২৭ জানুয়ারি, ১৭৮২ সাল! চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়া থানার হায়দারপুর গ্রামে সৈয়দ মীর হাসান আলী ও
আবিদা রুকাইয়া খাতুন এর সংসারে সেদিন আলো হয়ে (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে) জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ মীর নিসার আলী; যাকে সবাই তিতুমীর নামেই চিনে। তাঁর তিতুমীর নাম হওয়ার পেছনের কারণটা বেশ চমকপ্রদ ছিলো। পাঁচ-ছয় বছর বয়সে মীর নিসার আলীর প্রচণ্ড জ্বর হয়। এই জ্বর সারানোর জন্য তাঁকে ঘুষড়া নামের ভীষণ তেতো ওষুধ খেতে দেয়া হয়। সেইসময় এই তেতো ওষুধটি অন্য ছেলে-মেয়েরা সহজে খেতে চাইতো না। অনেক পরিমাণ তেতো ছিলো সে ওষুধ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই ভয়ংকর তেতো ওষুধটি যখন মীর নিসার আলী নামের এই ছোট ছেলেটিকে দেয়া হলো তখন সে কোন রকম আপত্তি না করে চোখ-নাক কুঁচকানো ছাড়াই হাসিমুখে খেয়ে ফেললো। ছেলের এই কাণ্ডে বাবা-মাসহ পরিবারের সবাই খুব অবাক হলেন এবং নিসার আলীর ডাকনাম রাখলেন তেতো। তেতো থেকে পরবর্তীতে হলো তিতু। তার সঙ্গে মীর লাগিয়ে হয় তিতুমীর।
তিতুমীরের পড়াশুনার হাতেখড়ি ছিলো তাঁর বাবার কাছে। ১৭৮৬ সালে প্রথম তিনি পুঁথিগত পড়াশুনা শুরু করেন। হাতেখড়ির পর তিনি গ্রামের ওস্তাদের কাছে বাংলা, উর্দূ, আরবী, ফারসী ও ধারাপাত শেখেন। তারপর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন গ্রামের স্কুলে; এরপর গ্রামের মাদ্রাসায় তিনি দুই বছর শরিয়তী ও তরিকতী পড়াশুনা করার পর ১৭৯৮ সালে শিক্ষাবিদ হাফিজ নিয়ামত উল্লাহ’র সাথে বিহার শরীফে যান। ৬ মাস শিক্ষাসফর শেষে ওস্তাদ-সাগরেদ মিলে চাঁদপুরের হায়দারপুর গ্রামে ফিরে আসেন। পড়াশুনার
পাশাপাশি তিনি মুষ্টিযুদ্ধ, লাঠিখেলা, তীর ছোড়া ও অসি চালনা শেখেন। তখন যুবকরা আখড়া বা সংঘের আওতায় কুস্তি, কাবাডিসহ স্থানীয় নানা খেলাধুলা চর্চা করতো। সে সময় এইসকল শরীরচর্চামূলক খেলাধুলায় প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতা ছিলো সর্বত্র। যৌবনের সূচনালগ্নে তিতুমীর ছিলেন নাম করা কুস্তিগীর। ১৮০১ সালে ১৮ বছর বয়সে তিতুমীর কোরানে হাফেজ হন এবং হাদিস বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। সেইসাথে তিনি বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষা, দর্শন ও কাব্যশাস্ত্রে সমান দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি সময় সুযোগ পেলেই জ্ঞানার্জনের জন্য ঘুরে বেড়াতে যেতেন দূর-দূরান্তে। শিক্ষাজীবন শেষ করার পর পেশাগত জীবনে পা রাখলেন। পেশাগত জীবনে তিনি প্রথমে একজন কৃষক ছিলেন। তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রীর নাম- মায়মুনা সিদ্দিকা। মায়মুনা সিদ্দিকা ছিলেন শাহসুফী মুহাম্মদ আসমত উল্লাহর সিদ্দিকীর পৌত্রী এবং তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ সুফী মুহাম্মদ রহীমুল্লাহ সিদ্দিকীর আদরের কন্যা।
একটা সময়ে নিসার আলীর ভেতরের মানুষটি ক্রমাগত ছুটতে থাকে। ছুটতে থাকে দ্রুত গতিতে আলোর খোঁজে। এরপর তিনি ১৮২২ সালে যান মক্কায় হজ্জ করতে। তিনি সেখানে স্বাধীনতার অন্যতম পথপ্রদর্শক সৈয়দ আহমেদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও ওয়াহাবী মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। সেখান থেকে এসে ১৮২৭ সালে তিতুমীর তাঁর গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এবং তার অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে ‘তাহবান্দ’ নামে এক ধরনের কাপড় পরতে শুরু করেন। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কর্তৃক মুসলমানদের উপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত ‘দাড়ির খাজনা’ এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিতুমীর ও তার অনুসারীদের সঙ্গে স্থানীয় জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাকে। আগেই তিতুমীর পালোয়ান ও কুস্তিগীর হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং পূর্বে জমিদারের লাঠিয়াল হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি তার অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন। তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে এক সময় পাঁচ হাজারে গিয়ে পৌঁছায়। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়। তিতুমীরকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৩০ সালে ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে পাঠায়। কিন্তু আলেকজান্ডার যুদ্ধে পরাস্ত হয়। এরপর বাঘারেয়ার নীলকুঠি প্রাঙ্গণের এক যুদ্ধে নদীয়ার কালেক্টর এবং নদীয়া ও গোবর ডাঙ্গার জমিদারের সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিতুমীর জয়ী হন। তিতুমীর নিজেকে স্বাধীন বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করেন। ওই বছর জমিদার কৃষ্ণ দেব রায় পার্শ্ববর্তী সরফরাজপুরে শত শত লোক জড় করে শুক্রবার জুম্মার নামাজরত অবস্থায় মসজিদ ঘিরে ফেলে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই দিন দু’জন মৃত্যুবরণ করেন ও অসংখ্য যোদ্ধা আহত হন। তিতুমীর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন যে, ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে প্রয়োজন সমর প্রস্তুতি ও উপযুক্ত সেনা-প্রশিক্ষণ। সেনাবাহিনীর আত্নরক্ষার প্রয়োজনে তিনি একটি দূর্গ নির্মানের প্রয়োজনীতা গভীরভাবে অনুভব করেন। ১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসতের কাছে বাদুড়িয়ার ১০ কিলোমিটার দূরে নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তাঁরা বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন। বাঁশ এবং কাদা দিয়ে তারা দ্বি-স্তর বিশিষ্ট এই কেল্লা নির্মাণ করেন। ২৯ অক্টোবর কৃষ্ণ দেব নারকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে বহু লোক হতাহত করে। ৩০ অক্টোবর এ বিষয়ে মামলা দায়ের করতে গেলে কোনো ফল হয় না। ৬ নভেম্বর কৃষ্ণ দেব আবার নারকেলবাড়িয়ায় আক্রমণ করে। প্রচণ্ড সংঘর্ষে হতাহত হয় প্রচুর। এরপর গোবর ডাঙ্গার আটি নীলকুঠির ম্যানেজার মি. ডেভিস ৪০০ যোদ্ধা নিয়ে নারকেলবাড়িয়া আক্রমণ করলেন। শেষ পর্যন্ত মি. ডেভিস প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেলেন। ২-৩ দিন পর জমিদার দেবনাথ বাহিনী নিয়ে নারিকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে সংঘর্ষে প্রাণ হারান। আরও কয়েকটি সংঘর্ষের পর ১৩ নভেম্বর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্নেল স্টুয়ার্ডকে সেনাপতি করে একশত ঘোড়া, তিনশত পদাতিক সৈন্য ও দুটি কামানসহ নারকেলবাড়িয়ায় পাঠান। প্রচণ্ড সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অসংখ্য লোক হতাহত হয়। তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা দিলেন, “ভাই সব, একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার-জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে । আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।
১৪ নভেম্বর কর্নেল হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের আক্রমণ করে। তাদের সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তাঁর সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেন নি। ১৪শে নভেম্বর তিতুমীর ও তাঁর চল্লিশ জন সহচর শহীদ হন। ২৫০ জনেরও বেশি সৈন্যকে ইংরেজরা বন্দি করে। তাঁর বাহিনীর প্রধান মাসুম খাঁ বা গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। শহীদ তিতুমীরের মৃত্যুতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জন আরও একশ বছর পিছিয়ে যায়। কিন্তু এতে দমে যায়নি বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা বরং এই পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের বাসনা আরও তীব্রতর হয়। আরও শক্তিশালী আর সংগঠিত হয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে। তিতুমীরের বিদ্রোহ বাংলার আন্দোলন-সংগ্রাম বিশেষ করে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে একই তাৎপর্যপূর্ণ বিদ্রোহ। এর প্রকৃতি জটিল। ধর্ম এবং শোষকদের বিরুদ্ধে, ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা এতে ওতোপ্রোতভাব জড়িত। এ দুটো উপাদান বিচ্ছিন্ন করে একরৈখিকভাবে তিতুমীর ও তাঁর বিদ্রোহকে উপস্থাপন করলে তা হবে ইতিহাসের অপূর্ণ পাঠ। তিতুমীরের বীরত্বের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে বাংলাদেশের ঢাকায় একটি কলেজের নাম রাখা হয় তিতুমীর কলেজ। এছাড়াও বুয়েটে একটি হলের নামকরণও করা হয়েছে তিতুমীরের নামের স্মরণে। বীর তিতুমীর তার বীরত্বের জন্যই ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন।