২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারিতে মস্কোর এক ব্যস্ত রাস্তায় দিনে দুপুরে একজন মানুষের মাথায় গুলি লাগে। কিছুক্ষণ পরেই মারা যান তিনি। তার কাছে থাকা আইডি থেকে জানা যায় তিনি রাশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী মাফিয়াদের একজন DeD khasan. তিনিই যে রাশিয়ার একমাত্র মাফিয়া তা কিন্তু নয়। ৭৫ বছর বয়সী এই মাফিয়ার মতো আরো হাজারকয়েক মাফিয়া রাশিয়ার রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় প্রতিদিন। তাদের দেখতে ঠিক আমাদেরই মতো। তেমন কোনো তফাৎ নেই তাদের। এই মাফিয়ারা সেই রাশিয়ান সম্রাজ্যের দিনগুলো থেকেই রাশিয়ায় তাদের শাখা প্রশাখা বিস্তৃত করে চলেছে। এখন এর ডালপালা ছড়িয়েছে সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি কোণায়৷ লুইস ফ্রিহ নামের এক সাবেক এফবি আই ডিরেক্টরের মতে ২০১২ সালে রাশিয়ায় ৬ হাজারের মতো মাফিয়া গ্রুপ রয়েছে যাদের মধ্যে ২০০ টি গ্রুপ সারাবিশ্বে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এদের মধ্যে রয়েছে জেল খাটা আসামী থেকে শুরু করে দূর্নীতিবাজ সরকারী কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী।
এদের উচ্চ পর্যায়ে সুপ্রিম কোনো মাফিয়ার অনুপস্থিতি এবং নিম্নস্তরে সাজানো গোছানো কর্মপদ্ধতিই রাশিয়ান মাফিয়াদের অন্য সবার তুলনায় বেশি শক্তিশালী করেছে। এই নীতিতে এক গ্রুপের বিভিন্ন অংশের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদানের সম্ভাবনা কম রাখা হয়। যেন একজন ধরা পরলেও পুরো গ্রুপ সুরক্ষিত থাকে। এই গ্রুপ গুলোর প্রধান হিসেবে থাকেন pakhan নামের একজন। তার অধীনে ৪টি ক্রিমিনাল সেল থাকে। আর এদের মধ্যস্থতাকারীদের ডাকা হয় ব্রিগেডিয়ার বলে। pakhan ব্রিগেডিয়ারদের উপর নজর রাখার জন্য দুজন স্পাই নিযুক্ত করে দেন। স্পাই রা মূলত ব্রিগেডিয়াররা কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা বসকে জানায়। একই সাথে বিগ্রেডিয়াররা যেন বেশি ক্ষমতার মালিক হতে না পারে তাও নিশ্চিত করে। আর এই গ্রুপের শেষস্তরে থাকে তারা যারা মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত করে। এরা কিন্তু তাদের নেতাদের সম্পর্কে কিছু না জেনেই কাজগুলো করে। যেকোনো অপরাধের মূল পরিকল্পনা করে বস এবং উচ্চ পর্যায়ের লোকজন। এর ফলে সহজে এদের পরিকল্পনা বা মূল হোতা ধরা পরে না। Ded khasan ও কিন্তু অন্য এক গ্রুপের স্নাইপারের মাধ্যমে নিহত হন। কোনো আইনশৃঙখলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের হাতে নয়। আর তার মৃত্যুর পর আন্ডারওয়ার্ল্ডে যুদ্ধ যুদ্ধ রব শুরু হয়ে গিয়েছিল।
রাশিয়ার এই অর্গানাইজড ক্রাইম বা মাফিয়া চক্র মূলত ৪টি স্তম্ভের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। এই স্তম্ভ গুলোই মূলত এই মাফিয়াদের ক্ষমতার উৎস। প্রথম উৎসটি হল vory বা থিভস ইন ল।
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক নেতারা দ্বিতীয় জার নিকোলাসকে উৎখাত করার মাধ্যমে বলশেভিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে শুরু হয়ে যায় ব্যাপকমাত্রার গৃহযুদ্ধ। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ১৯২২ সালে ভ্লাদিমির লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করেন। দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্টিত হয়। অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকানা বাতিল হয়ে সব কিছুর মালিক হয় রাষ্ট্র। রাষ্ট্র মালিকানার নাম করে প্রকৃত মালিক হয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা। এতো ক্ষমতা এক সাথে পেয়েই তারা দূর্নীতির সাগরে ডুবে যায়। আর ফল ভুগতে হয় জনগণকে। ফলে চারদিকে খাদ্য বস্ত্রের সংকট দেখা দিতে থাকে। কমে যেতে থাকে জীবন যাত্রার মান। একদিকে যেমন মহাকাশ গবেষণায় বিপুল অর্থ খরচ হচ্ছিল অন্যদিকে বহিঃবিশ্বে তেলের দাম কমে গিয়েছিল। তেলই ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। জনগণ ভাবতে শুরু করে যেহুতু সম্পদের নির্দিষ্ট কোনো মালিক নেই সেহুতু সবাই এর মালিক। আর সবাই যদি এর মালিক হয় তাহলে সেখান থেকে কিছুটা জিনিস নিজের করে নেওয়া নিশ্চয় অপরাধ নয়। আর এভাবেই চুরির হার বাড়তে থাকে। স্ট্যালিনের সময়ে সরকার তাদের ধরে ধরে পুরতে থাকে গুলাগ নামক বিশেষ জেল বা লেবার ক্যাম্পে। শুধু যে অপরাধীদের রাখা হত এখানে তা কিন্তু নয় যারা সরকারের বিরোধিতা করত তাদের ও এখানেই রাখা হত৷ আর অর্থনীতির দূর্দশা দূর করার জন্য তাদের পশুর মতো খাটানো হত। একইধরণের কষ্টের সম্মুখীন হতে হতে তারা সংঘবদ্ধ হতে থাকে। দল গঠিত হয়। এদের বলা হত থিভস ইন ল বা vory v zakone। এই দলে যোগ দেওয়ার একটায় শর্ত আপনাকে অবশ্যই একবারের জন্য হলেও জেলে যেতে হবে। এদের ছিল নির্দিষ্ট নিয়ম নির্দিষ্ট পরিচয়। এরা একে অপরকে নিজের ভাইয়ের মতো মানত। কেউ এই নিয়ম ভঙ্গ করলে হত শাস্তি মিলত মৃত্যুদন্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্টালিন হিটলারের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে গেলে জেলে থাকা কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের আর্মিতে যোগ দেওয়ার বদলে মুক্তি দেওয়ার লোভ দেখায়। অনেকে এই লোভে পরে আর্মিতে যোগ ও দেয়। তারা অবশ্য থিভস ইন ল দের কাছে বিশ্বাসঘাতক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাদের নাম দেওয়া হয় suka. কিন্তু যুদ্ধের পর স্টালিন তাদের ধোঁকা দেয়। আর্মি থেকে ছাড়িয়ে এদের আবারো জেলে বন্দী করা হয়। এবার এই সুকারা জেলের গার্ডদের সাথে আঁতাত করে নতুন নতুন গ্রুপ তৈরি করে। ফলে জেলে জেলে শুরু হয় যুদ্ধ। গার্ডরাও এই যুদ্ধ এক প্রকার সমর্থনই করত কেননা এ পদ্ধতিতে আর যাই হোক অপরাধীদের সংখ্যা তো কমছিল। এদের শুরু কিন্তু আরো অনেক আগে সেই ১৭২০ সালে। এই থিভস ইন ল রা ১৮ টি নিয়ম মেনে চলত। এর মধ্যে নিজের পরিবার ত্যাগ থেকে শুরু করে অন্য থিভস ইন ল এর জন্য জীবন দিয়ে দেওয়া পর্যন্ত সবকিছুই অন্তর্ভূক্ত ছিল। এই নিয়ম অনুযায়ী এক চোর অন্য চোরকে বাঁচাতে অন্যের দোষ নিজের ঘাড়ে তুলে নিত নির্দ্বিধায়। এই নিয়মগুলোর মধ্যে অন্যতম হলঃ
১. তাদের কোনো নিজস্ব পরিবার থাকা যাবে না, না কোনো স্ত্রী না কোনো সন্তান। তবে বিয়ে করতে না পারলেও প্রেমিকা রাখায় কোনো সমস্যায় নেই।
২. নিজের বাবা মাকে ত্যাগ করতে হবে চিরতরে।
৩. কোনো অবস্থাতেই চুরি ছাড়া অন্য কাজ করা যাবে না। একমাত্র চুরির টাকা দিয়েই জীবন চালাতে হবে।
৪. অন্য চোরদের সবদিক দিয়েই সাহায্য করতে হবে।
৫. অন্য চোরদের সম্পর্কে যেকোনো তথ্য জীবন দিয়ে হলেও গোপন রাখতে হবে।
৬. কোনো চোর বিশ্বাসঘাতকতা করলে তাকে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে। এই বিচার কাজে সাহায্য করতে হবে প্রতিটি চোরকে। কোনো অবস্থাতেই এই শাস্তি কার্যকরে বাধা দেওয়া যাবে না।
৭. জুয়ার টাকা পরিশোধের টাকা না থাকলে কোনো অবস্থাতেই জুয়া খেলা যাবে না।
৮. অন্য চোরদের প্রতি করা প্রতিজ্ঞা অবশ্যই পালন করতে হবে।
৯. কোনো অবস্থাতেই কতৃপক্ষের সাথে সমঝোতা করা যাবে না।
যাইহোক ১৯৫৩ সালে গুলাগ থেকে প্রায় ৮ মিলিয়ন অপরাধীদের মুক্ত করা হয়। আর একই সাথে থিভস ইন ল দের কঠোর নিয়ম ও রহিত হয়ে যায়।
দ্বিতীয় স্তম্ভ হল nomenklatura এরা মূলত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ধনী ব্যবসায়ী এবং কমিউনিস্ট নেতারা। মোটাটাকা ঘুষ দিলে অবশ্য এদের কেনা কোনো বেপারই নয়।
তৃতীয় স্তম্ভটি রাশিয়ান মাফিয়াদের বৈচিত্র্যময় সদস্যগোষ্ঠী। আইরিশ বা জাপানিজ মাফিয়া গোষ্ঠীতে যোগ দিতে যেমন জাতি বা গোত্র দেখা হয় রাশিয়ান মাফিয়াদের বেলায় কিন্তু তেমনটা নেই। এজন্যই এতে রয়েছে নানা নৃগোষ্ঠী৷ এরা এই সংগঠনের সবচেয়ে নিষ্ঠুর অংশ টি গঠন করে।
চতুর্থ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভটি হল অথোরিটিস বা avtoriteti. এরাই মূলত মাফিয়া সম্রাজ্য পরিচালনা করে। এরা এমন একটি গ্রুপ যাদের ধরা বা চেনা খুবই কঠিন। অথচ সকল অপরাধের মাস্টারমাইন্ডই তারা।
রাশিয়ান মাফিয়ারা সর্বপ্রথম ১৯৭০এর দশকে বিশ্ববাসীর নজরে আসে। পটেটো ব্যাগ গ্যাং নামের একদল ধান্দাবাজ কম দামে সোনার তৈরি এন্টিক রুবল বিক্রির নাম করে ক্রেতাদের ব্যাগ ভর্তি আলু ধরিয়ে দেয়। আর হাতিয়ে নেয় হাজার হাজার টাকা।
সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন প্রায় ভাঙনের পর্যায়ে তখন এরা নানা রকম অপরাধের সাথে যুক্ত হতে থাকে। এসময় তারা রাশিয়ার অর্থনীতিতে নিজেদের ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলো আলাদা হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে এরা বিভিন্ন হোটেলে একত্রিত হতে থাকে দায়িত্ব ভাগাভাগি করার জন্য। তারা অপহরণ হত্যা থেকে শুরু করে ড্রাগ ট্রাফিকিং, মানব পাচার পর্যন্ত সবকিছুই করত। এসময় ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো আবারো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে৷ তাদের দরকার পরে প্রাইভেট আর্মি ও সিকিউরিটির। এ জায়গাগুলো খুব সহজেই মাফিয়াদের দখলে চলে আসে। যে যত নিষ্ঠুর তার কামাই ও তত বেশি। রাশিয়ায় গড়ে ওঠা নতুন পুঁজিবাদী গোষ্ঠী নিজেদের নিরাপত্তার জন্য হিডেন ক্যামেরা, বুলেট প্রুফ ভেস্ট থেকে শুরু করে বোম্ব সেন্সর পর্যন্ত কিনতে শুরু করে। এসময় এই ব্যবসায়ীদের প্রায় সবাইকেই কৃষা বা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে মাফিয়াদের কিনে নিত। মাফিয়ারা টাকার বিনিময়ে তাদের রক্ষা করত। এমনকি দূর্নীতিবাজ পুলিশরাও ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদা নিয়ে কাজ করে দিত। এসময় মাফিয়ারা কন্ট্রাক্ট কিলিং ও করতে শুরু করে।
এদিকে আমেরিকায় প্রবেশের নীতি শিথিল করার সু্যোগ নিয়ে আমেরিকায় ও প্রবেশ করে। আমেরিকায় এসে যে তাদের অপরাধ প্রবণতা কমে গেছে এমন কিন্তু না। তারা তাদের শাখা প্রশাখা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে। এফবি আই এর রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯৩ সালের আগস্টে আমেরিকায় রাশিয়ান মাফিয়াদের ১৫ টি গ্রুপ বিদ্যমান ছিল।
১৯৯৩ এর দিকে নর্দান ক্যালিফোর্নিয়ায় অটো থেফট গ্রুপ নামে একটি গ্রুপ সামনে আসে। এটি মূলত ইউক্রেইন এবং রাশিয়ার কর্মীদের নিয়ে গঠিত একটি গ্রুপ। এই দলের ছোটরা গাড়ি চুরি করে আনত৷ আর বড়রা গাড়ির বডি বদলিয়ে সেটি অন্য জায়গায় বিক্রি করে দিত। পরবর্তীতে এরা টেলিফোনের মাধ্যমে প্রতারণা, পতিতাবৃত্তি, এবং ড্রাগ ট্রাফিকিং এর সাথে জড়িয়ে পরে।
2009 সালের মধ্যে রাশিয়ান মাফিয়ারা প্রায় ৫০টি দেশে পৌঁছেছে। একই সাথে তাদের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখে।
বর্তমানে মস্কোতে প্রায় ১৫০টির মতো গ্রুপ থাকলেও ৬টি গ্রুপকেই প্রধান হিসেবে ধরা হয়। এগুলো হল তিনটি চেচেন গ্রুপ, ২টি স্ল্যাভানিয়ান গ্রুপ ও একটি টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি এসোসিয়েশন। এর মধ্যে সবচেয়ে নিষঠুর এবং ভয়ঙকর হল এই 21st century association.
১৯৯৯ সালে পুতিন ক্ষমতায় এলে মাফিয়ারা সরকারের সাথে একটি সমঝোতায় আসে। এর ফলে মাফিয়ারা ততক্ষণ তাদের কাজ চালাতে পারবে যতক্ষণ না তা রাষ্ট্রের কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। রাষ্ট্রের শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটানো মানেই অবধারিত মৃত্যু। এখানে সেখানে ছোট খাটো ধরপাকড় কিন্তু চলবেই। এই সহাবস্থানই চলে আসছে গত দুই দশক ধরে। এই সময়ে মাফিয়ারা ছড়িয়ে পড়েছে অনেক জায়গায়। কিছুদিন আগে এমনকি ভারতেও এদের উপস্থিতির কথা শোনা গেছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার কোনো উপায় ও নেই অবশ্য।