১৮২৫ সালের এক শীতের সকাল। আগ্রার একটি ছোট্ট গ্রামের প্রান্তে অবস্থিত একটি কুঁড়েঘর। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে মৃদু কণ্ঠস্বর। রামচন্দ্র তার স্ত্রী লক্ষ্মীর সাথে কথা বলছিল। “আমি আজ বেরিয়ে পড়ছি। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ফিরে আসব।”
লক্ষ্মী জানত, এই যাত্রা সাধারণ নয়। সে তার স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “সাবধানে থেকো। মা কালীর আশীর্বাদ তোমার সঙ্গে থাকুক।”
রামচন্দ্র বের হয়ে এল ঘর থেকে। তার হাতে একটি ছোট্ট পুঁটলি, যার মধ্যে লুকানো রয়েছে একটি হলুদ রঙের রুমাল। এই নির্দোষ দেখতে রুমালই ছিল তার জীবিকার প্রধান উপকরণ। রামচন্দ্র ছিল একজন ঠগী – একজন পেশাদার খুনি যে রুমাল দিয়ে মানুষ হত্যা করত।
গ্রামের বাইরে একটি বটগাছের নিচে অপেক্ষা করছিল তার দল। পাঁচজন লোক, প্রত্যেকেই দক্ষ ঠগী। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক ছিল হরিলাল, যিনি এই দলের নেতা।
হরিলাল রামচন্দ্রকে দেখে বলল, “এসো, আমরা রওনা দিই। আজ শুভদিন, মা কালী আমাদের সহায় হবেন।”
দলটি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল উত্তরের দিকে। তাদের লক্ষ্য ছিল দিল্লী যাওয়ার পথে থাকা একটি ব্যস্ত ব্যবসায়িক রুট। সেখানে তারা শিকার খুঁজবে – ধনী ব্যবসায়ী যারা একা বা ছোট দলে ভ্রমণ করে।
পথে চলতে চলতে হরিলাল তার দলের সদস্যদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। “মনে রেখো, আমরা সাধারণ পথিক। কারো সন্দেহ জাগানো চলবে না। রামচন্দ্র, তুমি হবে আমাদের ‘সোথার’ – শিকারের সাথে বন্ধুত্ব করবে।”
রামচন্দ্র মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সে জানত, তার ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। শিকারের বিশ্বাস অর্জন করাই ছিল তাদের সফলতার চাবিকাঠি।
তিনদিন পর, তারা পৌঁছাল একটি ছোট শহরে। সেখানে একটি সরাইখানায় আশ্রয় নিল। সন্ধ্যায় হরিলাল দলের সবাইকে ডেকে নিয়ে গেলেন শহরের প্রান্তে একটি নির্জন জায়গায়। সেখানে তিনি একটি গর্ত খুঁড়লেন এবং সেই গর্তের উপর রাখলেন তাদের পবিত্র কোদাল।
হরিলাল ধীরে ধীরে বললেন, “হে মা কালী, আমাদের পথ দেখাও। আমরা তোমার সন্তান, তোমার আশীর্বাদ চাই।”
সবাই নীরবে প্রার্থনা করল। তারপর হরিলাল কোদালটি তুলে নিলেন। “কোদাল উত্তর দিকে ইঙ্গিত করছে। আগামীকাল আমরা সেই দিকেই যাব।”
পরের দিন সকালে, তারা আবার রওনা দিল। কিছুদূর যেতে না যেতেই তাদের নজরে পড়ল একটি ছোট কাফেলা – দুজন ধনী ব্যবসায়ী এবং তাদের দুজন রক্ষী।
হরিলাল ইশারा করলেন। রামচন্দ্র এগিয়ে গেল ব্যবসায়ীদের দিকে। “নমস্কার মহাশয়, আপনারা কি দিল্লীর দিকে যাচ্ছেন?”
একজন ব্যবসায়ী উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, আমরা দিল্লী যাচ্ছি। আপনিও কি সেদিকে যাচ্ছেন?”
রামচন্দ্র হাসি মুখে বলল, “হ্যাঁ, আমরা একই পথে যাচ্ছি। আপনাদের সঙ্গে যাওয়া যায় কি? একসঙ্গে যাত্রা করলে নিরাপদ হবে।”
ব্যবসায়ীরা রাজি হয়ে গেল। এভাবেই শুরু হল তাদের একসঙ্গে যাত্রা। পথে চলতে চলতে রামচন্দ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। সে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে লাগল।
তিনদিন পর, তারা পৌঁছাল একটি ঘন জঙ্গলের কাছে। হরিলাল প্রস্তাব দিলেন, “চলুন, আমরা এখানে একটু বিশ্রাম নিই। এরপর আবার যাত্রা শুরু করব।”
সবাই রাজি হল। তারা জঙ্গলের ভেতরে একটি নির্জন জায়গায় বসল। রামচন্দ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গল্প করতে লাগল। হঠাৎ সে বলল, “তামাকু লাও।”
এই ছিল সংকেত। মুহূর্তের মধ্যে ঠগীরা তাদের রুমাল বের করল। ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারার আগেই তাদের গলায় রুমালের ফাঁস পড়ে গেল। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সব শেষ হয়ে গেল।
হরিলাল তাড়াতাড়ি নির্দেশ দিলেন, “শীঘ্র, কবর খোঁড়। আমরা বেশিক্ষণ এখানে থাকতে পারব না।”
রামচন্দ্র এবং অন্যরা দ্রুত কাজে লেগে গেল। তারা গর্ত খুঁড়ল, মৃতদেহগুলো সেখানে রাখল এবং মাটি চাপা দিল। তারপর সব লুটের মাল নিয়ে তারা দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়ল।
পরের দিন সকালে, তারা পৌঁছাল একটি নির্জন মন্দিরে। সেখানে হরিলাল লুটের মাল ভাগ করলেন। “এই নাও, এটা তোমাদের প্রাপ্য অংশ। বাকিটা মা কালীর জন্য।”
রামচন্দ্র তার অংশ নিয়ে ভাবল, এবার সে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু হরিলাল বললেন, “আমরা এখনও শেষ করিনি। আরও একটা শিকার করব।”
রামচন্দ্র চুপ করে রইল। সে জানত, এই পথ থেকে ফেরার উপায় নেই। একবার ঠগী, সর্বদা ঠগী।
এভাবেই চলতে থাকল তাদের যাত্রা। প্রতিটি হত্যার পর রামচন্দ্র অনুভব করত একটা অদৃশ্য বোঝা তার মনের উপর চেপে বসছে। কিন্তু সে জানত, এটাই তার নিয়তি। মা কালীর নামে, রুমালের ফাঁসে, সে আরও কত প্রাণ নেবে কে জানে।
মাসখানেক পর, যখন তারা আগ্রায় ফিরে এল, রামচন্দ্র দেখল তার ছেলে বড় হয়েছে। সে ভাবল, একদিন হয়তো তাকেও এই পথে আসতে হবে। কিন্তু সেদিন যেন দূরে থাকে – এই প্রার্থনা করল সে মনে মনে।
ঘরে ঢুকতেই লক্ষ্মী এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। রামচন্দ্র জানত, তার স্ত্রী কখনোই জিজ্ঞেস করবে না সে কোথায় গিয়েছিল, কী করেছিল। কিন্তু তার চোখে চোখ রাখতে পারল না রামচন্দ্র। কারণ সে জানত, তার হাতে লেগে আছে নিরীহ মানুষের রক্ত – যা কোনোদিনই ধুয়ে মুছে যাবে না।
রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ল, রামচন্দ্র বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছিল, কিন্তু তার আলো তাকে শান্তি দিতে ব্যর্থ। তার মনে হচ্ছিল, চাঁদের আলোয় যেন মা কালী নিজেই তার দিকে তাকিয়ে আছেন, রক্তপিপাসু এক দৃষ্টিতে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই বাতাসে একটা মৃদু ফিসফিসানি শোনা গেল। যেন কেউ তাকে ডাকছে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখল, কিন্তু কেউ ছিল না। তবুও সেই ফিসফিসানি থামল না, বরং আরও তীব্র হয়ে উঠল।
রামচন্দ্রের মনে পড়ল হরিলালের কথা – “একবার ঠগী, সর্বদা ঠগী। এই পথ থেকে ফেরা যায় না।” সেই কথাগুলো যেন তার মনের মধ্যে ক্রমাগত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। তার চোখে ভেসে উঠল সেই নিরীহ ব্যবসায়ীদের ভীত সন্ত্রস্ত মুখ, যখন তাদের গলায় রুমাল পরানো হয়েছিল।
হঠাৎ, দূর থেকে একটা চিৎকার শোনা গেল। রামচন্দ্র সজাগ হয়ে উঠল। সেই চিৎকার ছিল যেন তার শিকারদের আত্মার। তার বুকের ভেতর কেমন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। সেই মুহূর্তে সে বুঝল, যতবারই সে ঘরে ফিরুক, যতবারই সে স্বাভাবিক জীবন কাটানোর চেষ্টা করুক, মা কালী তাকে ছাড়বেন না। তার শিকারের আত্মারা তাকে চিরকাল তাড়া করবে।
রামচন্দ্রের পা দুটো কাঁপতে শুরু করল। সে হঠাৎ লক্ষ করল, তার হাতে সেই হলুদ রুমালটা ধরা রয়েছে, যেটা দিয়ে সে শিকারদের হত্যা করত। কিন্তু কবে যে সে সেটা হাতে নিয়েছে, সেটা তার খেয়াল ছিল না। তার মনে হল, এই রুমালটাও যেন তাকে তাড়া করছে, তার অতীতের প্রতীক হিসেবে। সে যতবারই নিজেকে এই জীবন থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করুক, রুমালটা যেন তাকে ক্রমাগত এই অন্ধকারে টেনে নিচ্ছে।
সে সিদ্ধান্ত নিল – এই বোঝা আর সহ্য করা সম্ভব নয়। রামচন্দ্র কুঁড়েঘরের পেছনের জঙ্গলে চলে গেল, যেখানে বড় এক বটগাছ দাঁড়িয়ে ছিল। সেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রামচন্দ্র মাটি খুঁড়ে রুমালটাকে পুঁতে ফেলল, যেন সে তার পাপগুলোকে মাটির নিচে ঢেকে দিতে পারবে। কিন্তু যখন সে দাঁড়িয়ে গাছটির দিকে তাকাল, মনে হল যেন গাছটি তার দিকে তাকিয়ে ঠাট্টা করছে। মাটি কিছুই ঢাকতে পারেনি, কারণ রামচন্দ্রের মনের মধ্যে সেই রক্তাক্ত অধ্যায় চিরকাল জীবিত থাকবে।
অন্ধকার রাতে, যখন শূন্যতার মাঝে শুধু তার নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল, রামচন্দ্র হঠাৎ উপলব্ধি করল—কোনো পালানোর পথ নেই। রুমাল পুঁতে ফেলার পরও, মা কালী তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন, সেই অমোঘ হাসি নিয়ে।