যার মুখের ভাষা সুন্দর, তার জয় সর্বত্র। মানুষের একটি মূল্যবান সম্পদ হলো, মুখের মিষ্টি ভাষা। দাম্পত্য জীবনে এ গুণটির প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি। যে ব্যক্তি মিষ্টি করে, সুন্দর করে কথা বলতে পারে না; কর্কশ, তিক্ত ও ধারাল কথাই যার প্রধান হাতিয়ার, সে আর যাই হোক, সে যে দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে পারবে না, একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আমরা যদি আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাম্পত্য জীবনের দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাব, বিবিদের সাথে তিনি কত সুন্দর করে, কত মধু মিশিয়ে কথা বলতেন, কতটা হৃদয়বান ছিলেন তাদের প্রতি। এখানে উপমা হিসেবে একটি ঘটনা বলি।
হিজরী যষ্ঠ সাল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিয়ে করেন হযরত মায়মুনা রাযি.কে। একদা রাতের বেলা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেশাব করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তিনি হাজত পুরা করার জন্য চুপচাপ উঠে বাইরে চলে যান। যাওয়ার সময় স্ত্রীর যেন ঘুম না ভাঙ্গে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। একটু পর এমনিতেই হযরত মায়মুনা রাযি.-এর ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গার পর তিনি দেখেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিছানায় নেই। তিনি চিন্তিত হন। ভাবেন, হয়তো তিনি অন্য কোনো স্ত্রীর কামরায় চলে গেছেন। এই ভেবে তিনি ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেন। খানিক পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে আসেন এবং দরজায় নক করেন। বলেন– মায়মুনা! দরজা খোল। হযরত মায়মুনা রাযি. বলেন, দরজা খুলব না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কেন? জবাবে তিনি বললেন, আমাকে ছেড়ে অন্য স্ত্রীর ঘরে চলে গেছেন। আমি কেন দরজা খুলব? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আরে আল্লাহর বান্দী! আমি আল্লাহর নবী। আমি বিশ্বাসঘাতকতা করি না। একথা শুনতেই হযরত মায়মুনা রাযি. সচেতন হয়ে উঠেন। ভাবেন, সত্যিই তো! আল্লাহর নবী তো খেয়ানত করতে পারেন না। আমার ধারণা তো সম্পূর্ণ ভুল। তারপর তিনি সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেন। বন্ধুগণ! দরজা খোলার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাইলে তো জুতো খুলে পিটুনি শুরু করে দিতে পারতেন; চড়-থাপ্পর লাগাতে পারতেন; অন্তত দু’চারটি কড়া কথা বলতে পারতেন। বলতে পারেেতন, কত বড় বেয়াদব! বেতমীজ!! কী করে তোমার ধারণা হলো যে, আমি অন্য স্ত্রীর ঘরে চলে গেছি? ইত্যাদি আরো অনেক কিছুই তিনি বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি কোনটাই করেননি। কিছুই বলেননি। বরং ইষৎ মুচকি হেসে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছেন। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! এখানে চিন্তা করার বিষয় যে, এতবড় অপরাধ করার পরও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেন হযরত মায়মুনা রাযি.কে কিছুই বললেন না, কেন তাকে পেটালেন না? বরং চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে বিছানায় গিয়ে আস্তে করে শুয়ে পড়লেন? এর কারণ হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন, মায়মুনা রাযি. যা করেছেন, সেটা নারী জাতির স্বাভাবিক দুর্বলতা। সাধারণ স্বভাব। আর সাধারণ স্বভাব ও দুর্বলতাকে কেন্দ্র করে কাউকে শাস্তি দেওয়া বা কটু কথা বলা উত্তম চরিত্রের পরিপন্থি কাজ। তাই তিনি স্ত্রীকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। পরিচয় দিয়েছেন খুলুকে আজীম, তথা মহান চরিত্রের। সেই সাথে উম্মতের সকল স্বামীকে শিক্ষা দিয়েছেন, তোমরাও কিন্তু স্বাভাবিক দুর্বলতার কারণে স্ত্রীদেরকে শাসন করবে না। বরং আসল বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়ে তাদেরকে ক্ষমা করে দিবে। মুহতারাম পাঠক-পাঠিকা! এই হলো আমাদের চলার পথ। এই হলো আমাদের নববী আদর্শ। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আমরা কি এভাবে চলি, এরূপ করি? আমরা কি সর্বদা স্ত্রীর সাথে উত্তম চরিত্রের পরিচয় দেই? অথচ ঘরকে সুন্দর করতে হলে, সমাজকে সুন্দর করতে হলে স্বামীদের উচিত স্ত্রীদের ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া। শ্বশুর-শাশুড়ীর উচিত পুত্রবধূকে নিজের মেয়ে মনে করে সময় দেওয়া ও তাকে আপন করে নেওয়া। তখন হয়তো সে নিজেই সৌভাগ্য মনে করে স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ীর খেদমত করবে।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি কথা খুব দুঃখের সাথে বলতে হয়, আজকাল আমাদের সংসারে যখন কোনো মেয়ে বউ হয়ে আসে তখন আমরা তাকে কাজের মেয়ে বানিয়ে ফেলি। আমাদের সমাজে এমন মানুষ কমই আছে যারা পুত্রবধূকে নিজের মেয়ে মনে করতে পারে। বরং তিক্ত সত্য হলো, আমাদের সমাজে প্রতিযোগিতা হয়, কে নতুন বউকে কত নতুন কায়দায় আক্রান্ত করতে পারে। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ইসলাম তো আমাদের এমনটি শিক্ষা দেয়নি। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের হেফাযত করো। নসীব করো আদর্শ দাম্পত্য জীবন। তাওফীক দাও, স্বীয় পুত্রবধূকে আপন মেয়ে মনে করে তার সাথে সে অনুযায়ী আচার-ব্যবহার করার। আমীন। ইয়া রাব্বাল আলামিন। প্রিয় মা ও ভগ্নিগণ! সবশেষে আপনাদের কাছে আমার মিনতি, আপনারা যারা এখনো শাশুড়ী হননি, তারা আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করে নিন, আমি আমার আগত পুত্রবধূকে আপন কন্যার চাইতেও বেশি আদর করব। নিজের মেয়ের মতোই তার সাথে আচার-ব্যবহার করব। যাতে সে শ্বশুর বাড়িতে এসে মায়ের অভাব অনুভব করতে না পারে। কী! করবেন তো? আবারো দোয়া করি, আল্লাহ পাক আপনাদের তাওফীক দিন। আমীন। [সূত্র : বেহ্নূঁ ছে খেতাব]