তারিখটি ছিল ৮ই অক্টোবর, ২০০৫। ২০০৬ বিশ্বকাপে যাওয়ার হিসাবটি ছিল খুব সহজ। আইভোরি কোস্ট যদি সুদানকে পরাজিত করতে পারে তবে প্রথমবারের মত সরাসারি বিশ্বকাপে । তবে হিসাব অন্য জায়গায় কিছু বাকিও ছিল। ক্যামেরুনকে হারতে বা ড্র করতে হবে মিশরের সাথে। এরকম এক সমীকরণ নিয়ে সুদানে গিয়েছিল দিদিয়ের দ্রগবার আইভোরি কোস্ট আর নাটকীয় এক ম্যাচে জয় লাভ করে বিশ্বকাপের টিকিট যেমন পেয়েছিল তেমনি নিজ দেশের গৃহযুদ্বেরও অবসান ঘটিয়েছিল।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ আইভোরি কোস্ট তখন গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। ২০০২সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে অনেক রক্ত ঝরলেও তা থামার নাম নেই। গৃহযুদ্ধ দেশটির ভৌগলিক চেহারা দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে। রাষ্ট্রপতি লঁরা গাগবোর সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে দেশটির দক্ষিণ অংশ আর বিদ্রোহীদের দখলে রয়েছে দেশটির উত্তর অংশ। কোন পক্ষই কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। হত্যা আর আরাজকতা পুরো দেশকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল।
ইউরোপের লিগগুলোতে আফ্রিকান খেলোয়াড়দের কদর অনেক। ইউরোপের প্রতিটি লিগেই আফ্রিকার অনেক খেলোয়াড় উচ্চবেতনে ফুটবল খেলে থাকে। আফ্রিকার মানচিত্রে আইভোরি কোস্ট তখন দুই ভাগে বিভক্ত হলেও দেশটির অনেক খেলোয়াড়ই আইভোরিয়ান পরিচয়ে ইউরোপের বিভিন্ন লিগে খেলছে। দিদিয়ের দ্রগবা, কালু তোরে, ইমানুয়ের আবুয়ে, দিদিয়ে জোকরার মত খেলোয়াড়েরা প্রিমিয়ার লিগ মাতিয়ে বেড়াচ্ছে। ইয়া ইয়া তোরে তখন উদীয়মান তারকা। তাদের সমন্বয়ে গঠিত দল বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচ খেলতে উড়ে গেল সুদানে।
ক্যামেরুনের বিপক্ষে মিশরের আর আইভোরি কোস্টের বিপক্ষে সুদানের ম্যাচটি একটি সময়ে শুরু হলো। ক্যামেরুনের ম্যাচটি হচ্ছিল নিজ দেশের রাজধানী ইয়ন্ডি আর আইভোরিকোস্টের ম্যাচটি হচ্ছিল সুদানের ওম্বারডানে। দ্রগবাদের দল হেসেখেলেই সুদানকে পরাজিত করলো। ৩-১ গোলে ম্যাচ শেষ হওয়ার পর আইভোরিয়ানরা তাকিয়ে ছিল ক্যামেরুনের ম্যাচের দিকে। সেই ম্যাচে নাটক জমে উঠেছে।
ক্যামেরুন ২০ মিনিটে ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। তবে ৭৯ মিনিটে ম্যাচে সমতায় ফেরে মিশর। ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ের ৪ মিনিটে পেনাল্টি পায় ক্যামেরুন। কিন্তু পেনাল্টি স্পট থেকে গোল করতে ব্যার্থ হন ক্যামেরুনের ফুটবলার পিয়েরি ওহ।পিয়েরির পেনাল্টি মিসে কপাল খুলে যায় আইভোরি কোস্টের । প্র্রথমবারের মত বিশ্বের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ ফুটবলে যাওয়ার টিকিট পেয়ে যান দ্রগবারা।
বিশ্বকাপে যাওয়ার আনন্দ যখন বাঁধ ভাংগা উচ্ছাসে রুপ নিয়েছে তখন ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের নিয়ে মাইক্রোফোন হাতে এগিয়ে এলেন দিদিয়ের দ্রগবা। চেলসি স্ট্রাইকার দ্রগবা আইভোরিকোষ্টের সরকার ও বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন-
” আফ্রিকার জনগণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ।আজকে আমরা প্রমাণ করেছি যে, আইভোরিয়ানরা একসাথে বসবাস করতে পারে। একটি উদ্দেশ্য সাধনে তারা একসাথে কাজ করতে পারে। বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে সেটি আমরা করে দেখিয়েছি।
আমরা প্রতিজ্ঞা করছি যে, এই উদযাপন আমাদের আরও একত্রিত করবে। আমরা হাঁটু গেড়ে আপনাদের অনুরোধ করছি যে, আফ্রিকার একটি দেশ যেখানে অনেক ধনী-গরীব বসবাস করে সেটা যুদ্বের মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে না। দয়া করে আপনাদের অস্ত্র সমর্পণ করুন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিন।
আমরা আনন্দ চাই, তাই অস্ত্র ছেড়ে দিন “- এই ঘোষণা দিয়ে দ্রগবা, কালুতোরেরা কাঁধে কাঁধ রেখে আনন্দে নাচতে থাকলো।
দ্রগবার এই ভাষণ বিদ্যুৎগতিতে সারা আইভোরি কোস্টে ছড়িয়ে পড়লো। দেশটির টেলিভিশন ও রেডিওতে এই ভিডিও বারবার প্রচার হতে থাকলো। দেশটির সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে নাটকীয় পরিবর্তন দেখা গেল। অবশেষে দুই পক্ষই আলোচনার টেবিলে বসতে সম্মত হলো এবং অস্ত্রবিরতি ঘোষনা করলো। কোন প্রকার সহিংসতা ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ।
পরের বছর দেশটিতে আরও নাটকীয় এক ঘটনা ঘটে গেল। মাদাগাস্কারের সাথে আইভোরিকোস্টের হোম ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত হলো বিদ্রোহীদের একসময়ের রাজধানী বাওয়াকুতে। যেখানো দুই বছর আগে ফুটবল খেলা দূরের কথা স্বাভাবিক জীবনও কল্পনা করা যেত না। দ্রগবার একক সিদ্ধান্তকে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মাধ্যমে বাওয়াকুতে ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলো। যেখানে দলটি ৫-০ গোলে পরাজিত করে মাদাগাস্কারকে। আইভো কোস্টের হয়ে পঞ্চম গোলটি করেন দ্রগবা। ম্যাচ শেষে দ্রগবার আহ্ববানে বাকী বিদ্রোহীরাও অস্ত্র সমর্পণ করে। ফুটবল রক্ষা করেছিল একটি দেশ,একটি জাতিকে।