দৃশ্যপট এক:
– তুই দেখছিলি সাইদি হুজুর রে? আমি দেখছি। নিজ চোখে দেখছি।
কথাটা শুনেই মেজাজটা খিচরে গেল আবিরের। ট্রেনে করে ঢাকায় ফিরছে সে। জরুরী কাজে দেশের বাড়িতে গিয়েছিল। ই-বুক রিডারটা বন্ধ করে সদ্য শেষ করা “এ ব্রিফ হিস্টোরি অব টাইম” পাঠের মুগ্ধতা নিয়ে মাত্র চোখ বুজেছিল। বক্তাকে দেখার আশায় চোখ খুলল আবির। বক্তা আর কেউ নয়। তার মুখোমুখি বসা, তারই সমবয়সী একটা ছেলে। পরনে নোংরা সাদা জোব্বা। মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি। “পারফেক্ট কম্বিনেশন অব ছা-গু” আনমনেই হাসল আবির।
– ভাল তো! নাসা কোটি কোটি টাকা খরচ করে চাঁদে লোক পাঠায়। আর বাংলাদেশের হুজুরেরা জেলে বসেই চন্দ্র ভ্রমণ করে। তাও আবার বিনা খরচে!! মজা করার সুযোগটা ছাড়ল না আবির।
– আপনি কি কইতে চান? আমি মিথ্যা কথা কইতেছি? আমি নিজ চোখে দেখছি। আপনি সাইদি হুজুরকে অপমান করতে পারেন না। সাইদি হুজুরের ক্ষমতা আপনি জানেন না।
– ঠিক তা নয়। ছেলেটার রাগ কমানোর জন্য একটু নমনীয় হল আবির। তর্ক করার মত জ্ঞান আছে নাকি সেটা যাচাই করার জন্যই জিজ্ঞেস করল, কোথায় পড়েন?
– “আমি একজন হাফেজ।”
– মুখে “ও, আচ্ছা” বললেও মানে মনে “শালা কওমি মাদ্রাসার প্রডাক্ট। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী।” বলল আবির।
এই শ্রেণির লোকগুলোকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না আবির। বন্ধুদের কেউ কেউ অবশ্য হাঁটুতে বুদ্ধির মুমিন মুসলমান বলে ব্যাঙ্গ করে। কিন্তু আবিরের চোখে, তারা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তা না হলে জামাত শিবিরের মত দেশ বিরোধী দলকে সমর্থন করতে পারে? চাঁদে সাইদিকে দেখার গুজবে রাস্তায় নামতে পারে? সাইদির মত রাজাকারকে বাঁচাতে জীবন দিতে পারে? মাহমুদুর রহমানের মত স্বার্থান্বেষীর কুটচালে পরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরোধিতা করতে পারে? “আমার দেশ” নামক পত্রিকার মিথ্যা প্রোপাগান্ডা বিশ্বাস করে রাস্তায় নামতে পারে? আর একবার মনে মনে “শালা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। পুলিশ আরো বেশি মারল না কেন? দেশ থেকে কিছু জঞ্জাল পরিষ্কার হত।” বলে গালি দিয়ে বিরাট লেকচারের প্রস্তুতি নিলো সে।
দৃশ্যপট দুই:
আরে এইতো! এখানে হেফাজতে ইসলামির সকল জারি জুরি ফাঁস করা হয়েছে। ফেসবুক খুলতেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল আবিরের। পড়া মাত্র শেয়ার দিল আবির। সেই সাথে ব্যক্তিগত মতামত, “ইসলামের নামে যুদ্ধাপরাধীরে বাঁচানোর ষড়যন্ত্র রুখে দিন। যার যা আছে তাই নিয়ে রাস্তায় নামুন। প্রতিহত করুন নব্য রাজাকারদের।” যাক, এইবার ছা-গুদের বাঁচায় কে। ইমরান সরকার ও শাহবাগের মঞ্চ থেকে হেফাজতে ইসলামকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। এইবার আর ছা-গুদের রক্ষা নাই।
“এত লোক মরে, তুই মরিস না কেন?” আম্মির চিৎকার শুনে চমক ভাঙ্গে আবিরের। ল্যাপটপ বন্ধ করে এগিয়ে যায়। নিশ্চয় শিশির কিছু করেছে। শিশির আবিরের ছোট ভাই। আবিরের চেয়ে ৪ বছরের ছোট। ছোট বেলা থেকেই হাইপার অ্যাকটিভ অ্যাটেনশন ডিজঅর্ডারে ভুগছে। সারা শরীরে কাদা নিয়ে বাসায় ফিরেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কোন পচা ডোবায় নেমেছিল। সারা শরীর দিয়ে দুর্গন্ধ আসছে।
– কতবার বলছি, বাসার বাইরে যাবি না। তোকে এখন কে পরিষ্কার করবে? তোকে পরিষ্কার করতে গেলে রান্নার কি হবে? আম্মি চোখ মুছতে মুছতে আরো জোরে কড়াইয়ে খুন্তি চালায়।
– আম্মি, আমি করছি। তুমি কেঁদনা তো? ও কি ইচ্ছা করে এমন করে নাকি? তুমি তো জান, ও অসুস্থ।
পরম যত্নে ভাইয়ের শরীরে সাবান মাখতে মাখতে আবির জানতে চায়, “কিরে? কত দিন গোসল করিস না?” শিশির জবাব দেয় না। মুচকি হাসে। শিশিরের হাসিতে ওর গা থেকে আসা নর্দমার দুর্গন্ধের কথা ভুলে যায় আবির।
দৃশ্যপট তিন:
ট্রেন থেকে নামার পর থেকেই শুধু আবিরের কথা ভাবছে মাসুম। আবির ভাই কত বেশি জানে। সে চাঁদে সাইদি হুজুরকে দেখেছে শুনে কি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল। আলেই তো, ছোট বেলায় দাদির কাছে চাঁদের বুড়ির গল্প শুনে চাঁদে তাকালেই তো বুড়িকে দেখেছে সে। আবির ভাই তো মিথ্যা বলে নাই। পুরোটাই বিশ্বাসের কারণে ঘটেছে। ওর যদি সাইদি হুজুরের ক্ষমতা নিয়ে এত বিশ্বাস না থাকত, তাইলে ও দেখত না। ওর সহপাঠী রহিম যেমন দেখে নাই। কিন্তু বড় হুজুর বলছে, বড় হুজুরের কথা অবিশ্বাস করলে গোনাহ হবে। দোযখে পুরতে হবে। তাই ভয়ে, রহিমও বলছে যে সে সাইদি হুজুরকে দেখছে।
বড় হুজুর, এতিম খানার প্রধান শিক্ষক বলা চলে। মাসুমের পরম শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। শ্রদ্ধাভাজন হবে না কেন? বাবা মারা যাবার পর মায়ের পক্ষে সংসার চালিয়ে নেয়া অসম্ভব ছিল। কোন রকম টেনে টুনে এক বছর চলেছে। যার অধিকাংশ দিনই প্রায় না খেয়ে থাকতে হয়েছে। তারপরই মা ক্ষুধার হাত থেকে বাঁচতে তাকে এতিম খানায় পাঠায়। বড় হুজুরের কাছে হাফেজিয়া পাঠে দীক্ষা নেয় সে। এতিম খানা আর বড় হুজুর হয়ে ওঠে তার পৃথিবী। বড় হুজুরের কাছে ইসলামী খেলাফতের কাহিনী শোনে। শোনে হুজুর পাক (সঃ) মানবিক গুণাবলির কথা। অন্তর থেকে বিশ্বাস করে, খেলাফত কায়েম হলে থাকবে না ক্ষুধার যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণায় এক মায়ের কাছ থেকে সন্তান আলাদা হয়ে যায়। মায়ের কথা ভাবতেই দু’ফোটা অশ্রু জমে চোখের কোনায়।
দৃশ্যপট চার:
বড়হুজুর বলছে জিহাদে যেতে হবে। বড় হুজুরের কথার উপর কথা নাই। তারপরও আবির ভাইয়ের কথা মনে পরছে। আবির ভাই বলছে, সব মিথ্যা কথা। দেশে নাস্তিক ব্লগারের সংখ্যা খুব বেশি হলে ১০ জন। মাত্র দশ জনের ফাঁসির দাবিতে এত লোকের আন্দোলনে নামতে হয় না। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ভিন্ন। মাসুমের মনেও সন্দেহ জাগে। বড় হুজুর কি মিথ্যা কথা বলছে? না, বড় হুজুর মিথ্যা বলতে পারে না। তাছাড়া, বড় হুজুর তাকে তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থামানোর আন্দোলনে যাইতে কয় নাই। বড় হুজুর কইছে, নাস্তিকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে। এই যে মিসিল যাচ্ছে, সেখানে তো কেউ সাইদির মুক্তি চাচ্ছে না। রাজাকারের মুক্তি চাচ্ছে না। চাচ্ছে খেলাফত আন্দোলন আর নাস্তিকের বিচার। সেটাতো মাসুম নিজেও চায়। তাহলে সমস্যা কোথায়? যেটুক মনে দ্বিধা ছিল সবটুক ঝেড়ে ফেলে মিছিলে গলা মেলায় মাসুম। “নারায়ে তাকবীর- আল্লাহু আকবর…………………..”
দৃশ্যপট পাঁচ:
“আবির, জলদি আয় বাপ।” আম্মির চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে আবিরের। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত ব্লগ দেখেছে। সব বন্ধুদের শাহবাগ আন্দোলনের প্রতিরোধ মঞ্চে যোগ দেবার আহ্বান জানিয়েছে। এই দেশটাকে কিছুতেই পাকিস্তান হতে দেয়া যাবে না। এখনই প্রতিরোধ গড়তে হবে।
“আবির জলদি আয়। অ্যাম্বুলেন্স ডাক। শিশির, আমার শিশির…………..” আম্মি কথা শেষ করতে পারে না। অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেপে ওঠে আবিরের। শিশির ছাদ থেকে পরে গেছে। মাথা ফেটে গেছে। এখনই হাসপাতালে নিতে হবে। ছুটে বের হয়ে যায় আবির। না, রাস্তা পুরো ফাঁকা। একটা ট্যাক্সিও নেই। উত্তেজনায় ভুলে গিয়েছিল আবির, আজ হরতাল। যে হরতালের পক্ষে সারা রাত জেগে সে ক্যাম্পেইন করেছে।
পাড়ার রিকশাওয়ালা রমজান আলিকে বলে কয়ে রাজি করিয়ে হাসপাতালে রওনা হয়েছে আবির। শিশিরের মাথা ফেটে গেছে। প্রচুর রক্ত পরছে। মুল রাস্তায় রিক্সা নিয়ে নামতেই অনিক ছুটে এলো। রিক্সা থামিয়ে বলল,
– এই দিক দিয়ে যাওয়া যাবে না, আবির ভাই। শাহবাগি আর হেফাজতি দের মারামারি লাগছে। পুলিশ, হেফাজতি, আর শাহবাগিদের ত্রিমুখী সংঘর্ষ। কমপক্ষে ৫০ জনের গুলি লাগছে।
দৃশ্যপট ছয়:
মাসুমের পৃথিবীটা ঝাপসা হয়ে আসে। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নামে। ভেসে ওঠে আবির ভাইয়ের দৃঢ় মুখ। “আবির ভাই, তুমি বড় মিথ্যুক। তুমি বলেছিলে বাংলাদেশে নাস্তিক ব্লগারের সংখ্যা খুব বেশি হলে ১০ জন। এখানে এত ব্লগার কেন? সবাই কি নাস্তিক? এদের জড়ো করল কারা?”
দৃশ্যপট সাত:
– আমাকে যেতেই হবে। আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। আবির চিৎকার করে বলে।
– কি দরকার ভাই? তুমিই না বল, সব মুমিন মুসলমান বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। এরা মরলে দেশের জন্য ভাল। আজ হটাত আর এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠলে কেন?
– ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী না। আবির চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।
– তাইলে?
– “ও, ও আমার ভাই। আমার ভাই।”