Site icon খিচুড়ি

দ্বিতীয় আমি

OLYMPUS DIGITAL CAMERA

আমার বাসাটা একটু গলির মধ্যে।  যদিও বাসার সামনে মোটামোটি রিকশা চলাচলের উপযোগী রাস্তা আছে। কিন্তু, রোজ আমার ভাগ্য এতো সু প্রসন্ন হয়না যে বাসা থেকে বেরিয়েই একটা রিকশা পেয়ে যাব। রিকশা পাওয়ার জন্য আমাকে প্রায় ১৫  মিনিট হেটে গিয়ে মেইনরোডে উঠতে হয়। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে আমার ভাগ্যটা আরেক্টু বেশিই খারাপ। দরদাম করে যেই রিকশায় উঠতে যাব অমনি মনে হলো অফিসের কালো ফাইলটা বাসায় রেখে চলে এসেছি।
একেতো ১৫ মিনিটের হাটা পথ, তার উপরে আবার বেশ কম দামেই রিকশাটা পেয়েছিলাম। কিন্তু ফাইলটাও খুব জরুরী।
না নিয়ে গেলেই নয়। অজ্ঞতা আবার বাসার পথ ধরলাম।
পাক্কা ১৫ মিনিট হেটে চার তলার সিড়ি ভেঙ্গে যখন আমার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে  হাপাতে হাপাতে এসে দাড়িয়েছি, তখন আমার চোখ চড়কগাছ। একটু আগে আমি মাত্র দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়েছি, চাবি এখনও আমার পকেটে কিন্তু দরজা দেখি দিব্বি খোলা। ভেতর থেকে আবার খটখটানির শব্দও আসছে।
আমার পঞ্চ ইন্দ্রিয়  সজাগ হয়ে উঠল। ঘরে কেউ আছে। আর এভাবে না বলে কয়ে  ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তালা খুলে কোন ভদ্র লোক যে ঢুকবেনা সেটা আর বলার দরকার পড়েনা। সুতরাং যে ভেতরে আছে সে চোর না হয়ে যায়না।  
আমি সন্তর্পণে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। পুরো ফ্ল্যাটে মোট মিলিয়ে তিনটে রুম। একটাতে আমি থাকি, বাকি দুটোতে থাকে দুজন স্টুডেন্ট। ঝন্টু আর মন্টু।  ছুটিতে তার গিয়েছিল বেড়াতে। বলে গিয়েছিল, তিন তারিখের আগে ফিরবেনা। আজকে তো সবে ১ তারিখ। তারা ফিরে এলোনা তো? ঝন্টুর রুমটা দরজা থেকে সবচেয়ে কাছে। ওর রুমের পর কিচেন। কিচেন এর পর মুখোমুখি দুটো রুম। একটাতে আমি থাকি, আর বাকিটাতে থাকে মন্টু।
আগ্রহী হয়ে ঝন্টুর রুমে উকি দিলাম। নাহ! কেউ নেই। এমন সময় মন্টুর  রুম থেকে একটা শব্দ ভেসে এলো কানে। ধাতব কিছু একটা পড়ার শব্দ। আমি দ্রুতপায়ে শব্দ লক্ষ করে এগিয়ে গেলাম। রুমের এককোনে একটা থেতলে যাওয়া পেতলের বাটী তখন তিরতির করে কাপছে। বাটি ফেলল কে? বিড়াল কি? এতো দিন ধরে আছি বিড়াল টিড়ালতো চোখে পড়িনি। আর বাটিটাতো গতকাল রাতে আমার রুমেই ছিল। তবে কি কেউ আমার রুম থেকেই ছুড়ে মারল?
আর এমনভাবে বাটিটাকে থেতলালোইবা কে?
বাটিটার দিকে এগিয়ে যাব এমন সময় ধুম করে আরেকটা শব্দ হলো। এবার দরজায়। আমি আতকে উঠলাম। হায় হায় চোর বোধহয় সব জিনিসপত্র নিয়ে পালালো। আমি দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। এতো জুড়ে দরজাটা লাগানো হয়েছে যেঁ ওটা এখনও তিরতির করে কাপছে। কেউ যেন তার সব রাগ ঝেরে গিয়েছে নিরিহ দরজাটার উপর। সিড়িতে তখনও চোরের পায়ের শব্দ। আমি দ্রুত সিড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। কিন্তু বাইরে অব্দি এসেও চোর তো চোর তার টিকিটিও কোথাও খুজে পেলাম না।
যাহোক, ঘরে ফিরে এসে দেখলাম তেমন কিছুই খোয়া যায়নি। কিন্তু ঘরের সব জিনিসপত্র তছনছ করা। টেবিলের ড্রয়ার খুলে আমার সেই কালো ফাইলটা বের করতে গিয়ে আতকে উঠলাম। ড্রয়ার খালি, ফাইলটা নেই সেখানে।
তবে কি ব্যাটা চোর ফাইলটা নেয়ার জন্যই এসেছিল! আর এই ফাইলই নিয়েই বা কার কি লাভ হবে? হ্যা ফাইলটা অফিসের জন্য জরুরি, কিন্তু এমন না যে ফাইলে এমন কিছু আছে যা লোকের কারো কাজে লাগতে পারে। আসলে ফাইলে অফিসের খরচের হিসাবটা আমার মূল হিসাবের খাতা থেকে সাজিয়ে তোলা। ২-৩ ঘন্টাতেই এইরকম ফাইল আরেকটা বানিয়ে ফেলা যায়!

যাহোক! চোর নিয়েছে ভালো কথা কিন্তু এই ফাইল আজকে না নিয়ে গেলে আমি যেঁ ঝারি খাব সেটা থেকে কিভাবে বাঁচা যায় আমি বরং সেটা নিয়ে চিন্তা।

এমনিতেই গতকাল বস না থাকায় অফিস টাইম শেষ হবার আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম তার উপর অফিসের ফাইল বাসায় নিয়ে এসেছি এবং সেটা আবার হারিয়ে ফেলেছি।
বস যদি জিজ্ঞেস করে যে ফাইল কেন বাড়িতে এনেছিলাম? কি বলব?
কাজ বাকি ছিল!
কাজ কেন বাকি ছিল?
কারণ অফিস থেকে আগে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।

পুরো ফেসে যাব দেখছি।
তার চেয়ে একটা প্ল্যান করা যাক। মনে মনে বুদ্ধি এটে আমি অফিসে পিয়নকে আমি কল দিলাম।
ঃ.হ্যালো, কুদ্দুস ভাই?

ঃ জী স্যার!
ঃ কুদ্দুস ভাই, দেখেন তো আমার ডেস্কে একটা কালো রঙের ফাইল আছে ওটা আছে কিনা?
কুদ্দস আমাকে লাইনে থাকতে বলে গেল চেক করে আসতে।
ফিরে এসে যা জানালো, তাতে আমি চমকে উঠলাম। ফাইলটা আমার ডেস্কেই রাখা আছে। কালকে বাসায় বসে যে ফাইলে কাজ করেছি তা অফিসে পৌছাল কিভাবে কে জানে!



সকাল সকাল মেজাজটা বিগড়ে গেল। রেডি হয়েছি অফিসে যাব, কিন্তু কিছুতেই আমার ব্যাগটা খুজে পাচ্ছিনা। আতি পাতি করে খুঁজলাম চারদিক। নিজের রুম তো খুজলামই, পুরো ফ্লাট তন্ন তন্ন করে খোঁজে ফেললাম। নেই তো নেইই। শেষ মেষ ব্যাগ ছাড়াই, ড্রয়ার থেকে অফিসের কালো  ফাইলটা নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। মেজাজ খারাপ বলেই না কি করে যেন, বাসা থেকে বেরোতেই একটা রিকশা পেয়ে গেলাম।
কিন্তু অফিসে গিয়ে হলো আরেক কান্ড! রিকশা পাওয়ার আনন্দের মনটা একটু হালকা হতে শুরু করেছে সবে। ডেস্কে ফাইলটা রেখে, ভাবলাম একটু ওয়াশ রুম থেকে আসি। হাত মুখ ধুয়ে ডেস্কে এসে দেখি আমার কালো ফাইল গায়েব। ৫ মিনিটের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে গেল জানে। আতিপাতি করে পুরো ডেস্ক উলোটপালট করে ফেললাম। নেই তো নেইই, আমার ব্যাগের মত যেন গায়েব হয়ে গিয়েছে।
রাগে দুঃখে আমার ভয়ানক অবস্থা যখন, তখন দেখি কি, আমাদের অফিসের পিয়ন, কুদ্দুস ভাই ফাইল নিয়ে  আসছে।
আমি ধমক দিতে যাব। দেখি ব্যাটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।
আবার বলে কিনা, আমি নাকি এতোখন বাসা থেকে ফোন করে তাকে দিয়ে ফাইল ভেরিফিকেশন করছিলাম।
মেজাজটা কেমন হয় বলুন!
ইচ্ছে করে সকালে ব্যাগ না পেয়ে রাগে যেমন করে মণ্টুর পেতলের বাটিটাকে থেতলে ওর রুমে ছুড়ে মেরেছিলাম, একটা ঘুসি মেরে এই ব্যাটার মুখটাকেও তেমনি থেতলে দেই!

ফিচার ইমেজঃ Split Personality painting by Béla Borbély

Exit mobile version