গভীর বনের প্রান্তে, যেখানে মানুষের পদচারণা বিরল, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে অমরার কুটির। প্রাচীন মহীরুহগুলো যেন প্রহরীর মতো ঘিরে রেখেছে এই রহস্যময় আবাসটিকে। কুটিরের চারপাশে ছড়ানো রয়েছে এমন সব গাছ-গাছালি, যার নাম জানে না কোন উদ্ভিদবিদ। কিছু ফুলের পাপড়িতে যেন জ্বলজ্বল করে আলো, আবার কিছু পাতার রং বদলায় চাঁদের আলোয়।
বাইরে থেকে দেখলে কুটিরটি মনে হয় সাধারণ এক কাঠের বাড়ি। ছাউনি দেওয়া খড়ের চাল, দেয়ালে লতাপাতার আবরণ। কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করলেই যে কেউ থমকে দাঁড়াবে বিস্ময়ে। দেয়ালজুড়ে টাঙানো রয়েছে এমন সব মানচিত্র, যেগুলোতে আঁকা রয়েছে অজানা দ্বীপ, অচেনা মহাদেশ। প্রতিটি মানচিত্রের রং যেন জীবন্ত – কখনও নীল হয়ে ওঠে সমুদ্র, কখনও সবুজ হয়ে ওঠে বনভূমি।
কুটিরের মধ্যভাগে রয়েছে একটি বিশাল টেবিল, যেটি তৈরি হয়েছে একটি প্রাচীন বটগাছের গুঁড়ি থেকে। টেবিলের উপর ছড়ানো রয়েছে নানা রঙের পালক – লাল, নীল, সবুজ, এমনকি এমন কিছু রঙের পালকও আছে যার নাম দেওয়া যায় না। প্রতিটি পালকের ডগায় যেন জ্বলজ্বল করে আলো। টেবিলের এক কোণে রাখা রয়েছে স্ফটিকের বল, যার ভিতরে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি।
এই রহস্যময় পরিবেশের মাঝে বাস করেন অমরা। তার চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট – রূপালি চুল যেন চাঁদের আলোর মতো, মুখভর্তি সূক্ষ্ম রেখা। কিন্তু তার বেগুনি চোখে খেলে যায় এক দ্বৈত দৃষ্টি – একটি আলোকিত, আরেকটি ছায়াচ্ছন্ন। যখন তিনি পুঁথি পড়েন, তখন তার চোখের রং আরও গাঢ় হয়ে ওঠে, যেন কোন গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে সেখানে।
অমরার পোশাক সবসময় একই রকম – গাঢ় নীল রঙের। কিন্তু সেই পোশাকের প্রান্তে থাকে সোনালি সুতোয় বোনা অদ্ভুত চিহ্ন। এই চিহ্নগুলো নিজেরাই পরিবর্তিত হয়, যেন তারা কোন গোপন বার্তা বহন করে। কখনও সেখানে ফুটে ওঠে পাখির ছবি, কখনও অজানা প্রতীক।
শত বছর আগের সেই রাতটি এখনো স্পষ্ট অমরার স্মৃতিতে। তখন তিনি মাত্র পঁচিশ বছরের এক তরুণী, একটি ছোট গ্রামের শিক্ষিকা। সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। আকাশে চাঁদ উঠেছে সোনালি আভায়। হঠাৎ আলো পরিবর্তিত হলো – সোনালি থেকে রূপালি, রূপালি থেকে নীল, নীল থেকে বেগুনি। তারপর সেই আলো থেকে বেরিয়ে এলো হোরিনান।
কুমিরের মতো দীর্ঘ মুখ, চোখে অলৌকিক দৃষ্টি – এই অদ্ভুত দূতের চেহারায় মিশে ছিল ভয় আর বিস্ময়। তার পোশাকে ছিল সূর্য ও চাঁদের প্রতীক, গলার স্বর ছিল বাতাসের মতো মৃদু, কিন্তু বজ্রের মতো স্পষ্ট। হোরিনান সেদিন দুটি কাজ করেছিলেন – প্রথমত, তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন ছায়ানাথকে, যিনি আজ মিথেরোহাবানের রাজা। দ্বিতীয়ত, তিনি অমরাকে করেছিলেন স্মৃতিরক্ষক।
হোরিনান অমরাকে দিয়েছিলেন তিনটি উপহার – একটি স্বর্ণালী পালক যা দিয়ে লেখা যায় দুই জগতের মধ্যে, একটি স্ফটিকের বল যাতে দেখা যায় ভবিষ্যতের ছায়া, আর একটি বীজ যা থেকে জন্ম নিয়েছে এই কুটির। কিন্তু এই উপহারের সাথে এসেছিল এক অভিশাপও – অমরত্ব। তার শরীর থেমে গেল ষাট বছর বয়সে, চোখে ফুটে উঠলো বেগুনি আভা।
তবে অমরার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক গভীর রহস্য। তার দৃষ্টিতে মাঝে মাঝে ফুটে ওঠে এমন কিছু, যা শুধু অন্ধকারের বাসিন্দারাই চেনে। তার পুঁথিতে লেখা কিছু শব্দ আছে যা পড়া যায় শুধু কৃষ্ণপক্ষের রাতে। কেউ জানে না – তিনি কি আসলেই রক্ষক, নাকি কোন অজানা বিপদের বাহক।
সম্প্রতি অমরার স্বপ্নগুলো অশান্ত হয়ে উঠেছে। প্রতি রাতে তিনি দেখছেন এক অন্ধকার ছায়ামূর্তি। একদিন ভোরে, যখন তিনি স্ফটিকের বলে তাকিয়ে ছিলেন, হঠাৎ বলটি থেকে বেরিয়ে এলো এক তীব্র আলো। সেই আলোয় তিনি দেখলেন তিরোমণের জন্ম।
তিরোমণ জন্ম নেবে এমন এক দিনে যখন সূর্য আর চাঁদ একই আকাশে দেখা দেবে। তার জন্মের সময় আকাশ থেকে ঝরবে আগুনের বৃষ্টি। শিশুটির হৃদয়ে থাকবে গভীর অন্ধকার, কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত আলো। তিরোমণের আগমন নিয়ে দুই জগতে চলছে নানা কথা। কেউ বলে সে হবে ধ্বংসের দূত, কেউ বলে সে হবে নতুন যুগের প্রবর্তক।
অমরা লিখে চলেছেন তিরোমণের ভবিষ্যৎ। তার পুঁথিতে লেখা আছে – তিরোমণ বড় হবে একা, একটি পরিত্যক্ত মন্দিরে। বারো বছর বয়সে সে জানবে মিথেরোহাবানের কথা। ষোলো বছর বয়সে তার শক্তি পৌঁছবে চরমে। কিন্তু তার পরে কী হবে? সেই রহস্য লুকিয়ে আছে অমরার বেগুনি চোখের গভীরে।
প্রতি সন্ধ্যায় অমরা বসেন তার বারান্দায়। সামনে খোলা থাকে প্রাচীন পুঁথি, হাতে থাকে বিশেষ পানীয়। তিনি তাকিয়ে থাকেন দূর দিগন্তের দিকে। মাঝে মাঝে তার চোখে ভেসে ওঠে অজানা দৃশ্য – হয়তো কোন যুদ্ধের ছবি, হয়তো কোন নতুন বীরের জন্ম, হয়তো কোন আসন্ন বিপদের আভাস।
রাত গভীর হলে কুটিরের চারপাশে জ্বলে ওঠে অদ্ভুত আলো। বাগানে ফোটে এমন ফুল যার এক পাপড়ি সোনালি, আরেক পাপড়ি কালো। রূপালি পাইন গাছের পাতায় লেখা থাকে তাদের নাম যারা এসেছে, চলে গেছে। অমরা বসে থাকেন নীরবে। তিনি জানেন – একটা নতুন যুগ আসছে। সেই যুগে কী জিতবে – আলো, না অন্ধকার?
কিন্তু সবচেয়ে বড় রহস্য হলো – অমরা নিজে কোন পক্ষে? তার বেগুনি চোখে যে দ্বৈত দৃষ্টি, তার পোশাকে যে পরিবর্তনশীল চিহ্ন, তার পুঁথিতে যে অস্পষ্ট ইঙ্গিত – এসব কি তাকে করেছে দুই জগতের সেতু, নাকি কোন অজানা বিপদের বার্তাবাহক? উত্তর লুকিয়ে আছে সময়ের গর্ভে, যেখানে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে এক নতুন ইতিহাস।