে খবর আসে সুমি আত্মহত্যা করেছে, খবরটা প্রথমে বিশ্বাস না হলেও দুদিন পরে আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু সেটা নিশ্চিত করে , অকে নাকি অর মা বাবা বিয়ের জন্য পিড়াপিড়ি করেছিল পরে রাজি না হওয়াই , আকে অনেক মেরেছে এর জের ধরেই ও আত্মহত্যা করে।

অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালাম, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম আত্মহত্যা করব, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, মা বাবার অতিরিক্ত গার্ডে তা আর সম্ভব হলোনা।

আস্তে আস্তে কালের চাকা ঘুরে একটি বছর পেরিয়ে গেল। এই এক বছরে রচিত হল অনেক নতুন ইতিহাস, মুছে গেল অনেক পুরাণ সৃতি, আমার সৃতির পাতা থেকেও তখন ঝরতে সুরু করেছে সুমি। আর এক বছর জেতে না জেতেই ও আমার থেকে পুরাপুরিই ঝরে গেল , এক সময় পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে চাকুরীজিবি হয়ে গেলাম, এখন যে সময় কি ভাবে চলে যাই টেরই পাইনা।

আবার আশেপাশে কথাও বজ্রপাতের শব্দে চিন্তার রাজ্য থেকে ফিরে এলাম, সাথে সাথে চোখ চলে গেল আম গাছটার নিচে, কিন্তু সুমি নেই! চারিদিকে টর্চ বুলিয়েও কোথাও দেখতে পেলাম না ওকে, আস্তে করে জানলাটা বন্ধ করে শুয়ে পরলাম, আমার পুরাণ ক্ষতটাই আবার আঘাত করে গেল ও, আর হারান সৃতিটাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেল অর পরনের লাল শাড়ীটা…।।।

ফিচার ইমেজঃ Girl In Red Sari Painting by Ramesh

Exit mobile version