– “আম্মু প্লিজ!” জুইনের কণ্ঠে অনুনয় ঝরে পড়ে।
– “একবার না বলেছি না?” আম্মুর কণ্ঠে রাগের আভাস পায় জুইন। তবুও সে হাল ছাড়ে না।
– মাত্র ৫০ টাকা দিলে কি হয়? প্রতি দিনই তো চাই না। সবাই যাচ্ছে। আমি না গেলে সবাই কি ভাববে? তাছাড়া পুরো টকাটা তো আর তোমার কাছে চাইছি না। আমার টিফিনের খরচ থেকে বাঁচিয়ে ১০০ টাকা হয়েছে। তুমি ৫০ টাকা দিলেই হয়।
– “টাকা কোন ব্যাপার না। মাত্র ক্লাস সিক্স এ উঠেই সব বান্ধবী মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে যাচ্ছ। বড় হয়ে আর কি ক করবে?”
আম্মুর ধমক শুনে জুইনের কান্না পায়। আম্মুকে কে বোঝাবে? তারা তো আর বেশি দুরে যাচ্ছে না। স্কুলের রাস্তার উল্টা দিকেই একটা নতুন রেস্টুরেন্ট খুলেছে। তার বান্ধবীরা সবাই মিলে একদিন সেখানে খাওয়ার প্লান করেছে। ১৫০ টাকা করে চাঁদা। জুইন আর কিছু ভাবতে পারে না। বুকের মধ্যে থেকে একটা কান্না দলা পাকিয়ে উঠে আসতে থাকে।
টাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আব্বুকে বলতেই টাকাটা দিয়ে দিয়েছে। ৫০ নয় ১০০ টাকা। সে এখন ২০০ টাকার মালিক। ১৫০ টাকা চাঁদা দেবার পরেও ৫০ টাকা থেকে যাবে। সেই টাকা দিয়ে কি করবে ভাবতে ভাবতে বান্ধবীদের দিকে এগিয়ে যায় সে। স্কুল ব্যাগটা আজ বেশ ভারি মনে হচ্ছে। এত এত বই আর খাতার ভার সহ্য করা তার জন্য সত্যিই কঠিন। কাঁধ থেকে ব্যাগের বোঝাটা নামিয়ে একটু জিরিয়ে নিতে গেল জুইন।
– “আফা, আপনের ব্যাগ আমি টাইন্যা দেই?” একটা ছোট মেয়ের কণ্ঠ শুনে পাশে তাকাল জুইন। নোংরা ফ্রক পড়া একটা ৮/৯ বছরের মেয়ে তার ব্যাগ টেনে দিতে চাইছে। এই টোকাই ছেলে মেয়েগুলোকে দেখলেই জুইনের মেজাজ খারাপ হয়। কি নোংরা! তাছাড়া প্রতিদিনই ভাত খাব, মায়ের অসুখ, বাবা নাই এমন বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে নাছোড় বান্দার মত পিছে লেগে থাকে। যতক্ষণ টাকা না দেয়া যায় পিছু ছাড়ে না। ধমকের সুরে জুইন জানতে চাইল, “কেন? কোন ধান্দা?”
– ধান্দা না আফা। আপনের কষ্ট হইতাছে। আমি টাইন্যা দেই, ৫ টা ট্যাহা দিয়েন।
– টাকা দিয়ে কি করবি? ভিক্ষার নতুন ফন্দি? ভাত খাবি, নাকি মায়ের অসুখ? জুইন প্রচণ্ড বিরক্ত হয়।
– মার অসুখ। মা নিশ্বেস নিবার পারে না। বুক দইর্যা গলা কাটা মুরগীর লাহান করে।
– নিশ্চয় ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে ঘুরছিস? এত ভিক্ষা করতে সুবিধা হবে। প্রেসক্রিপশন দেখা।
জুইন তাড়াতাড়ি মেয়েটার হাত থেকে নিস্তার পেতে চায়। তার বান্ধবীরা সবাই কে দেখা যাচ্ছে। তাকে টোকাই মেয়েটার সাথে কথা বলতে দেখলে সবাই খোঁচাতে খোঁচাতে জান বের করে ফেলবে।
– “আপনারে দেখামু না।” টোকাই মেয়েটা চোখে পানি নিয়ে হাটতে শুরু করে।
– আরে শোন শোন! প্রেসক্রিপশন দেখা, তোর মায়ের অসুখটা কি দেখি। আমি হয়ত বুঝব না। চল, পাশের ঐ ঔষধের দোকান টাতে দেখাই। নাম কি তোর?
– “সুফিয়া” চোখ মুছতে মুছতে বলল মেয়েটা।
জুইন রাস্তার পাশে ঠায় দাড়িয়ে আছে। তার চোখে অশ্রু। কিন্তু মনের মাঝে অন্য রকম এক প্রশান্তি। ঔষধের প্যাকেট হতে সুফিয়া তার সামনে দাড়িয়ে আছে। তার চোখে এখন আর পানি নেই। বরং অন্যরকম এক খুশির আলো ঝলমল করছে।
সুফিয়ার মায়ের ঔষধ কিনতে জুইনের পুরো টাকাই শেষ। তার সামনে দিয়েই বান্ধবীরা সবাই রেস্টুরেন্টে ঢুকল। চোখের পানি মুছে ভারি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে হাটতে শুরু করল সে। রিক্সা ভাড়া দেবার মত টাকাও নেই। হেটেই বাসায় ফিরতে হবে।