মন ছিল বিক্ষিপ্ত, বার বার মনে হচ্ছিল দুনিয়ার সংযোগ থেকে যদি ছুটি পাওয়া যেত, একটা মানুষের মুখও দেখব না, কিচ্ছু ভাবব না। কিন্তু এমন সুযোগ কই দায়িত্ব আর অপ্রতিরোধ্য মায়ার বাঁধন আমার ইচ্ছেকে আড়াল করে দাঁড়ায়।
আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে থাকা লতানো ডোর খুলে পথ যে দিকে টানছে ও দিকে যাওয়ার মত করে ছুট দিলাম থানচির দিকে। বান্দরবান থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে। টিকেট কেটে বিরতিহীন বাসে চড়লেও, এটা একটা বিরামের গাড়ি, কতক্ষণ চিম্বুক থামে তো কতক্ষণ শৈলপ্রপাত, ১০ মিনিট পর পর উঁচু উঁচু পাহাড় মন মত দেখার অবসর। বাস ভ্রমণটাও নয়ন জুড়ানো, কোমর ব্যথা হলেও চোখ জুড়িয়ে যাবে। পরিশ্রমী মারমা, সুন্দরী বম বাস জুড়ে সয়লাব। ৩০০/ ৪০০ বছর আগের আরাকান রাজ্যে হঠাৎ আমিও এক উৎপাত। বলি বাজারে শেষ যাত্রাবিরতিতে নিজেকে পর্যটকই মনে হল। ক্রেতা সব মারমা, বম, মুরং বা ত্রিপুরা দোকাদার বেশিরভাগ বাঙালি, ক’জন মাত্র অন্যান্য। পাশেই লাগানো বিজিবি ক্যাম্প। নিবন্ধন করে যেতে হয় থানচির দিকে ( আকাশটা ঢাকা থাকবে কেন, আমার পাখা উড়তে চাই) আমার এটা জানা ছিল না, পাড় চাটগাঁইয়া কথাবার্তায় কন্ডাকটরও পর্যটক হিসেবে গণ্য করল না।
সাঙ্গুর বাঁকে বসেছে থানচি বাজার। সেয়ানা দোকানদারেরা বসে আছেন দোয়ার খুলে। দূরত্বের অজুহাতে দামের হাটবাজার৷ এখানেও সব বাঙালি ভাইবেরাদার। বাঙলা ভাষা মেরেই ঠকায়। চলতি পথেই ঠিক করেছি সাঙ্গু নদী ধরে রেমাক্রী বাজার হয়ে নাফা-কুম যাব। ৩ টার পর রেমাক্রী বাজারের পথে বোটে করে পর্যটক যাওয়ার অনুমতি নেই, অভাগা এক গাইড পেয়ে গেল আমাকে ( পর্যটক নেয়া অপরিহার্য, বাঙালি রত্নগুলো সহিসালামত যেন মায়ের কোলে ফিরতে পারে তার জন্যই হয়ত)। সে কি ভাবে যেন লাইন করে নিল, বিজিবির লোক বলেন – যান যান ঘুরে আসুন। গাইড বিকাশ ত্রিপুরা আর বোট চালক এরিক মারমা স্লিম সাইজের এক নৌকায় আমাকে নিয়ে ছুটল। স্বচ্ছ জল টলমল করছে, দুপাশে সবুজ ঘন পাহাড়। কি দেখবেন আর দেখবেন না আগে থেকে ভেবে রাখুন নয়ত পাগল হয়ে যাবেন। পাহাড় দেখি তো জলের স্ফটিক তলার রূপ মিস হয়ে যাবে। কিছু দূর এগিয়ে অকার্যকর হয়ে গেল মোবাইল নেটওয়ার্ক। মনে মনে খুশি, নেটওয়ার্কে কি আসে যায়, কে আর খুঁজবে, অনেক মানুষেরই নেটওয়ার্ক আচমকা বন্ধ হয়ে যায়, আমি আর কি হনু! সাঙ্গুর রূপ ‘দোহাজারীর’ আশ পাশে অনেক দেখেছি, তবে এখানে তারুণ্যে ভরপুর এক সাঙ্গু ভেজা চুল মেলে বসে আছে রোদে শুকাতে। আপনি নিশ্চিত ভাবেই তার প্রেমে পড়বেন, সো দেহধারী কোন প্রেমিক সাথে নেবেন না, জেলাসে খুন হয়ে যাবেন। বিশাল সব পাথরের বাগান তিন্দু, তার পাশে আমি বেখাপ্পা বিন্দু। সবুজ পাথুরে জল পেরিয়ে ২ ঘন্টার তুমুল উত্তেজনার সমাপ্তি হল রেমাক্রী বাজারে। প্রাকৃতিক সিঁড়ি বেয়ে রেমাক্রী খালের পাহাড়ি জল নামছে ঝিরঝির করে, আমি অভিভূত, এমন দৃশ্য আগের জন্মেও দেখিনি হয়ত। মারমা সুন্দরীদের দোকানে দর কষাকষি করে কলা কিনতে দেখে, গাইড বিকাশ কি যেন বলল দোকানদারকে, আমি চিটাইংগা শব্দটা কেবল বুঝেছি। নিশ্চয়ই চিটাইংগা নিয়ে তারা নাখোশ। একটু খানি বসে রওনা দিলাম পাহাড়ি পাথুরে খাল রেমাক্রীর বাঁক ধরে। ২ ঘন্টার অধিক পথ হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছানো যাবে নাফা-কুম।
সাংগু নদী ধরে প্রায় ২২ কিলোমিটার পথ ২ ঘন্টার অধিক সময় বোট যাত্রা শেষে রেমাক্রী বাজারে পৌঁছালাম। সন্ধ্যা হয়ে গেল প্রায়, উদ্দেশ্যের পথ বহুদূর। রেমাক্রী সাংগুর সংযোগে প্রশস্ত এক জলপ্রপাত, ঝির ঝির করে জল ঝরছে। এ অনুভব নান্দনিক, আপনি ওখানে না দাঁড়ালে আমার শব্দের সাধ্য নেই সেটা বুঝিয়ে বলার। ব্যথায় ভুগছেন? হতাশায় মরে যাচ্ছেন? আপনার জন্যই এ অব্যর্থ মহাঔষধ। না কোন মহা স্বামী নেই এখানে; দু’কান, দুচোখ নিয়ে দাঁড়ালেই হবে। আপনি বিস্ময়ে দেখবেন বিস্মরণ হয়েছে অতীতের। বাঁচার তাগিদ জুড়ে আছে এ নির্মল জলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পতনে। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে যেন জল পড়ছে। নায়াগ্রা বা আগ্রা কোথাও যাবার সাধ্য নেই, এখানে দাঁড়িয়ে আমি কম আশ্চর্য হইনি। এত রূপের ডালি কত অবলীলায় দেখা হল! কোন নেটওয়ার্ক নেই, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার তোড়ায় কেয়ার করে রেমাক্রীর এই মোহনায় এসে ভাবুন জীবনকে অন্য ভাবে, গরিমায় ভরে যাবে জীবন পথ। কার জন্য কিসের জন্য ভেসে যাবেন, চলে আসুন চঞ্চল এ প্রকৃত জীবনে।
প্রতি পদে পদে গাইড আপনাকে বেচে খেলেও মাইন্ড করবেননা, তাদের উৎকোচ সামান্য।
ভেবেছিলাম ইউনিক পাহাড়ি খাবারে দোকান ঠাঁসা হবে, সে আশা গুড়েবালি,আছে তো সেই মেরী বিস্কুট, জোড়া ড্রাই কেক আর বন। মারমা সুন্দরীদের বলি – চম্পা কলা আছে? তারা মারমা ভাষায় প্রশ্ন করে গাইডকে, আমি চিটাইংগা কিনা।
চিটাইংগা সব নাকি চম্পা কলা খোঁজে। গাইডের তাড়া খেয়ে ছুটলাম রেমাক্রী খাল ধরে। পাথুরে স্বচ্ছ জলের খাল। দু’পাশের পাহাড় বুকে ধরে সবুজ হয়ে গেছে জল। এটা কোন রাস্তা নয়, সরু পাহাড়ের খাঁজ।মারমা, ত্রিপুরা এ পথ দিয়েই যায়। তারা বেশ চটপট পথ ডিঙিয়ে যাচ্ছে৷ গাইড বলল তাদের পেছন পেছন জোর কদমে হাঁটতে। ভয় না থাকলেও ভীতিকর একটা গ্রুপ নাকি আছে এখানে বহালতবিয়তে। আমরা পর্যটক, থাক ওসব নাটক। ছোট ছোট অসংখ্য ঝিরি পথ জুড়ে, আগামীকাল দেখার অভিপ্রায়ে এ পথ কেবল সামনের দিকে তাকিয়েই এগুতে হল।পথে অনেক ঝুপড়ি, নারীদেরই সওদাগরি। পাহাড়ি কুল, তেঁতুলের সাথে অন্যান্য প্যাকেটজাত খাদ্য পণ্য পাওয়া যায়। তাদের অনেককেই জিজ্ঞেস করেছিলাম – বাংলা না চিটাইংগা কোন ভাষায় বুঝতে সুবিধা বেশি, তারা বলে দুটোই নাকি একি,বরং বাংলাটা একটু ভাল পারে। রেমাক্রী বাজার বা আসার পথে পর্যটক ছাড়া কোন বাঙালি চোখেই পড়েনি। ভেতরের এসব নারীদের সমতলের বাঙালি নিয়ে ধারণা কম, পুরুষ যারা বাজারের দিকে যায় তাদের জানাশোনার পরিধি বড়। চাটগাঁইয়া, বাংলা দুটোতেই সাবলীল। আমার দরদাম করা দেখে মারমাদের অনেকেই আমার আইডেন্টিটি পেয়ে গেছে। অন্যান্য এলাকার লোকজন দরকষাকষি করেই না, এদের সাথে বেচা-কেনাতে লাভ বেশি। সব কিছুর দাম ডাবল, অবশ্য কারণও আছে, থানচি থেকে পণ্য আনে, প্রতি ৫ কেজিতে ৬০০ টাকা করে মজুরি দিতে হয়। আমি দর করেছি কেবল তাদের পাহাড়ি পণ্যে। পাহাড়ে উৎপাদিত কলা কিনতে গিয়ে, সকাল বেলা পরটার জন্য তরকারি নিতে গিয়ে বেশ দরদাম করেছি, প্রচন্ড বিরক্ত ছিল মারমা তরুণীরা, এরা খুব এগ্রেসিভ, পুরুষরা কেন জানি দ্রুত মেনে নিত, ঠান্ডা মাথার লোক।
আমি ত্রিপুরা পাড়াতে মাচাংএ আশ্রয় পেয়েছি, প্রতিজন থাকা ১৫০/-, ভাতের অর্ডার ও করেছি, ডিম আলু ভর্তা ১৩০/- মুরগি হলে ২০০/-। পাহাড়ি মুরগির গল্প শুনে এসেছিলাম, এককালে এখানে প্রচুর পাওয়াও যেত, পর্যটকের ব্যাপক চাহিদায় সেটাও প্রায় বিলুপ্ত, এখন মুরগী মানে ফার্মের।গাইড বিকাশ মাচাং মালিককে একটু তিরস্কার করল, কেন সে দেশি মুরগি না বলে ফার্ম বলল। ত্রিপুরা লোকজনও দেখি বাঙালির মত ধান্দাবাজ হয়ে গেছে। বোট ভাড়া থেকে শুরু করে সব জায়গায় সে সুযোগ নিয়েছে। আমি তাকে বোট ভাড়ার জন্য ধরেছি, ৩৫০০/- আসা যাওয়ার ভাড়া ৪০০০/ কেন নিল, সে বলে ওটাই রেট, আমি থানচি বাজারের পর্যটকদের জন্য ঝুলানো বিলবোর্ডের ছবি তুলে রেখেছিলাম, সেটা তাকে দেখালাম, তার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। কারো যাবার ইচ্ছে থাকলে বড় গ্রুপ করে যাবেন, ইয়াং দেখে গাইড নেবেন।
ত্রিপুরা পাড়াটা নতুন, নাপাকূম এ পর্যটক বাড়ার কারণে এখানে মাচাং ঘরের চাহিদা বেড়েছে। খুব বর্ষা হলে তখন পর্যটক কমে যায় যদিও।
প্রায় ৩ ঘন্টার মত হেঁটে কাহিল হলেও নাপাকূম পৌঁছাতেই মন ভরে গেল। পুরো সমুদ্র বুকে নিয়ে শব্দ করছে ঝর্ণাটা। নাপাকূমের দুপাশে দু গোষ্ঠী। মাচাং গুলোতে “নাপাকুং ত্রিপুরা পাড়ার” লোক, দোকানের নিয়ন্ত্রণে মারমা। এসব তথ্য দিয়েছে কারবারী বিজয় মানিক ত্রিপুরার ছেলে টমাস। ত্রিপুরারা স্বধর্মে নেই, খ্রিস্টান হয়ে গেছে।
রেমাক্রী খালের দু পাশে খাড়া পাহাড়, জলপ্রপাত দেখার সুবিধা করে দিয়েছে ঝুলন্ত ব্রিজটা। স্বচক্ষে দেখাটার আমেজ অতুলনীয়। রাত বাড়ছে তো জল পতনের শব্দও বাড়ছে। রেমাক্রী খাল খাড়া হতে হতে জলপ্রপাতের জন্ম দিয়েছে। বর্ষায় এর রূপ আমূল পাল্টে যায়, সে রূপ দেখতে পায় কেবল এ এলাকার অদিবাসীরাই। সারা বাংলাদেশের লোক আসে এখানে। অন্য এক গ্রুপের গাইড হিসেবে এসেছে জর্জ ত্রিপুরা, সে জানাল কিছুদিন আগে আমাদের ক্যাপ্টেন মাশরাফি এসেছিলেন তার সাথে। চারপাশে তাকালে কেন জানি বাংলাদেশ মনে হয়নি, যেন আচমকা এসে পড়েছি ৪০০/৫০০ বছর আগের কোন আারাকান গ্রামে। জাগতিক সকল যন্ত্রণা বাষ্প হয়ে যায় নিমিষেই। ধূমপান করিনা কখনো, কিন্তু এত আনন্দ সেলিব্রেট করতে সিগারেটে একটা ধরালাম। ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে ভাবি, দুনিয়ার এত রূপ রেখে কোন বেহেশতে পা বাড়াব বল! সব মায়ার পথ ছিন্ন করে তবুওতো ফিরতে হবে। জলপ্রপাতের জল গড়াতে গড়াতে রেমাক্রী হয়েছে, সেটাও নেমে গেল পাথরের ঝাঁক পেরিয়ে সাংগুতে, সাংগুওতো থেমে নেই, সেও অবারিত ছুটে জুটে গেছে বঙ্গোপসাগরে। কোন পথ কারো জন্য, কিছুর জন্য থেমে থাকেনা। যন্ত্রণার পাহাড়ও ঝর্ণার সুরে গতিময় হয়। বুকের বাম পাশটা খালি হলেও এখানে দাঁড়ান এসে, দু’পাশে পাহাড় মাঝখানে জলের অবারিত পতন, ঝিরিঝিরি শব্দের মাতম, বন পাখির ডাক, সবুজ জল আপনার মন ভরে দেবেই। জগতিক ছাইপাঁশ আড়াল করে প্রকৃতি আপনাকে বুকে তুলে নেবে।
গহীন রাত,পর্যটক চোখের তৃষ্ণা পেরিয়ে মনকে আনে ডেকে। ডাবল দামেও মারমা তরুণীর চোখের তেজে তাদের আকর্ষণ বাড়ে, তারা হাসে। মারমা তরুণীদের অবগুণ্ঠিত রহস্যের হাসি আমরা কেউ পাঠ করতে পারছিনা, নিকোটিন গলে যায়, রেমাক্রী বয়ে যায়, গহীন পাহাড়ি আঁধার পেরিয়ে আমিও ফিরি মাচাংএ। বিন্নি চালের মত জুমের চালের ভাত, সুঘ্রাণে মৌ মৌ করছিল মাচাং। পেট মন দুটোই ভরিয়ে জীবনের প্রথম মাচাং ঘুম দিলাম। ভাবা যায়! পাহাড়ের মাঝখানে, জলপ্রপাতের শব্দ কানে, ত্রিপুরা পাড়ার একটা মাচাংএ আপনি শুয়ে আছেন আর ভাবছেন নাগরিক কোন যন্ত্রণা বা কোন মানুষের মুখ, অথচ আপনার চারপাশে পড়ে আছে বিস্তৃত মুখর প্রকৃতি। আপনি আনন্দিত হবেন, সংকীর্ণ জানালাটা খুলে জীবনের প্রশস্ত দরজাটা খুঁজে পাবেন এখানে। নতুন দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগতম।
খুব সকালে উঠে পাহড়ি সিঁড়ি ভেঙে, ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে নেমে এলাম নাপাকূমের পাশে। বলে রাখি নাপা নাকি মাছের নাম, যদিও রেমাক্রীর জলে মাছই চোখে পড়েনি, আর কূম মানে কুয়া। চাটগাঁইয়া ভাষায় কূম মানে গভীর কিছু বা গভীরতা। পরটা আর আলু ভাজি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম, এটা অবশ্য পরটা বললে পরটার অপমান হবে। ভাজির দাম চাইল ত্রিশ টাকা, মারমা তরুণীর এক কথা, আমিও ছাড় দেয়ার মানুষ না, জানতাম মারমারা এক কথার মানুষ। বাংলা ভাষায় তার রাগ দেখানো কঠিন কাজ, যতটা পেরেছে মুখে বলেছে বাকিটা মুখ ভঙ্গিতে। শেষে উচ্ছয় মারমা ( ‘উ’ দিয়ে শুরু হয় মারমা বড় সন্তানের নাম, ‘থুয়’ হল একদম ছোট’র পদবি) যে কিনা মালিক, তার সুপারিশে দাম কমই রাখতে হল। গাইড বিকাশ এসে বলে – চিটাইংগা এলেই ঝামেলা একটা না একটা হয়।
মারমারা এখানে অনেক এগিয়ে আছে জীবনযাপনে, পোষাক দেখেই বুঝা যায় সেটা। তাই দাপটও আছে।
সকালটা এত সুন্দর সুনসান, হালকা কুয়াশার চাদর জুড়ে আছে রেমাক্রীর গায়ে। কাছাকাছি ঘেষে অনেক ছবি তুলেছি। কয়েকজন পর্যটক পেলাম যারা এর আগেও এসেছিল, তাদের মুখে শুনলাম দুর্ঘটনায় দুু’এক জনের মৃত্যুর খবর। রেমাক্রী ভরা বর্ষায় দুরন্ত হয়ে উঠে, তখন কাছে ঘেষলে বিপদ। বড় বড় পাথুরে গর্তে পড়লে আর নিস্তার নেই।
ত্রিপুরা গ্রামে মস্ত এক পাহাড়, উঠতে শুরু করলাম। চূড়ার কাছাকাছি পেলাম মানিক ত্রিপুরাকে, সে জুমের জায়গা পরিষ্কার করতে যাচ্ছে। সে ইপিজেড এ চাকরি করেছে বছর খানেক। ভাইএর মাচাং ঘরএর দায়িত্ব নিতে চলে এসেছে। দূর পাহাড়ে কোথায় কি আছে সে দেখাচ্ছে আঙুল তুলে – গাড়ির শব্দ শুনছেন দাদা? ওখানে রাস্তা হয়ে গেছে, গাছ কাটছে, কত গাছ যে দিনের মধ্যে কাটে হিসেব নেই, আর ও দিকের পাহাড়ে গেলে মাইর লাগায়, ওখানে আরা… আর্মি আছে।
পাহাড় থেকে নেমে দ্রুত রেমাক্রী বাজারের পথে নামলাম। বিকেল ৩ টায় লাস্ট বাস ছেড়ে যাবে। আমি আশা দেখছি না বাসের। মোবাইলের বাকি চার্জও প্রায় নিঃশেষ। রেমাক্রী এত রূপবতী যে দু’টো চোখে কুলচ্ছে না। মাঝে মাঝে পড়ে মারমা পাড়া, তাদের থামি পরনে পায়রা গুলো গোসলে নামে, আমি বখাটে হলেও ওখানে চোখ দিই না, আপনারাও দেবেন না, তারা মাইন্ড করে। আকাশ নেটওয়ার্কের কারণে তারা মোটেও আনকোরা নেই আর। আমাদের বুঝে খুব। অবুঝ বাঙালি নিয়ে মজাও করে মারমা ভাষায়, তাদের হাসি যাস্ট কাকতাড়ুয়ার মত দেখে গেছি। রেমাক্রীতে নৌকা চলে না, মাছও কম। পাথর আর পাথর। মরা পাহাড়ের দেহাংশ ধরে আছে হয়ত হাজার বছরের স্মৃতি। রেমাক্রী বাজারে পৌঁছে বসে গেলাম খেতে। মাছ আর তরকারি আছে। সাংগুর কি মাছ রাঁধল ভাবতে ভাবতে এল বাজারের চিরচেনা রুই মাছ। সাংগুর পশ্চিম পারেও অনেক কটেজ। রেমাক্রীর জলপ্রপাত ঘীরে চলছে বিকিকিনি। বিজিবির কিছু লোক হাঁটু জলে গোসল সারছে। আমিও নাইতে গেলাম। থাকুক একটু স্পর্শ জলের। বোটে একটু ঝামেলা হল, জল নেমে গেছে একটু, পাথরে ঠোকর খেতে খেতে সবুজ জল মেখে বড় পাথর, তিন্দু পেরিয়ে এলাম। নদী পথ বেশ সচল৷ মালামাল পরিবহন চলছে। এত কর্মযজ্ঞেও কোন বাঙালি চোখে পড়েনি। থানচি বাজারে পৌঁছুতেই বিকেল ৪ টা হয়ে গেল। বাসের উদ্দেশ্যে তবু ছুটে গেলাম, সাঙ্গু ব্রীজের উপর থেকে দেখি গোধূলির আলোতে সাঙ্গুর নীলচে সবুজ জল। বাস নেই, অগত্যা হোটেলে উঠলাম। প্রতিজন ২০০ টাকা। এ বাজারে গেল বছরে নাকি আগুন লেগেছিল। ত্রিশ চল্লিশটা দোকান পলকেই ছাই হয়ে গিয়েছিল। মাঝ রাতে আচমকা আগুন লাগল কিভাবে সেটা এখনো জানতে পারেনি। সন্দেহ করছে অবাঙালিদের কোন গোষ্ঠীকে। ব্যবসা ভাল চলে বলে তারা ক্ষতিটা সামলে উঠতে পেরেছে। পুরো বাজারে অবাঙালি দোকান দু’একটা কেবল। বাজারে ৪ জি নেটওয়ার্ক চলছে, চারপাশে প্রশাসনিক বিভিন্ন অফিস পুঞ্জীভূত, যেন একা থাকতে নেই।
সকাল বেলা কুয়াশার মধ্যে বাসে চড়ি। থানচি, সাঙ্গু, রেমাক্রী আর নাপাকূম আমাকে আবার টানছে। মাচাংএর বিন্নি চালের মৌতাতে আমি বেহুশের মত ঝিমুতে থাকি। রেমাক্রীর জলে আমি যেন নিজের ছায়াটা রেখে এসেছি, সাথে আর কারো মুখচ্ছবি হয়ত। আমি ফিরে যাব আবার শত বছর পিছে রেমাক্রীর বাঁকে। আরো উচ্ছল নাপাকূমের পাশে তাকে খুঁজে নেব আবার থামি পরনে। শিকারের দিনে আমি কেবল তার মুখ দেখেই পেয়ে যাব বাঁচার তাগিদ। বিদায় প্রিয়,আর জন্মে মনে রেখ।