Site icon খিচুড়ি

এক কাপ চা এবং তিরিশখানা ভোট

ধীরে ধীরে মানুষজন বাড়ছিল। কিছুখন পরেই সেটা একটা একটা বিশাল জনস্রোতে পরিণত হলো। কিছুখনের মধ্যেই প্রধান সড়কটা বন্ধ করে দিয়ে মিছিল করতে বেড়িয়ে পড়লো ওরা। রাস্তায় যত রিকশা ছিল, গাড়ি ছিল, মানুষ ছিল সবার হঠাৎ থেমে যেতে হলো। মানুষের পক্ষ থেকে সে মিছিলে কেবল শরীক হলো পাগল নুরু মিয়া। সে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বললো, “ভোট! ভোট! ভোট! জনগণের ভোট!”। অন্যরা ভ্রু কুঞ্চিত করে দাঁড়িয়ে রইলো মিছিল চলে যাওয়ার আশায়। এক রিকশাওয়ালা গিয়েছিল মিছিলের ফাক গলিয়ে বেড়িয়ে যেতে কিন্তু একটু পরেই সে নিজের নাক দুফাক করে বেড়িয়ে এলো। নাক দিয়ে রক্ত পড়তে থাকলো দরদর করে।
ঘন্টা দুয়েক বাদ্য বাজনা নিয়ে রাস্তা আটকে মিটিং মিছিল চালালো রাজনৈতিক লোকগুলো। তাঁরপরে বোধহয় দয়া হলো, বিদায় নিলো তারা সেদিনের মতো।


মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকান বসেছে। দোকানের দেয়ালে সাটিয়ে রাখা পোস্টারের প্রার্থীর নামে এক আধটু গুনকীর্তন করলেই চা মিলছে বিনামূল্যে। ছেলে বুড়োদের উপচে পড়া ভিড় সেখানে। আসছে, খাচ্ছে আর ভোটের অঙ্গিকার করে বিদায় নিচ্ছে একেকজন। পাগল নুরু মিয়া বেশ কয়েকবার দোকানটার আশেপাশে ঘেসার চেষ্টা করছিল। কিন্তু যুৎ করতে পারেনি। কাছে গেলেই লোকজন খেকিয়ে উঠছে। একজন অতি উৎসাহী আবার লাঠি দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিয়েছে তাঁর পায়ে। এখনও ব্যাথায় টনটন করছে জায়গাটা। এরপরও বিনামূল্যের চায়ের আশা ছাড়তে পারেনি নুরু মিয়া। এদিক সেদিক ঘুরে একটা গাছের গা থেকে একটা পোস্টার টেনে তুললো সে। পোস্টারে প্রার্থীর হাসিমাখা মুখ। নুরু মিয়া পোস্টারটা নিয়ে ধীরপায়ে আবার দোকানটার দিকে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে বললো, এরেই ভোট দিমু! চা দেও দেখি!
অমনি সবাই হৈ চৈ করে উঠলো, “হুর! হুর! ভাগ ব্যাটা। পাগলের আবার ভোট হয় নাকি?”

 

স্কুলের মাঠে সেদিন বেশ ভিড় জমেছে। শত শত মানুষ আসছে ভোট দিতে। এমন সময় একজন সর্বজ্ঞ এবং মহানুভব লোক এসে ঘোষণা করলেন, “ভাই সকল! আপনারা সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্ট করেছেন। তাই আপনাদের এই কষ্ট লাঘবের জন্য আমরা বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি। আপনারা কোন প্রার্থীকে ভোট দিবেন সেটা তো আমরা জানি-ই। সুতরাং আপনারা সবাই চাইলে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। আমরা কথা দিচ্ছি আপনাদের ভোটটা আমরা অবশ্যই দিয়ে দেব।”
ঘোষণার পর এমনিতেই অর্ধেকের বেশি লোক চলে গেল। যে গুটি কয়জন “অধিকার! অধিকার” বলে এক আধটু শোরগোল করছিল তাদের ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয়া হলো। ভোট চলতে থাকলো। নিরাপদে, নিরুপদ্রপে, সুষ্ঠ এবং শান্তিপূর্ণভাবে। ভোট দিতে দিতে হাপিয়ে উঠতে লাগলো একেকজন নেতা কর্মী। দেড়-দুহাজার মানুষের ভোট চার পাঁচজন মিলে দেয়া, সেকি আর চারটে খানি কথা?
এদিকে বেলা বাড়ছে। দাওয়ায় বসে গভীর মনযোগে নিজের লাঠিখানা যাচাই করতে করতে বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছেন ভোটকেন্দ্রের বাইরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ  সদস্যটি। এইফাকে কোথা থেকে এসে যেন সেখানে একটা কুকুর এসে জোটেছে। কারো কোন কথা ছাড়াই সে নিজে থেকেই ঘুমন্ত পুলিশের অবর্তমানে পাহারার দায়িত্ব নিয়ে বসে পড়লো সেখানে। এমন সময় ভোট কেন্দ্রে এসে হাজির হলো পাগল নুরু মিয়া। কুকুরটা তাঁকে একবার ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে একবার “ফোক!” করে তাঁকে ভেতরে ঢুকার অনুমতি দিল।
নুরু মিয়া ঢুকতেই ভেতরে একটা শোরগোলের মত পড়ে গেল।
“আরে পাগলটা ঢুকলো ক্যামনে?”
“থাক! থাক! শোর কইরোনা, জিগাও তো কি চায়?”
“নুরু মিয়া কি  চাও? ভোট দিবা?”

সেদিন সন্ধ্যায় আবার মিছিল বের হলো। রাস্তা ঘাট বন্ধ হয়ে গেল আবার। রিকশা, মটর থেমে গেলো। সাধারণ পথিকদের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। এবার আর পাগল নুরু মিয়াও সেই মিছিলে কেন জানি সামিল হলোনা। মোড়ের বিনামূল্যের চায়ের দোকানটা এখন খালি পড়ে আছে। সে চলে গেল ওদিকে। পুরো দোকানে ছেয়ে থাকা অজস্র পোস্টারের একটার সামনে গিয়ে দাড়ালো সে। পোস্টারে প্রার্থীর হাসোজ্জল মুখ। কিছুখন গালে হাত দিয়ে ছবিটার দিকে ঠায় তাকিয়ে রইলো। সহসা নুরু মিয়া একদলা থুথু ছিটিয়ে দিল পোস্টারটাতে। তারপর বিড়বিড় করে বললো, “শুয়োরের বাচ্চাটারে তিরিশখানা ভোট দিলাম আর শালারা পাগলের কোন ভোট নাই কইয়্যা এক কাপ চা দিলোনা আমারে।”

 

Exit mobile version