আজ ২রা এপ্রিল, বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। অটিজমে আক্রান্ত শিশু ও বয়স্কদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালে ২ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকে প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হচ্ছে। অটিজম বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই এই দিবস পালনের মূল লক্ষ্য। এ বছর বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্য- ‘সহায়ক প্রযুক্তির ব্যবহার, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির অধিকার।’
অটিজম একটি মানসিক বিকাশঘটিত সমস্যা যা স্নায়ু বা স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও পরিবর্ধন জনিত অস্বাভাবিকতার ফলে হয়। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে অসুবিধা হয়। অটিজমের কারণে কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি ও আচরণ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে আবার অনেকক্ষেত্রে শিশুর মানসিক ও ভাষার উপর দক্ষতা কম থাকে। সাধারনত ১৮ মাস থেকে ৩ বছর সময়ের মধ্যেই এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা যায়। অটিজমে আক্রান্ত একটি শিশুর কিছু আচরণগত সমস্যা লক্ষ্য করা যায়, যেমন- সে সামাজিকভাবে মেলামেশা করতে পারে না। শুধু কথা না বলা অটিজমের মধ্যে পড়ে না। তার সাথে তার অন্যান্য আচরণ, সামাজিকতা, অন্য একটি শিশুর সাথে অথবা বয়স্ক মানুষের সাথে মেশার বিষয়ে গণ্ডগোল থাকলে ধরে নিতে হবে শিশুটি অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে।
অটিজমে আক্রান্ত কোনো শিশু কথা বলতেও পারে আবার নাও বলতে পারে। আবার কথা বললেও হয়তো ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারে না। আবার একজন সুস্থ্য মানুষ যেভাবে কথা বলে সেভাবে নাও বলতে পারে। অর্থাৎ, সে হয়ত কথা বলতে পারে কিন্তু সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলতে পারে না। এক্ষেত্রেও শিশুটি অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে।
অটিজমের নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। পরিবেশগত ও বংশগত কারণেও এই রোগ হতে পারে। সাধারনত জটিলতা, লক্ষণ অথবা তীব্রতার উপর নির্ভর করে এর কারণগুলো বিভিন্ন হতে পারে। কি কি কারণে অটিজম হতে পারে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে সতর্ক হলে অটিজম প্রতিরোধ সম্ভব হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাইরাল ইনফেকশন, গর্ভকালীন জটিলতা এবং বায়ু দূষণকারী উপাদানসমূহ স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার হওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন জীনের কারণে অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার হতে পারে। আবার কোন কোন শিশুর ক্ষেত্রে জেনেটিক ডিজঅর্ডার যেমন- রেট সিন্ড্রোম বা ফ্র্যাজাইল এক্স সিন্ড্রোমের সাথে এই রোগটি হতে পারে। কিছু জীন মস্তিষ্কের কোষসমূহের পরিবহন ব্যবস্থায় বাধা প্রদান করে এবং রোগের তীব্রতা বৃদ্ধি করে। জেনেটিক বা জীনগত সমস্যা বংশগতও হতে পারে আবার নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই এই রোগটি হতে পারে। আমাদের অনেকেরই ধারণা অটিজম একটি বংশগত রোগ কিন্তু তা সম্পূর্ণরূপে ঠিক নয়। আবার অনেকের ধারণা সঠিক পরিচর্যার অভাবে শিশু অটিস্টিক হতে পারে, এই ধারণাও পুরোপুরি সঠিক নয়।
অটিজমের লক্ষনঃ
- অটিস্টিক শিশুদের ঘুম সম্পর্কিত কিছু সমস্যা থাকে। ঘুম স্বাভাবিক না হওয়ার কারনে তাদের মনোযোগ ও কাজের সক্ষমতা কমে যায় এবং আচার আচরণে সেটা পরিস্কার বোঝা যায়।
- অনেক শিশুর সঠিক সময়ে কথা বলতে সমস্যা হয়। মুলত ১৮ মাস থেকে ২ বছর সময়ের মধ্যে এটা বোঝা যায়।
- অনেক অটিস্টিক শিশুর মাঝে অল্প মাত্রায় হলেও বুদ্ধি প্রতিবন্ধীতা লক্ষ্য করা যায়।
- অনেক শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি সঠিকভাবে হয় না।
- অটিজমে আক্রান্ত অনেক শিশু দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ অথবা স্পর্শের প্রতি অতি সংবেদনশীল অথবা প্রতিক্রিয়াহীন থাকতে পারে।
- সাধারণত অটিস্টিক শিশুদের প্রতি চারজনে একজনের খিঁচুনি সমস্যা হতে পারে।
- অটিজম থাকা শিশুদের মানসিক অস্থিরতার ঝুঁকি বেশী থাকে। এসকল শিশুর বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা ও মনোযোগে ঘাটতিসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- অটিস্টিক শিশুদের প্রায়ই হজমের অসুবিধা, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটের গ্যাস, বমি ইত্যাদি হতে পারে।
কোনও শিশু অটিজমে আক্রান্ত মনে হলে অনতিবিলম্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় অটিজম নির্ণয় করতে পারলে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করলে অটিজম এর ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়াগুলো অনেক সফলভাবে মোকাবেলা করা যায়। শিশুর কি ধরনের অস্বাভাবিকতা আছে সেটা সঠিকভাবে নির্ণয় করে, নির্দিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে চিকিৎসা করলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে। নিবিড় ব্যবহারিক পরিচর্যা, স্কুল ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, সঠিক স্বাস্থ্য সেবা এবং প্রয়োজনে সঠিক ওষুধের ব্যবহার একটি শিশুর অটিজমের সমস্যা নিয়ন্ত্রনে আনতে অনেকখানি সহায়ক হয়। যথাযথ সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে অটিস্টিক শিশুদের সঠিক ভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে হবে।
অটিজমের যেহেতু কোনো নিরাময় নেই সেহেতু সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই এটাকে প্রতিরোধ করতে হবে। অটিজম প্রতিরোধে কয়েকটি ব্যাপার লক্ষ্য রাখতে হবে, যেমন- বেশি বেশি বাচ্চা না নেয়া, বাচ্চা নেয়ার আগে অবশ্যই বাচ্চার মা’কে রুবেলা ভ্যাকসিন দেয়া, গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনোপ্রকার ওষুধ না খাওয়া, বাচ্চার মায়ের ধূমপান কিংবা মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে বাচ্চা নেয়ার আগে অবশ্যই তা পরিত্যাগ করতে হবে, বাচ্চাকে অবশ্যই বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে গ্রামের চেয়ে শহরে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা বেশি। গ্রামে প্রতি ১০ হাজারে ১৪ জন বা প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৪ জন। শহর এলাকায় প্রতি ১০ হাজারে ২৫ শিশু যা প্রতি হাজারে ২ দশমিক ৫ জন অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। মেয়ে শিশুর চাইতে ছেলে শিশুর মধ্যে অটিজমে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আড়াই গুণ বেশি। দেশে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে অটিজম বিস্তারের হার প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন। সেই হিসাবে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৭ জন। গ্রামের চেয়ে শহরে অটিজম বৈশিষ্ট্য শিশুর সংখ্যা বেশি। প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ১৭ শিশু অটিজমে আক্রান্ত। ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) এর পরিচালিত গবেষণায় এ তথ্য জানা যায়। প্রথম বাচ্চা অটিস্টিক হলে দ্বিতীয় বাচ্চার অটিস্টিক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়। আবার যমজ বাচ্চার ক্ষেত্রে অটিস্টিক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশুদের জন্য মাত্র ২০ টি স্কুল আছে যার সবগুলোই ঢাকাতে অবস্থিত। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অটিস্টিক শিশুদের জন্য তেমন কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই।
অটিজম সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্ত শিশু ভুল রোগ নির্নয়ের শিকার হয়ে থাকে। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় না করেই অসুস্থ শিশুদের অ্যান্টি-সাইকোটিক জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়ে থাকে। সঠিক চিকিৎসা প্রয়োগ করলে সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা সম্ভব।