সময়টা ছিল রাত সাড়ে ১১টা ৭ জানুয়ারি ২০২০, সৈয়দপুর রেলওয়ে জংশন, নীলফামারী।
রাত প্রায় মধ্য প্রহর। সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতালের সামনে বাড়ি থেকে পাঠানো রিক্সার আশায় আমার সন্ধানী চোখ নিয়ে চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছইলাম। শীতকালে উত্তরের এই শহরটিতে কুয়াশার মাত্রা একটু বেশিই থাকে এত রাতে বাড়ি থেকে পাঠানো রিক্সা সময় মত পাওয়া অনেকটা মুস্কিল। নেহায়েত মন্দ ভাগ্যে আজ আটকা পড়েছি। ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ছেলেটার আসতে আরও ৩০ মিনিট লাগবে। কয়দিন ধরে একটু বেশি ঠাণ্ডা পড়ছে। চাদরটা একটু ভাল করে মুড়িয়ে হাঁটা শুরু করলাম ১ নাম্বার ঘুণ্টির দিকে।
শীতের এই পুরোটা সময় জুড়েই এখানে বসে লন্দা বাজার( শীতের কাপড়ের দোকান) অনেক বড় ইস্তুপ থেকে ভাল কাপড় খুঁজে নিতে হয়। এ লাইনের দু’পাশে ফুটপাত বসেছে, রাত্রি বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের আলোগুলোও মৃদু থেকে মৃদুতর হয়ে আসছে। দু-একটা স্থানীয় ক্রেতা ছাড়া এখন আর তেমন ক্রেতার ভিড় ছিল না সেদিন। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তরা আর বিত্তবান সবাই এখানে বেশি ভিড় জমায়।
ইতিমধ্যে মনে হল কিছু একটার সাথে হেঁচট খেতে। “বাবাগো” বলে চেঁচিয়ে ওঠলো কেউ একজন। চমকে উঠলাম। পরক্ষণে দেখি, একটি পথ শিশু। প্রথমে অনেকটা বিরক্তির সাথে ধমক দিলাম
যেখানে সেখানে পঠটান দিয়ে ঘুমাওনোর জন্য। অনেকটা ভয়ও পেয়েছিলাম। গা হতে কি বিশ্রী গন্ধ আসছে! ইস; আর এ’কি….. সদ্য স্নান করে ওঠে এসেছিল মনে হচ্ছে।
ছেলেটি আমার উগ্র ধমকের ভয়ে বিহ্বল ছিল, প্রত্যুত্তর দেওয়ার সাহসটুকু মিয়য়ে গেছে।
আমি ততক্ষণে লক্ষ করলাম। খালি গা, পড়নে একমাত্র হাফ প্যান্ট যা ওর লজ্জাস্থান ঢেকে আছে। বিস্যতা খেয়াল করে আমিও তীব্র হেচট খেলাম ভিতরে ভিতরে। শার্টের ওপর ব্লেজার তার ওপর চাদর যা নীচ হতে ওপর অব্ধি আমার সমগ্র শরীর ঢাকা। তবুও এ রুক্ষ তীব্র শীত আমায় ব্যতিব্যস্ত করছে খুব করে! আর এ একরতি এই শিশুর দেহতে পড়ার মতো ও কোনো বস্ত্র নেই! হায়রে অদৃষ্ট, তুমি বড় নির্লজ্জ, বেহায়া, অবিবেচক। তোমার বিবেচনাবোধ কি আছে? নাকি গঙ্গাস্নানের স্নানকারীর মতো দেহের সব পঙ্কজের ন্যায় একেবারে ধুয়ে গেছে? এমন একের পর এক প্রশ্ন করছিলাম নিজেকে।
বালকটি ততোক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে উত্তরে বললো-
– দাদা, শোয়ার জায়গা নেই যে.
– তোর পরিবার নেই?
– জ্ঞান হওয়া অব্ধি নেই, এর আগে ছিল।
– পথেঘাটে থাকিস?
– তাছাড়া আর কই যামু।
– গায়ে কাপড় নেই কেনো?
– ছিল, আজ লাইনের ঐ পাড়ের ছেলেদের সাথে ঝগড়া করেছি। ছিঁড়ে গেছে একেবারে।
– খাস কি করে? ভিক্ষা করিস?
– না। টোকাইয়ের কাজ করি।
– যাবি আমার সাথে?
ছেলেটা এ কথা শুনে ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেলো।
স্মান হেসে শিশুটির জীর্ণ হাতটি ধরে বললাম,- চল, কিছু কিনে দেই।
লন্দা বাজারের দোকানগুলো তখনো বন্ধ হয় নাই, লাইনের দুধারের ফুতপাত এখনো জেগে আছে।
নিজ দারিয়ে থেকে ওর বদনে একটি শার্ট, লম্বা প্যান্ট আর একটি শীতবস্ত্র কিনে দিলাম। অবশিষ্ট টাকা দিয়ে আরও কয়েকটা শীতবস্ত্র কিনে নিলাম ( লন্দা বাজারে খুব বেশি টাকা লাগেনা)।
ততোক্ষণে রিক্সাওয়ালা ছেলেটি চলে আসছে।
রিক্সাওয়ালাসহ তিন জন মিলে পিঠা খেতে খেতে পরের দিন তার সাথে দেখা করার জন্য সময় এবং জায়গাটা জেনে নিলাম।
পরের দিন “শিক্ষানগরী সৈয়দপুর” নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েক জন মিলে দেখা করি ছেলেটির সাথে। গতরাতের ২ ঘণ্টায় নাম ছাড়া কিছুই জানা হয় নি।
নামঃ এমরান ইসলাম
বাবার নামঃ বলতে পারে না
মায়ের নামঃ সাহিদা (পরে জানতে পারে নিজের মা নয়)
থিকানাঃ সৈয়দপুর রেল কারখানার পুরাতন কামরা
বয়সঃ ৮ বছর হতে পারে
এখানে আসার গল্পটা অনেক করুন ছিল তার জন্য, দুই বছর আগে সাহিদা নামেই এক বিহারী মহিলাকে মা হিসেবে জানত সে, মহিলার স্বামী থাকত না তার সাথে, অর্থাৎ এমরান কখনো দেখে নাই। মহল্লার সবাই বলত সাহিদা তার আসল মা নয়, তাকে সাহিদা কুড়িয়ে এনেছে। এই কথার জন্য অনেক বার ঝগড়াও করতে দেখেছে মা কে। মায়ের কুঁড়ে ঘরে ভাল ছিল তার জীবন। কিন্তু হঠাৎ যেন চিহ্ন টা পুরো পুরি পালটে যায়। ১০ বছর পর ফিয়ে আসে সাহিদার স্বামী, জানতে চায় এমরান কার ছেলে, এবার আড়ালে মায়ের উত্তরটা ছিল কুঁড়ে পেয়েছি। এমরানের জন্মের এই সত্যতা নিয়ে একপর্যায়ে লোকটির আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পরে থাকতে দেখে সে। নিজের জীবন বাঁচাতে সেদিন যে ছুটে এসেছিল আর ফেরা হল নি। এর কারনেই তথাকতিত সেই বাবার নাম জানা হয়ে উঠে নি তার। এর পর থেকে শুরু হয় জীবন যুদ্ধ, বেঁচে থাকার লড়াই। আমরা সেদিন “শিক্ষানগরী সৈয়দপুর” এর পক্ষ থেকে ফুটপাতে বাদাম বিক্রি কারার মত কিছু সরঞ্জাম কিনে দিয়েছিলাম। জানিনা সেটাও টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কিনা তার পক্ষে, কারন আমাদের সমাজ তো অর্থনৈতিক বৈষম্যের দ্বারা নির্ধারণ করেই দিয়েছে কে কিভাবে জীবন পরিচালনা। করবে।
বিঃদ্র- অসহায় এর সহায় হোন, দেখবেন ঈশ্বর আপনার সহায় হবেন।