১৯২৬ সাল! ১৪ বছর বয়সী অ্যালান টিউরিংয়ের যেদিন স্বরবর্ণ স্কুলে প্রথম ক্লাস সেদিন যুক্তরাজ্যে চলছে সাধারণ ধর্মঘট। কিন্তু টিউরিং ক্লাসে যাওয়ার ব্যাপারে নাছোড়বান্দা! শেষে একাকী নিজের বাইসাইকেল চড়ে ৯৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে পৌঁছালেন। স্বরবর্ণ স্কুলে সাধারণত জোর দেয়া হয় ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা ইত্যাদির উপর। কিন্তু টিউরিংয়ের অন্তহীন মগ্নতা ছিলো গণিত ও বিজ্ঞানে। অতঃপর স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাধ্য হয়ে তাঁর বাবার কাছে চিঠি লিখলেন এই বলে যে, টিউরিংয়ের ভবিষ্যতে অনেক বড় বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এর দশ বছর পর অর্থাৎ ১৯৩৬ সালে অ্যালান টিউরিং ‘টিউরিং’ নামে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এটা কোনো বস্তুগত যন্ত্র নয়; বরং কাগজে কলমে লিপিবদ্ধ বিশেষ কিছু কার্যনীতি। এই টিউরিং যন্ত্রই আধুনিক কম্পিউটার ও কম্পিউটিং এর অন্যতম ভিত্তিমূল। আধুনিক ইলেকট্রিক কম্পিউটারের বিকাশ টিউরিং যন্ত্র দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত। বাস্তব কম্পিউটার দ্বারা সম্ভবপর নয় এমন অনেক কিছুর বাস্তবায়নও টিউরিং যন্ত্রের সাহায্যে সম্ভব ছিলো। বিশ্বজুড়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা বাস্তব কম্পিউটিংয়ের সীমাবদ্ধতা ভালোভাবে বুঝতে শরণাপন্ন হন টিউরিং যন্ত্রের। অ্যালান টিউরিংকে বলা হয় কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক! ২২ বছর বয়সে টিউরিং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৬ বছর বয়সে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। ওই বছরই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসেন যুক্তরাজ্যে।
এর কিছুদিন পরেই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানদের গুপ্তসংকেতের পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে ব্রিটিশরা গলদঘর্ম! বিশেষ করে জার্মান নৌবাহিনীর গুপ্তসংকেতের অর্থ কিছুতেই উদ্ধার করা যাচ্ছিলো না। তখন এগিয়ে এলেন টিউরিং! ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি ‘বম্বি’ নামের একটি বিশেষ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তাঁর এই যন্ত্রের সাহায্যেই জার্মান গুপ্তসংকেতের পাঠোদ্ধারে যুক্তরাজ্য সক্ষম হয়।
বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ভাষায় কম্পিউটারের কার্যসম্পাদন এর জন্য লেখা বিভিন্ন প্রোগ্রামিং নির্দেশনা ইলেকট্রনিক স্মৃতিতে (র্যাম) সংরক্ষণের উপায়ও (ষ্টোরড প্রসিডিউর কম্পিউটিং) তাঁর আবিষ্কার! ১৯৫০ সালে টিউরিং ‘কম্পিউটিং মেশিনারি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেন। এ নিবন্ধে তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘যন্ত্র কি চিন্তা করতে পারে?’ এ নিবন্ধের শেষ অংশে ‘টিউরিং পরীক্ষা’ নামক বিশেষ এক পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি দেখান যে, ‘হ্যাঁ, যন্ত্র বিশেষ ব্যবস্থায় চিন্তা করতে পারে!’
১৯৫২ সালের দিকে টিউরিং গাণিতিক জীববিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিলো ভ্রুণ অবস্থা থেকে নিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের মাধ্যমে জীবের পূর্ণাঙ্গ অবয়ব প্রাপ্তির ক্রিয়া কৌশল ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গাণিতিক বিষয়াদি। এছড়া তিনি উদ্ভিদের পত্রবিন্যাসে ফিবোনাক্কি রাশিমালার দৃশ্যমানতা ও অস্তিত্ব নিয়ে কাজ করেন। তার এসব কাজ গাণিতিক জীববিজ্ঞানে সুদূরপ্রসারী ও প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে বিবেচিত হয়।
অ্যালান টিউরিংয়ের জীবনের সূচনা কিন্তু এই উপমহাদেশেই। টিউরিং যখন তাঁর মায়ের গর্ভে আসেন তখন বাবা-মা থাকতেন ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের ছত্রপুর শহরে। কিন্তু এই দম্পতি চাচ্ছিলেন তাঁদের সন্তান যেনো ইংল্যান্ডে ভূমিষ্ঠ হয়। তাই তাঁরা ফিরে যান লন্ডনে। ১৯১২ সালের ২৩শে জুন লন্ডনে তাঁদের ঘর আলো করে জন্ম নেন টিউরিং। ১৯৫৪ সালের ৭ই জুন টিউরিং মাত্র ৪২ বছর বয়সে সায়ানাইডমিশ্রিত আপেল খেয়ে মারা যান। কেউ কেউ একে আত্মহত্যা বললেও তাঁর মায়ের ভাষ্যমতে, কাজের ঘোরে আপেলে ভুলবশত সায়ানাইড লেগে গিয়েছিলো।
নিউইয়র্কভিত্তিক বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন কম্পিউটার সমিতি এসোসিয়েশন ফর কম্পিউটিং মেশিনারি (এসিএম) ১৯৬৬ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞানের জনক অ্যালান টিউরিংয়ের নামে প্রবর্তন করে কম্পিউটার বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরষ্কার ‘টিউরিং পুরষ্কার’। ১৯৯৯ সালে বিশ্বখ্যাত টাইমস ম্যাগাজিনের করা বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা গূরুত্বপূর্ণ ১০০ জন ব্যক্তির একজন ছিলেন টিউরিং! ২০০২ সালে বিবিসি পরিচালিত এক সমীক্ষায় ১০০ মহান ইংরেজের তালিকায় টিউরিংয়ের অবস্থান ছিলো ২১ তম! আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের চোখে তাদের সাবেক ছাত্রদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় দু’জন ছাত্রের একজন ছিলেন টিউরিং।
মাত্র ৪২ বছর বয়সে টিউরিং মারা যান। তাঁর স্বল্পায়ু জীবনেই তিনি কম্পিউটার বিজ্ঞানকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করে গেছেন। তাঁর প্রাজ্ঞ পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও আবিষ্কার সভ্যতা ও মানুষের চলার পথকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে এবং আজও করে চলেছে!