সুন্দর একটা ফুল ফুটেছিল। তাই দেখে কোত্থেকে যেন একটা প্রজাপতি উড়ে এলো। বাহারি রং করা তার ডানা ফুলটাকে যেন আরো সুন্দর করে তুললো। ফুলগাছটার ঠিক পাশেই ছিল একটা বড় আম গাছ। সেই আম গাছের ঢালে বসে ঢুলছিল একটা কাক। সে হঠাৎ কা… কা… করে উঠলো।
প্রজাপতি জিজ্ঞেস করলো, ও কাক ভাই, কি হয়েছে? অমন চেঁচাচ্ছ কেন?
কাক উত্তর দেয়, কি বিচ্ছিরি ফুলটা, আর কি বিচ্ছিরি তোর গায়ের রঙ। আমরা চোখ খানাইতো নষ্ট করে দিলি।
– সেকি! সবাই তো বলে আমার ডানা খুব সুন্দর।
– সেতো শিল্পবোধের আকাল পড়েছে কিনা তাই।
– তাহলে তুমি বলছো তোমার খুব শিল্পবোধ আছে?
– আলবৎ আছে। শিল্পবোধ না থাকলে আমি শিল্পী হই কি করে?
– তুমি যে শিল্পী এইটা তুমি বুঝলে কি করে? কেউ কি তোমাকে বলেছে?
– সরাসরি বলেনি। তবে আমি বুঝে নিয়েছি।
– কিরকম?
– শিল্পীদের রুচি ঠিক আর সবার মতো হয়না। তাদের রুচি হয় ভিন্ন। তাদের আর সবার ভালো লাগেই বলে ফুল ভালো লাগেনা, তাদের আর সবার ভালো লাগে বলেই প্রজাপতি ভালো লাগেনা। এছাড়া আরও কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো আমার সাথে খুব যায়!
– যেমন?
– যেমন ধর, খামখেয়ালিপনা। হঠাৎ হঠাৎ উদাস হয়ে যাওয়া। কাজের কাজ ফেলে রেখে খামোখাই ঢুল খাওয়া। মানুষ হলে অবশ্য সিগারেটটাও মেন্ডাটরি ছিল। কিন্তু কাকের হাত নেই বলে সেটা বাদ।
সব শুনে প্রজাপতি মুখে বলে, আচ্ছা। মনে মনে ভাবে, কাকটা কি পাগল হয়ে গেলো?
কাকটা যেন প্রজাপতির মনের কথা বুঝতে পারে। সে বলে, পাগলের মতো কাণ্ড কারখানা করাও কিন্তু শিল্পীর আচরণের মধ্যে পড়ে।
প্রজাপতি চুপ করে কি যেন একটা ভাবে। তারপর বলে, আচ্ছা! তুমি যে একটা শিল্পীর সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বসে আছো, তা কোন শিল্প কি তৈরি করতে পেরেছো?
– না। আমার এই ছোট জীবনে একটা কাক-রাগীয় সংগীত বাদে আর তেমন কোন কিছুই তৈরি করিনি। তবে আমি চাইলেই পারি। চাইলেই গান বাদতে পারি যেটা কাকেন্দ্রনাথকে হার মানাতে পারে, চাইলেই কবিতা লিখতে পারি যেটা কাকানন্দকে হার মানাতে পারে।
– তবে লেখোনা কেন?
– লিখব। লিখব একটু সময় হোক! কাকবেল নামক পুরস্কার একটা আমার নামে লেখাই আছে বুঝলে? অবশ্য তুমি আর বুঝবে কি! তোমার নিজের ডানার ডিজাইনটাই তো বিচ্ছিরি! শিল্পের ছোয়া নেই বলতে!
কাকের কথা শুনে প্রজাপতি দুঃখ পায়, ফুলটা মূষরে পড়ে। কিন্তু কেউ কোন রা করেনা। ভাবে, সবাইতো আর এক নয়। কারো কারো কাছে ফুল কিংবা প্রজাপতির পাখা সুন্দর না ই লাগতে পারে। দিন যায়, মাস যায়। ফুলটা ঝড়ে পড়ে, ফুল গাছটাও বিলীন হয়ে যায়। প্রজাপতিটাকেও আজকাল আর চোখে পড়েনা। অবশ্য সেই আমগাছটার ঢালে বসে কাকটা এখনও দিব্বি ঢুল খায়। মাঝে মাঝে আনমনে কা… কা করে তার কাক-রাগীয় সঙ্গীত চর্চাও করে।
আমগাছটার পাশেই ছিল একটা প্রকাণ্ড মাঠ। বছরে একবার ধান হয়, বাকি সময়টা খালিই পড়ে থাকে। খালি মাঠের বুক চিড়ে এক সময় গজিয়ে উঠে নরম নরম কচি কচি সবুজ সবুজ ঘাস। কৃষকেরা তাদের গরু ছাগল চড়িয়ে দিয়ে যায় সেখানে। দুপুর অবধি মনের আনন্দে ঘাস খায় তারা। তারপর বিকেল অবধি বসে বসে জাবর কাটে। সন্ধ্যে হতে না হতেই বাড়ি ফেরার জন্য চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। গরু ডাকে, হাম্বা… হাম্বা…। ছাগল বলে, ম্যা… কিংবা… ব্যা……।
সেই আমগাছে বসে কাকটা শুনে। তার মন জুড়িয়ে যায়। ভাবে আহা, এতো মধুর গান কে গায়? একবার তো দেখে আসা উচিত।
একদিন দুপুরে কাক হাজির হয়ে যায় সে মাঠে। উড়ে গিয়ে বসে একটা গরুর পিঠে। গরু তখন আনমনে জীবন সংসার নিয়ে গভীর চিন্তা করতে করতে জাবর কাটছিল। কাকের আগমন সে টেরই পেলোনা।
কাক খানিকটা লাফালাফি দাপাদাপি করেও গরুর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারলোনা। শেষে ডাকলো, কা… কা… ও গরু ভাই।
গরু বলে, হাম্বা… কে রে তুই? অদৃশ্য থেকে কথা বলিস কেন?
– আমি অদৃশ্য না গরু ভাই। আমি তোমার পিঠে বসে।
– ও আচ্ছা। তাই তো বলি হঠাৎ পিঠটা এতো চুলকাচ্ছে কেন!
কাক এসেছিলো গরুর সাথে সঙ্গীত নিয়ে কথা বলতে। কিন্তু গরু তাঁকে চুলকানির কারণ বানিয়ে দেয়ায় সে যেন একটু অপমানবোধ করে। খানিকটা সময় গরুর পিঠেই তেমনি বসে থাকে। উদাস হয়ে কি যেন ভাবে। তারপর কাক রাগীয় সুরে একটা বেদনা বিধুর সুরে গান ধরে, কা… কা…কা কা কা…কা…………।
শুনে গরু বলে, হাম্বা হাম্বা। লা জওয়াব।
ছাগল বলে, ব্যা… চমৎকার!
কাক আনন্দে নেচে উঠে। ভাবে, এতোদিনে শিল্প চর্চার আসল মানুষ পাওয়া গেলো। সেই সন্ধ্যায় কাকের কা… কা… , গরুর হাম্বা… ছাগলের ব্যা ব্যা তে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠলো।
মাঠ বেড়িয়ে জঙ্গল, সেখানে একটা পাতার ফাকে কান চেপে বসেছিল সেই প্রজাপতিটা। কান চাপা অবস্থায়ও সে শুনতে পেলো গাছের উপর থেকে একটা বাদর বলছে, আহা! কি গাইছে। আমাদের দেশে এসব চলেনা বলে বেচারারা দাম পেলনা।