পরিচালনাঃ সত্যজিৎ রায়
দৈর্ঘ্যঃ ১১৭ মিনিট
রঙঃ সাদাকালো
ভাষাঃ বাঙলা
দেশঃ ভারত
প্রযোজনাঃ আরডিবি প্রোডাকশন্স
চিত্রনাট্যঃ সত্যজিৎ রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (মূলগল্প)
সঙ্গীতঃ সত্যজিৎ রায়
চিত্রগ্রহণঃ সুব্রত মিত্র
অভিনয়ঃ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, শ্যামল ঘোষাল
কাহিনী সংক্ষেপঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মান করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে তিনি মূল গল্প থেকে কিছুটা সরে এসেছিলেন। কেন জানি আমার মনে হয় চলচ্চিত্রটির পরিচয় ‘নষ্টনীড়’ দিয়ে নয়, বরং চারুলতাই নষ্টনীড় এর পরিচয়। গল্প উপস্থাপনার গুণে উৎরে যায়, গল্পের গুণে উপস্থাপনা নয়। এত চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, আমার সব সময়ই মনে হয়েছে যে আমি চারুলতা দেখছি, নষ্টনীড় এর চলচ্চিত্র রূপ নয়। এই কাহিনীচিত্রটিকে অনেকেই মনে করেন সত্যজিতের সবচেয়ে ত্রুটিহীন ছবিগুলোর একটি। অনেকের দৃষ্টিতে, ছবিটিতে চারুলতা নামের এক নিঃসঙ্গ গৃহবধূর বেদনা এবং পরবর্তীতে তার দেবরের প্রতি ভালোবাসার অন্তর্দহন সত্যজিত যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা ছাড়িয়ে গেছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সুনিপুণ কাব্যময়তাকেও।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে The Lonely Wife বলে পরিচিত এ ছবির গল্প গড়ে উঠেছে দাম্পত্য সম্পর্ক ও প্রেমকে উপজীব্য করে। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রটির কাহিনী ১৮৭৯ সালের। চারুলতার স্বামী ভূপতি , তৎকালীন সময়ের উচ্চবিত্ত এক পরিবারের কর্তা , পেশায় আইনজীবী, প্রচণ্ড খেয়ালী একজন মানুষ। এই ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শৈলেন মুখোপাধ্যায়। এত শক্তিশালী অভিনয় খুব কমই দেখা যায় এই ধরনের চরিত্রে। প্রচণ্ড রাজনীতি সচেতন এই ব্যক্তিটি তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা প্রকাশের জন্য বাড়িতেই ‘Sentinnel’ নামে এক ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং রাতদিন এই পত্রিকা নিয়ে কাজে ডুবে থাকেন। এটিই যেন তাঁর ধ্যান জ্ঞান। চারুলতা সম্পর্কে কি আসলেই উদাস ছিলেন তিনি? এটা আসলেই একটা বড় প্রশ্ন এই চলচ্চিত্রটিতে। প্রথাগত ভাবে দেখলে একদিকে মনে হয় তিনি উদাসই ছিলেন নিজের স্ত্রীর প্রতি। কিন্তু তাই যদি হত তাহলে চারুলতার ভাই উমাপতিকে কেনই বা তিনি নিয়ে আসবেন? শুধুই কি নিজের কাজের সুবিধার জন্য, চারুর একাকীত্ব দূর করার কোন প্রয়াস কি সেখানে ছিল না? উমাপতির স্ত্রী মন্দাকিনীর উপস্থিতি কি আদতে চারুর নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য নয়? প্রশ্নটা আপনাদের কাছেই থাকল, নিজেই খুঁজে নিবেন উত্তরটা। এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে অসাধারণ চরিত্র হচ্ছে চারুলতা। নামের সার্থকতা এই যে লতার মতই এই চরিত্রটি ক্রমশ বেড়ে উঠেছে, এগিয়ে গিয়েছে, ছাড়িয়ে গিয়েছে নিজেকেই। তার পুরো পরিচয় কেমন যেন পর্দার আড়ালেই থেকে গেছে, কখনওই প্রকাশ হয়নি। কিংবা বলা যায় হতে দেয়নি। হঠাৎ করে দমকা হওয়ায় উড়ে যাওয়া পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কিশোরীর মত ক্ষণিক আবেশ হয়ত পাওয়া যায় কিন্তু পুরোটা আত্মস্থ করা হয়ে উঠে না কখনোই। তারপর অমলের চরিত্রটির কথায় আসি। সদা হাস্য, প্রাণোচ্ছল একটি ছেলে। সদ্য পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দাদার কাছে ক’দিনের জন্য এসেছে ছেলেটি। একটি ঝড়ের দৃশ্যে আগমন এই চরিত্রের, পুরো চলচ্চিত্রে ঝড়ের মতই সে পালটে দিয়েছে ঘটনাপ্রবাহ, সম্ভাব্যতা।
অসাধারণ প্রতিভাধর অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন এই চরিত্রে। আমার মতে উনি ছাড়া এই চরিত্রের রূপদান আর কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। ছেলেমানুষির আবহে তিনি ফুঁটিয়ে তুলতে পেরেছেন আবেগের বিভিন্ন অবস্থা গুলো। তার বৌঠান চারুলতার প্রতি তার কোন দুর্বলতা ছিল বলে প্রথম দিকে মনে হয় না। বরং যখন ভূপতি তাকে চারুর সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচনের ভার দেয়, তাকে বেশ বিরক্তই দেখা গিয়েছে। চারুর সাথে প্রথম দিকে তার সম্পর্কটা বন্ধুত্বের দিকেই বেশি যায়। হাস্য রসাত্মক, বন্ধুত্বপূর্ণ , ছেলেমানুষি দেবর সুলভ চরিত্রই তার মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে। কিন্তু চরিত্রটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়েছে তখনই যখন তার উপর চারুর টান সে বুঝতে পারে এবং দাদার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে বুঝতে পেরে সে রাতের বেলাই একটি চিঠি রেখে চলে যায়। পুরো সময়টুকুতে চরিত্রের ছেলেমানুষি দিকগুলো ফুঁটে উঠলেও কিছু কিছু সময় তার চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রশংসা করার মত। বিয়ে করলে বিলেত নিয়ে যাবে এমন লোভনীয় সুযোগও হেলায় ছেড়ে দিয়েছিল সে। মন্দাকিনী চরিত্রটি সবচেয়ে সহজ এবং সাবলীল চরিত্র। কোন লুকোছাপাই নেই তার মাঝে। অমলকে ভাল লাগাও যেমন সহজে প্রকাশ্য, তেমনি চারুর সাথের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বটাও সহজেই বোঝা যায়। অমলের ভাষায় মন্দাকিনী প্রবীণার প্রতিনিধিত্ব করে আর চারু করে নবীনার। অমলের প্রতি চারুর ভালবাসা ছিল এটা বেশ বোঝা যায়, যদিও কেন জানি মনে হয় শুরুটা বাৎসল্য দিয়েই হয়েছিল। নিজে লেখালেখি শুরু করার পেছনে ছিল আবেগ, যেটা বেগ পেয়েছিল মন্দাকিনীর প্রতি অমলের আগ্রহের কারণে।
একাকীত্ব কি তার দৃঢ়তাকেই ভেঙে দিয়েছিল? নাকি সাহস জুগিয়েছিল প্রথা ভেঙে কলম ধরার জন্য। ভূপতির প্রতি তার প্রেম ছিল একথা মিথ্যা নয়, কিন্তু সেটা কি সে ধরে রাখতে পেরেছিল? নাকি কাগজের নৌকার মত কিংবা ফুঁটো হয়ে যাওয়া ঘুড়ির মত সেই প্রেমের পরিনাম ছিল বিচ্ছেদ! সত্যজিৎ রায় এই বিচ্ছেদটাকে এত অসাধারণ ভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন যে মুগ্ধতাও ছাপিয়ে উঠেছে আবেগের কলস থেকে। প্রতিটি চরিত্রকে মনে হয়েছে ঠিক এরকমই হওয়ার কথা ছিল এদের। চরিত্রচিত্রণ, গল্প বলার ধরন সবই ছিল অসাধারণ। আর দৃশ্যায়ন ছিলো মনোমুগ্ধকর। ১১৭ মিনিট যে কিভাবে কেটে গেছে তা বুঝতেও পারিনি। মনে হচ্ছিল এক মোহময় আবেশে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে বাস্তব আর আবেগের মেঘপুঞ্জের ভেতর দিয়ে।
বিশেষত্বঃ
সত্যজিৎ রায় তাঁর নিজের ছবিগুলোর মধ্যে চারুলতাকে আলাদা গুরুত্ব দিতেন। এক সাক্ষাতকারে তিনি পরিস্কার বলেছিলেন- “এটিই একমাত্র চলচ্চিত্র যা আজও বানালে ঠিক এভাবেই বানাতাম।” এই মন্তব্য থেকেই বোঝা যায় এই চলচ্চিত্র নির্মানে তিনি কতটুকু সন্তুষ্ট ছিলেন!
এ ছবির মূলভাবও তাঁর অন্য ছবির চেয়ে আলাদা। মানব-সম্পর্ক, মনোদৈহিক টানা-পোড়েন, ব্যক্তিপ্রেম ও স্বকিয়তা ইত্যাদি পরিপক্ব বিষয় নিয়ে খেলেছেন তিনি। সত্যজিতের রবীন্দ্রপ্রীতিও এ ছবিতে প্রবল। এর আগে তিন কন্যায় তিনি রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে কাজ করেছিলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, চারুলতার অমলকে অনেকেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের প্রতিভূ বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে এ ছবির ক্যামেরা কৌশল ও সেট ডিজাইনেও সুন্দরী চারুলতার বন্দীত্ব এবং অন্দরমহলে নারীর একাকীত্ব বিস্তৃতভাবে উঠে এসেছে। জানালার লোহার গারদ, দূরবীন দিয়ে বাহির দেখা, খাঁচার মধ্যে বন্দী পাখি এইসব কিছু নিয়েও চারুলতার অভ্যন্তরীন জীবন ফুটে উঠেছে। ১৯৬৫সালে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে এটি সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়।
এর আগের বছর বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে এটি সিলভার বেয়ার পুরস্কার পায়। দেশের বাইরে ছবিটি নিয়ে উচ্ছ্বসের কমতি না থাকলেও, নিজ দেশে ‘চারুলতা’র চিত্রনাট্য নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েন সত্যজিৎ। বেশকিছু চিত্র সমালোচক ছবিটিকে ‘নষ্টনীড়’-এর মূলানুগ না হওয়ার অভিযোগ তোলেন। সত্যজিৎ কিন্তু এসব সমালোচনার কড়া জবাবই দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “যখন কোনো কেতাবি পন্ডিত ‘নষ্টনীড়’ গল্পের উপসংহার ও ‘চারুলতা’ ছবির উপসংহারের মাত্রাগত তফাৎ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন স্বভাবতই আমাদের বলতে হয়- “This is surely the result of lopsided film education, lack of connoisseurship, and applies only to a country which took one of the greatest invention of west with the most far reaching artistic potential and promptly cut is down to size.”
বিশেষ তথ্যঃ
- অমলের দিকে তাকিয়ে চারু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’; বলিউডে প্রদীপ সরকার পরিচালিত একটি ছবিতে ‘সোনা মন কি অঙ্গন’ গানে এই দৃশ্যায়নকে অনুসরণ করা হয়। এমনকি প্রদীপ সরকার পরিচালিত ওই সিনেমায় নায়িকাকে চারুলতার মতো পোষাক পরানো হয়। শরতচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে তৈরী এই ছবিতে রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে।
- চারুলতার মূল নেগেটিভ এক দূর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে গিয়েছিলো।
চলচ্চিত্র থেকে কিছু স্থির চিত্রঃ