প্রবল হাওয়া ছিলো। নিঝুম নদীর পাড়। কদম গাছে অকালের গুটি গুটি ফুল। আলসেমি কেমন হাওয়ায় মিশেছে, কদম দুললে বোঝা যায়। রোদ পড়ে জলের তীর্যক আধো ঢেউ ভেঙে চুড়ে একাকার। সে যেনো আযানের ডাক দিয়েছে, তাই ঘুম ভেঙে চলে এসেছি জলে। শ্মশানে বড় বেশী ভিড়। চিরমুক্তি, অপার গৌরব যাত্রা। জীবন পাখি হয়ে নদীর বুকে উ উ উ ড়ে… দূ উ উ রে মিশে যায়। যে জিবদ্দশায় হাত মেলতে পারেনি, জগত তাকে ডানা দিলে সে যেমন পাগল হতে পারে আর কি!
হাওয়ায় চুল উড়িয়ে দিচ্ছে। সে এই ছবি ভালোবাসে। বলেনি। কিন্ত সূর্য ওঠার মতন এসব জানি। সে দেখে অর্ধেক, বুকে বাজিয়ে রাখে শতগুণ। তার চোখেও রোদ, স্বচ্ছ খয়েরি আলো।
কানে ভরে দেয় গান। যেমন ভোরেদের মানায়। এ প্রেম নয়। এ সব পকেটে মুড়ে নিয়ে গিয়ে মুঠোয় ভরে দিয়ে আসা। এবং হেঁটে বাড়ি ফেরা। অলৌকিকও অপ্রস্তুত। একে চমকে দিতেও মায়া। তবু হাওয়া দিয়েছিলো আর চুল উড়িয়ে দিয়ে জলে ঢেউ লাগলো দিনের আলোয়। কান জুড়ে কারা যেন ডাক দিলো। ডাক মানে তো চিঠিও। কান তার ডাকবাক্স, গায়ের ঠিকানায় চিঠি এলো। তারা চিঠি খুললো একসাথে। চিঠিতে বিস্ফোরণ ছিলো।
সকালের মুখ দেখলে এসবের এক কণাও যদি আঁচ করা যায়! চাঁদ-তারা এমন শান্ত ভাবেও চাওয়া যায়।
ডাকের জোরে এদিকে এক ঝটকায় জানালা দরজা ভেঙে পড়েছে। দীর্ঘ কানামাছি খেলে, চোখ খুললে, চোখে আলো লাগলে বুক ধড়ফড় করে। কে যেন ভিতর থেকে হৃদয় নিঙড়ে ধরে গান শেখাচ্ছে “আল্লাহর দোহাই”। ওর ছেলের বাবা নদীতে গেছে মাছ আর মধুর খোঁজে। আসবে কবে?
চিঠিতে এসব লেখা ছিলোনা। চিঠিতে কিছুই লেখা ছিলোনা। একরাশ আলো ছাড়া; হু হু করা হাওয়া ছাড়া। ঐ আলো হাওয়া সব অক্ষর ধুয়ে শুকিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে বুঝি। যাদের চিঠি তাদেরও বোবা ধরে গেছে। বুক ফেটে বোমারু হাসি বেরিয়েছে চেতনাগাছের। খাবে কী মাথায় দেবে কে জানে রে ভাই! আলোর কাজ আলো করেছে।
তারপর থেকে আলোর ঘোরে ওরা কেউ চাঁদ দেখেনি, রাত দেখেনি – সকাল পূজো করেছে; নামাজ পরেছে। শেষে যে যার ডাকবাক্সে ঠিকানা মুছে দিয়েছে। রইলো আকাশ, রইল পাড়… চিঠি আসবেনা, বেশ। ঠিকানা নেই, বেশ। মন রইলো। আলোর জামা পরা মন। সকালপূজো করা মন। বোমারু হাসি বেরোনো মনের আজকাল চিঠি লিখতে লাগবেনা আর তার। তরঙ্গে তার দখল হয়েছে। যে আনন্দে বিষাদও ষোলো আনা, রাজার মাথায় আজ তা মুকুট হয়েছে।