প্রজাতি বা রকম বলে একটা কথা আছে। মানে হচ্ছে ,আম গাছে আমই ধরে। লিচু ধরবে না। আবার মুরগির ডিম ফুটে মুরগির বাচ্চাই হবে। হাঁস বের হবে না। এই জিনিসটাকেই স্পিসিজ ( species ) বলে বিজ্ঞানীরা। মানে প্রজাতি।
মাঠে গেলে দেখবে ঘাসের দঙ্গল। সব ঘাস কিন্তু এক রকম না। কিছু পাতলা।দূর্বা বলে। ব্লেডের মত মোটা আর ধারাল ঘাস আছে। খেলতে গিয়ে পরে গেলে ব্যাথা পাবে। সব গোলাপ ফুল এক রকম না। কোটের বোতামের মত সাইজের আছে। আবার ক্রিকেটের বলের সাইজের আছে। মানুষের প্রজাতি কিন্তু একটাই। কালো, সাদা, লম্বা , বাঁটুল যাই হোক এক প্রজাতি। কিন্তু হাতির প্রজাতি দুটো। মানে সারা দুনিয়ায় দুই ধরনের হাতি আছ। ইনডিয়ান হাতি আর আফ্রিকান হাতি। হায়েনার আছে তিন প্রজাতি । শেয়ালের আছে নয় প্রজাতি । মাছির আছে ৫০০ প্রজাতি। আর ৬ লক্ষ ৬০ হাজারের বেশি পোকামাকড় আছে সারা দুনিয়ায়। সংখ্যাটা ফাইনাল না। বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন পোকা মাকড় আবিষ্কার করেই যাচ্ছেন ।
প্রতি সপ্তাহেই বিজ্ঞানীরা নতুন সব জীবজন্তু বা গাছপালা আবিষ্কার করছেন। এই যে এত হাজারে বিজারে জীবজন্তু , গাছপালা এরা এলো কি করে ? জীবন শুরু হল কেমন করে ? সব জীবজন্তু দুনিয়াতে এক সাথেই এসেছিল ? এক জায়গায় ? একই ভাবে ? নাকি প্রত্যেকের জন্য ভিন্ন পরিবেশ ছিল ?
জীবজন্তু বা গাছপালার মধ্যে ভাগ আছে। যেমন শেয়াল এবং নেকড়ে আলাদা প্রাণী হলেও ওরা কুকুর পরিবারের প্রাণী। মানে কুকুরের দূর সম্পকের আত্মীয় । সিংহ, বাঘ, চিতা, জাগুয়ার সবাই আলাদা প্রাণী হলেও ওরা বিড়াল পরিবারের প্রাণী। আবার ভাল্লুক, সীল মাছ, এবং বেজি আলাদা প্রাণী হলেও ওরা মাংসাশী প্রাণী। মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে। ঘাস, লতা পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে ওরাও এক পরিবারের প্রাণী। যেমন- ভেড়া, হরিণ, খরগোস, ইঁদুর। আবার যে সব প্রাণীর শরীররে লোম থাকে, শরীরের রক্ত গরম , আর বাচ্চাদের দুধ খাওয়ায়, ওদের স্তন্যপায়ী প্রাণী বা ম্যামেল বলে। হাজার প্রকারের মাছ ,সরীসৃপ আর মাছ আছে। ওরা ম্যামেল বা স্তন্যপায়ী না। কিন্তু স্তন্যপায়ী প্রাণীর মত হাড় আছে ।
আগের দিনের বিজ্ঞানীরা জীবজন্তুর এত প্রজাতি দেখে অবাক হতেন। কিন্তু খাতা কলমে লিখে রাখতেন না। দরকার মনে করতেন না। ১৬৬০ সালে ইংরেজ প্রকৃতিবিদ জন রে ( ১৬২৮- ১৭০৫) বিস্তর খেটেপিটে ১৮৬০০ আলাদা ধরনের গাছপালার তালিকা বানিয়েছিলেন। সন্দেহ নেই কাজের মত একটা কাজ করেছিলেন। উনার মতে গাছপালা দুই ধরনের। এক ধরনের গাছের চারা গজানোর সময় দানা থেকে একটা সরু পিচ্চি পাতা হয়। আরেকটা গাছের দানা থেকে চারা গজানোর সময় সরু পিচ্চি দুটো পাতা হয়। ব্যস। এই ।
ভাল কথা। এই জন রে ভদ্রলোক ১৬৯৩ সালে জীবজন্তুর মধ্যে একটা ভাগ করলেন। দুই ভাগ। যাদের পায়ে খুর আছে সেগুলো এক পদের জন্তু। যেগুলোর পায়ে নেই সেইগুলো আরেক পদের। আবার খুরওয়ালা জন্তুর মধ্যে ভাগ করলেন এক খুরওয়ালা। দুই খুরওয়ালা। হেন তেন।
পরে অনেক বিজ্ঞানী এই নিয়ে কাজ করেছেন। কারো কাজই একদম নিখুঁত বা সেরা হয়নি। যে যার মনের মত তালিকা বানিয়েছেন। কেউ গাছের পাতার সাইজ অনুয়ায়ি করেছেন। কী ফলের প্রকৃতি অনুয়ায়ি। বললাম না, যার যেমন মর্জি।
তারপরও কথা থাকে এই ভিন্ন প্রজাতির গাছ বা জন্তু ভিন্ন হল কেন ? ওরা কি অতীতে একটাই প্রজাতি থেকে জন্ম নেয়া শুরু করে ধীরে ধীরে বদলে নতুন নতুন সব প্রজাতি তৈরি করেছে ? যেমন ধর , তোমার পুরানো চশমার ফ্রেম আর কাচ নতুন করে বদলে ফেললে। এবং বদলে একদম নতুন চশমা হয়ে গেল। বিজ্ঞানীরা এই কায়দাকে বলে- বিবর্তন।
তো, কেউ কিন্তু বদলটা চোখের সামনে হতে দেখেনি। রাতারাতি কোন জন্তু বদলে যায় না। ইতিহাস বলে- কুকুরের বাচ্চা কুকুরই হয়। চড়ুই পাখির বাচ্চা চড়ুই পাখি ই হয়। একটা কথা মনে রাখবে আমাদের পরিচিত এই ইতিহাস কিন্তু মাত্র পাঁচ হাজার বছরের পুরানো। আর এর বেশি পুরানো দিনের ইতিহাস আমরা জানি না। বিজ্ঞানীরা সবাই একমত আমাদের পৃথিবীর বয়স কিন্তু মাত্র পাঁচ হাজার বছর না। লক্ষ লক্ষ বছর পুরানো আমাদের পৃথিবী। শুধু লক্ষ না। কোটি। পৃথিবীর বয়স এমনকি ৪৬ কোটি বছর বলেও অনুমান করেন বিজ্ঞানীরা। আর এই বিশাল সময়ের মধ্যে বিবর্তন নিজের কাজ করার জন্য প্রচুর সময় পেয়েছে। ধীরে ধীরে হলেও। অ-নে-ক লম্বা সময়।
কিন্তু এই প্রজাতির পরিবর্তন বা জীবজন্তুর বিবর্তন হয় কেন ? যদিও ধীরে ধীরে হয় কিন্তু কেন হয় ? কি দরকার ? কোন দরকার আছে নিজেদের শরীর চেহারা বদল করার ?
এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রথম যে লোক আমাদের ধারনা দেন উনার নাম- জেন ডা লামারক( ১৭৪৪-১৮২৯) । জাতিতে ফরাসী। পেশায় , প্রকৃতিবিদ। ১৮০৯ সালে উনি একটা বই লিখে ব্যাপারটা আমাদের জানান। উনার মতে- প্রতিটা জীব বা গাছপালা নানান কারনে নিজের জীবনের গতিপথ বদল করে। এবং সেই ফলাফল তাদের বাচ্চারা জন্মসূত্রে পায়। উনি উদাহরণ দিয়েছেন- হরিণ জাতীয় এক প্রাণী আছে অ্যানটিলোপ। ওরা গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারন করতো। বেশির ভাগ সময় বেঁটে গাছের পাতা আগে শেষ হয়ে যেত। তখন গলা উচু করে উপরের ডালের পাতা খাওয়া শুরু করলো। পরে দেখা গেল ওদের বাচ্চাদের গলা একটু একটু লম্বা হচ্ছে। এই ভাবে হাজার বছর পর দেখা গেল অ্যানটিলোপ প্রাণীটা বদলে গিয়ে জিরাফ হয়ে গেল। ফুস মন্তর। জাদুর মত।এই ভাবেই প্রকৃতির অনেক প্রাণী বদলে গিয়ে লম্বা, বেঁটে বা ছোট হয়ে যায়।
পরে বিজ্ঞানীরা বলেছেন জেন ডা লামারক নামের বিজ্ঞানীর কথাগুলো পুরোপুরি সত্য নয়। এই জিনিসটা সুন্দর করে গুছিয়ে বলেছেন চার্লস ডারউইন( ১৮০৯-১৮৮২) । উনি একটা বই লেখেন ১৮৫৯ সালে। নাম- দ্যা অরজিন অব স্পিসিজ। ইয়া মোটা ইটের মত বই। উনি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন জীবজন্তু, গাছপালা সবাই টিকে থাকতে চায়। জীবজন্তুর দক্ষতা সবার সমান না। কেউ বেশি শক্তিশালী। কেউ অন্ধকারে দেখতে পায়। কেউ দ্রুত দৌড়াতে পাড়ে। কারো গায়ের রঙটা অমন যে লুকিয়ে থাকতে পারে। যেমন ,বাঘ।দীঘল ঘাসের বনে লুকিয়ে থাকলে টের ও পাবে না কেউ।
যে জীবজন্তু সহজেই খাবার জোগাড় করতে পারে ওরা বেঁচে যায়। যারা শত্রুর সাথে মারামারি করতে পারে ওরা বেঁচে যায়। অথবা লুকিয়ে থাকতে পারে ওরাও বেঁচে যায় অন্যের হাতে মারা না গিয়ে। এটা চলতে থাকে। বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম। প্রজাতি তখন পরিবেশের সাথে সাথে নিজেকে বদলে ফেলে। টিকে থাকার জন্যই। শারীরিক ভাবে বদলে যায়। নতুন রকম চেহারা হয়ে যায়। ডারউইন বলেন- এই বিবর্তনটা আসলে প্রকৃতির নির্বাচন। আমাদের কোন হাত নেই। প্রকৃতি নিজেই এই খেলা খেলে।
অনেক বিজ্ঞানী ডারউইনের এই কথা শুনে গবেষণায় নেমেছেন। অনেক অনেক প্রমাণ পেয়েছেন তারা যাতে মনে হয় ডারউইনের কথা সত্যি। খুঁজে পাওয়া পুরানো দিনের ফসিল ও তাই বলে।
বদলে যাবার এই গল্পটা সত্য , এবং রোমাঞ্চকর।
বদলে যাবার গল্প
Loading books...