Site icon খিচুড়ি

আখলাকে নববী

ইহুদিদের বড় পণ্ডিত যায়েদ ইবনে সুনা। একদা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছ থেকে কিছু গম খরিদ করতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি ছয় মাস পর গমের বিনিময়ে তোমাকে এই পরিমাণ খেজুর দিব, এর আগে নয়। পণ্ডিত তাতে সম্মত হয়। ইহুদি পণ্ডিত নির্ধারিত গম হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রদান করল। ওয়াদা করল, ছয় মাস পর এসে গমের বিনিময়ে খেজুর নিয়ে যাবে। এর একদিন আগেও নয়। কিন্তু কী আশ্চর্য! তিনদিন যেতে না যেতেই পণ্ডিত এসে হাজির। এসেই নবীজিকে বলল, আমার ঋণ পরিশোধ করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে পারতেন, ভাই! আমাদের এই লেনদেনের মেয়াদ তো ছয়মাসের। তুমি তো বলেছিলে, ছয় মাস পর এসে গমের বিনিময়ে খেজুর নিয়ে যাবে। অথচ তিনদিন যেতে না যেতেই পাওনা নিতে হাজির হয়ে গেলে? এটা কেমন কথা!! কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা না বলে, আইনের পথে না গিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে বললেন, ভাই! এখন তো আমার কাছে তোমাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই। সে বলল, এসব বুঝি না। এক্ষুণি আমার পাওনা পরিশোধ করুন। এবারও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নম্রভাবে কোমল কণ্ঠেই বললেন, ভাই! আমার কাছে কিছু থাকলে তো দিব। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বিতীয়বারও এটা বলেননি যে, ওরে কমবখত! ওরে নালায়েক!! তুমি ওয়াদা ভঙ্গ করেছ। চুক্তি অমান্য করেছ। কারণ চুক্তি ছিল, ছয় মাস পর এসে আমার কাছ থেকে তুমি পাওনা নিয়ে যাবে। অথচ তুমি তিন দিনের মাথায় এসে হাজির। নবীজি আইনের পথে না চলে খুলুকে আযীম তথা মহা চারিত্রিক গুণাবলীর পথ অনুসরণ করলেন। ভদ্রতার সাথে বললেন, ভাই আমার কাছে কিছুই নেই। ব্যবস্থা হলে দিব। ইহুদি এবার কঠোর আচরণ শুরু করল। সে বলল, ঋণ নিয়ে টালবাহানা করা, এ শুধু তোমারই নয়; তোমার পুরো বংশের অভ্যাস! ঋণ আদায়ের ব্যাপারে তোমার বংশের কেউ-ই আন্তরিক নয়!! যায়েদ ইবনে সুনা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ ধরনের আরো অনেক কটুকথা বলল। হযরত উমর রাযি. সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ইহুদির এহেন অশোভনীয় আচরণ দেখে তিনি রাগে ফেটে পড়ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি নিজেকে সামলাতে না পেরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন করে বসলেন। বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে অনুমতি দিন। আমি এই কাফেরের গর্দান উড়িয়ে দিই। আপনার সাথে এমন অসৌজন্যমূলক আচরণ কিছুতেই আমি বরদাশ্ত করতে পারছি না। বিস্ময়ের কথা হলো, আল্লাহর রাসূল ইহুদি পণ্ডিতের উপর রাগ না করে উল্টো হযরত উমর রাযি. এর প্রতি অসন্তুষ্টির ভাব প্রকাশ করলেন। বললেন, হে উমর! আমি কিছুতেই আশা করিনি যে, তুমি এমন কথা বলবে। আমি তো তোমার কাছে এ আশা করেছিলাম যে, তুমি আমাকে বোঝাবে। হে উমর! মানুষের পাওনা সঠিকভাবে পরিশোধ করার ব্যাপারে সত্যিই এ মুহূর্তে আমি তোমার নসিহতের প্রত্যাশী ছিলাম। কিন্তু আশ্চর্য! এটা না করে তুমি আমার পাওনাদারকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হয়ে গেলে! তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেওয়ার জন্য অনুমতি চাইতে লাগলে!! উমর! সে তো তার পাওনা চাইতে এসেছে। আর তুমি কিনা তাকে তার পাওনা চাইতে বারণ করছ! হযরত উমর রাযি. দারুণ লজ্জিত হলেন। বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তার কটুকথা সহ্য হচ্ছিল না, তাই বলেছি। আচ্ছা, আপনি আমাকে অনুমতি দিন, আমি তার সমুদয় পাওনা পরিশোধ করে দেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ঠিক আছে, আমি অনুমতি দিলাম। তবে গমের বিনিময়ে যতটুকু খেজুর সে পাবে, তার চেয়েও কিছু খেজুর বেশী দেবে। কেননা আমরা তাকে পেরেশান করেছি। কষ্ট দিয়েছি। সে তার পাওনা চাইতে এসেছে। কিন্তু আমরা সাথে সাথে তা পরিশোধ করিনি। হযরত উমর রাযি. ইহুদিকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। নির্ধারিত পাওনা মিটিয়ে অতিরিক্ত খেজুর দিয়ে তাকে খুশি করলেন। তারপর তার প্রতি গভীরভাবে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি ইহুদি পন্ডিত যায়েদ ইবনে সুনা? ইহুদি বলল, হ্যাঁ! হযরত উমর রাযি. বললেন, পণ্ডিতজী! আল্লাহর রাসূলের সাথে এহেন অশোভনীয় আচরণ করার কী প্রয়োজন ছিল? সে বলল, আমি ইচ্ছা করেই এমনটি করেছি। তুমি হয়তো প্রশ্ন করতে পার, কেন আমি এমন ইচ্ছা করলাম, তাই না? তবে শোন- এরূপ ইচ্ছা করার কারণ হলো, আমি তাওরাত কিতাবে আখেরী নবীর সকল নিদর্শন এবং স্বভাব-চরিত্র অধ্যায়ন করেছি এবং সবগুলোই পরীক্ষা করে দেখেছি। তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, তিনিই তাওরাতে বর্ণিত প্রতিশ্র“ত শেষ নবী। তবে তাঁর একটি গুণ সর্ম্পকে যাচাই করা বাকি ছিল। সেটি হলো তাঁর সামনে যে যত বেশী অসদাচরণ করবে তিনি ততবেশী দয়ার আচরণ করবেন। তাই আমি এ গুণটি পরীক্ষা করার জন্য ইচ্ছে করেই এমন আচরণ করেছি। আমি খোদার কসম করে বলছি, তিনিই তাওরাতে বর্ণিত প্রতিশ্র“ত শেষ নবী। আমি তাঁর সাথে সীমাহীন বেয়াদবি করেছি। কিন্তু তিনি আমার সাথে বিনম্র আচরণ করেছেন। প্রতিশোধগ্রহণমূলক কোনো আচরণই তিনি করেননি। আমার পরীক্ষা সফল হয়েছে। তাই আমি ঘোষণা দিচ্ছি–“আশহাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু”। অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই এবং আমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল। আমি মুসলমান হয়ে গেলাম ও আমার অঢেল সম্পদ ইসলামের জন্য ওয়াক্ফ করে দিলাম। প্রিয় পাঠক! কী সহনশীলতা ও র্ধৈয ছিল রাহমাতুললিল আলামীনের! অঙ্গিকার ও চুক্তি ভঙ্গকারীর সাথেও চূড়ান্ত সদাচার ও দয়ার আচরণ করেছেন। যে পরিমাণ ঋণ তার পাওনা ছিল তার চেয়ে বেশী প্রদান করেছেন। এরপরও কি কেউ বলবে ইসলাম তলোয়ারের জোরে ছড়িয়েছে? ইতিহাস সাক্ষী, ইসলাম তলোয়ারে নয় উদারতায় প্রসার লাভ করেছে। আক্ষেপের কথা আজকের মুসলমান নর-নারীরা সেই মহান চরিত্র ভুলতে শুরু করেছে। যার কারণে তারা আজ প্রতিনিয়ত লাঞ্চিত ও অপমানিত হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নবীজির চারিত্রিক সৌন্দর্য মজবুত করে আঁকড়ে ধরার তাওফীক দান করুন। আমীন।

Exit mobile version