বহুকাল আগের কথা। একদিন এক ব্যক্তি হযরত খিযির আলাইহিস্ সালামের সাথে সাক্ষাৎ করল। সালাম-মোসাফাহার পর বলল, হযরত! দীর্ঘদিন যাবৎ আপনাকে তালাশ করছি। আপনার সাথে সাক্ষাৎ– এ ছিল আমার জীবনের একটি বিরাট স্বপ্ন। আমার সৌভাগ্য যে, আজ আমার সে স্বপ্ন, সে সাধ পূর্ণ হলো। মহান আল্লাহর দরবারে সেজন্য জানাই লাখো-কোটি শোকর। আমার সাথে সাক্ষাতের এতবড় তামান্না! এতবড় আকাক্সা? আচ্ছা, বলো তো দেখি, কেন জাগল তোমার মনে এতবড় সাধ? — একটা দোয়া প্রার্থনা। হ্যাঁ, একটা দোয়া প্রার্থনার জন্যেই মাসের পর মাস, বছরের পর আপনার সাক্ষাৎ কামনা করছি আমি। — এছাড়া কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই তোমার ? — জ্বী-না হুজুর। আমার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। এটাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য যে, আপনার সাথে সাক্ষাৎ হলে আপনাকে দিয়ে আল্লাহর দরবারে একটি দোয়া করাব। আর আপনার দ্বারা দোয়া করালে সে দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত। সে জন্যেই আমি আপনাকে খুঁজছি। — তা আমাকে দিয়ে কী দোয়া করাতে চাও শুনি ? — আমি যেন নিশ্চিন্তে ও নির্ভাবনায় জীবন যাপন করতে পারি, এ দোয়াটিই আমি আপনার কাছে কামনা করি। আপনি আমার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করে দিন তিনি যেন আমাকে পেরেশানীমুক্ত ও ভাবনাহীন সুখময় জীবন দান করেন। লোকটির কথা শুনে হযরত খিযির আ. খানিক ভাবলেন। তারপর বললেন– এভাবে দোয়া নয়, বরং তোমার দৃষ্টিতে যাকে সুখী মনে হয়, তুমি যেন তার মতো হতে পার, আমার দ্বারা সেই দোয়া করিয়ে নাও। ঠিক আছে হুজুর। আমি তা-ই করব। এ বলে সে সুখী মানুষ খুঁজতে চলে গেল। দিন যায় রাত আসে। আবার রাত গড়িয়ে দিন। এভাবে বহুদিন অতিবাহিত হয়। কিন্তু সুখী মানুষ সে খুঁজে পায় না। যাকেই সুখী বলে মনে হয়, তার কাছেই যায়। জিজ্ঞেস করে– ভাই! আপনি কি সুখী ? জবাবে সে বলে, না ভাই, আমি সুখী নই। এভাবে গত হলো আরো কিছুদিন। সুখী মানুষের খোঁজে একদিন এক মনোরম শহরে হাঁটাহাঁটি করছিল লোকটি। হঠাৎ সে জুয়েলারী দোকানের এক মালিককে আবিষ্কার করল। তাকে দেখেই তার মনটা আনন্দে ভরে ওঠল। সেই সাথে মনের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল, এ লোকটিই হলো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সুখী মানুষ। ওহ! এমন সুন্দর চেহারা, এত ভালো স্বাস্থ্য আর এমন হাসিমাখা মুখ জীবনে সে কখনো দেখেনি। লোকটির উপর চোখ পড়তেই তার মনে হলো– ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, রূপসী স্ত্রী আর আরাম-আয়েশের সব বস্তুই তার আছে। কোনোদিন সে অভাবে পড়েনি, কখনো সম্মুখীন হয়নি বিপদ-মসীবতের। কখনো বরদাশ্ত করেনি দুঃখ-যাতনার অসীম কষ্ট। সুতরাং সে যে সুখী, সুখময় জীবন যে তার লাভ হয়েছে, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়! একজন মনের মতো সুখী মানুষ পেয়ে লোকটির খুশি দেখে কে! তাই সে সিদ্ধান্ত নিল, আমাকে এ লোকটির মতোই হতে হবে। তার মতো হতে পারলেই আমার জীবন সুখে-শান্তিতে, আরামে-আয়েশে কানায় কানায় ভরে ওঠবে। জীবনে দুঃখ বলতে আর কিছুই থাকবে না। থাকবে না ব্যথা-বেদনা বা পেরেশানী বলতে কোনো জিনিস। সুখী মানুষের খোঁজ পেয়ে লোকটি খিজির আ. এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। কিছুদূর যাওয়ার পর ভাবল, দোয়া করানোর পূর্বে জুয়েলারী দোকানের মালিক থেকে জেনে নেওয়া দরকার যে, আসলেই সে সুখী কি-না। কারণ, এমনও তো হতে পারে যে, ভিতরে ভিতরে তার কোনো দুঃখ আছে, যা বাহ্যিকভাবে আমার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। খোদা না করুক; যদি তাই হয়, তবে তো ওই দুঃখের সম্মুখীন আমাকেও হতে হবে। অথচ আমি কখনো চাই না যে, গোপনে তার কোনো দুঃখ থাকবে আর দোয়া করানোর ফলে সেই দুঃখ আমার মধ্যেও এসে যাবে। এমন হলে তো এতদিনের সব পরিশ্রমই পণ্ড হয়ে যাবে। একথা ভেবে লোকটি জুয়েলারী দোকানের মালিকের সাথে দেখা করল। সালাম মোসাফাহার পর বলল– দেখুন, আমি আপনার মতো নিশ্চিন্ত ও ভাবনাহীন জীবন লাভ করার জন্য হযরত খিজির আ. কে দিয়ে দোয়া করাতে চাই। আমার দৃষ্টিতে আপনার মতো সুখী মানুষ এ জগতে আর কেউ নেই। কি বলেন, কথাটা ঠিক না? মালিক এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আর বলবেন না ভাই! আমার সবই ঠিক আছে। তবে মনের মধ্যে এমন এক দুঃখ গোপন করে রেখেছি যা ব্যক্ত করার মতো নয়। দোয়া করি, মহান পরওয়ারদিগার যেন আমার কোনো শত্র“কেও এমন দুঃখ না দেন। এমন কষ্টে না ফেলেন। তার কথা শুনে আগন্তুক লোকটি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। কিছুণ তার মুখ থেকে কোনো কথা উচ্চারিত হলো না। মাথা নিচু করে ভাবনার অথৈই সাগরে হারিয়ে গেলেন তিনি। খানিক পর মাথা উঠিয়ে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন– — আপনার গোপন দুঃখটির কথা আমি জানতে পারি কি ? — না। এ দুঃখের কথা আমি কারো কাছে বলব না। — কারণ? — কারণ উহা এমন এক দুঃখ যা কেবল সহ্য করে যেতে হয়, অন্যের কাছে বলা যায় না। — দেখুন আজ বহুদিন যাবত সুখী মানুষের খোঁজে পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। কত গ্রাম, কত শহর আর কত জনপদে যে আমি এই একটামাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে হাজির হয়েছি তার কোনো হিসেব নেই। নেই আমার কষ্টের কোনো সীমা-পরিসীমা। কিন্তু এত সফর আর এত কষ্টের পরও আমি কোনো সুখী মানুষের খোঁজ পাইনি। অবশেষে আমি যখন সুখী মানুষ পাওয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম ঠিক তখনই আপনাকে দেখে আমার আশার আলো নতুন করে জ্বলে ওঠেছিল। শুধু তাই নয়, আপনার হাসিমাখা সুন্দর মুখ দেখে আপনাকে আমি সত্যিকার সুখী মানুষ হিসেবে এক্বিনও করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আপনিও যখন বলছেন, আপনি সুখী নন, আপনার এক গোপন দুঃখ আছে, তখন আপনার এই গোপন দুঃখটির কথা না জানা পর্যন্ত আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারব না। মেহেরবানী করে আমার কাছে সবকিছু খুলে বলুন। বড়ই মিনতিভরা কণ্ঠে কথাগুলো বলে শেষ করল লোকটি। দোকান-মালিকের সিদ্ধান্ত ছিল তার এই দুঃখের কথা কারো কাছে বলবে না। কিন্তু লোকটির বিনয়মিশ্রিত আবেদনে তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারলেন না। তাই বলতে লাগলেন– আমার স্ত্রী ছিল সুন্দরী রূপসী ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের মেয়ে। সে ছিল রূপের রাণী। তার উজ্জ্বল রূপ জ্যোতি বিকিরণ করত চারিদিকে। কোনো স্থানে উপবেশন করলে মনে হতো, সেখানে যেন রূপের বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছে। তার ডাগর চোখের চাহনী নিমিষে দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বিমোহিত করে ফেলত। তার চেহারায় এমন যাদুময় তীব্র আকর্ষণ ছিল যে, অপলক আঁখি মেলে কেবল চেয়েই থাকতে ইচ্ছে হত। কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে যত ভালোবাসতে পারে, আমি আমার স্ত্রীকে তার চাইতেও বেশি ভালোবাসতাম। তার ভালোবাসায় আমি একেবারে মত্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাকে ছাড়া আমি কিছুই বুঝতাম না।
শয়নে-স্বপনে কেবল তারই ধ্যান করতাম। তার উচ্ছলতা, তার প্রাণ চঞ্চলতা, তার মায়াময় সুন্দর চেহারা সর্বদাই আমার হৃদয়ের আয়নায় উদ্ভাসিত হয়ে থাকত। একদিন আমার স্ত্রীর ভীষণ অসুখ হলো। অসুখটা এতই মারাত্মক ছিল যে, আমার এক্বিন হয়ে গেল– সে আর বেশিদিন বাঁচবে না। অচিরেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে। তাই আমি তার শয্যার পাশে বসে ছোট্ট বালকের মতোই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমার কান্না দেখে স্ত্রী আমাকে সান্ত্বনা দিল। বলল, খামাখা কেঁদে মন খারাপ করবেন না। আমার মৃত্যুর পর আমার চাইতেও সুন্দরী কোনো নারীকে বিয়ে করে নিবেন। দেখবেন, সে আপনাকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবে। আদর-সোহাগ করবে। তখন আর আপনার মনে কোনো দুঃখ থাকবে না। আমি বললাম, অসম্ভব। কোনোদিনও তা হতে পারে না। তুমি ব্যতীত অন্য কোনো মেয়েকে আমি কল্পনায়ও আনতে পারি না। আমার কথা শুনে স্ত্রী কিছুটা ব্যঙ্গ স্বরে বলল– হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না। এসব কথা পুরুষদের মুখের বুলিমাত্র। এসবের কোনো কার্যকারিতা আগেও ছিল না, এখনও নেই। ভবিষ্যতেও থাকবে না। — তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না ? — সব ব্যাপারে বিশ্বাস করলেও অন্ততঃ এ ব্যাপারে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি না যে, আমার মৃত্যুর পর আপনি আর কোনো মেয়েকে বিয়ে না করে একা একাই জীবনটা কাটিয়ে দিবেন। — তুমি এমন করে বলতে পারলে? — হ্যাঁ, পারলাম বৈকি! আমি যা বললাম ঠিকই বললাম। আর আপনি যা বলছেন আবেগের বশবর্তী হয়ে বলছেন। মনে রাখবেন, আবেগের কথা দীর্ঘণ স্থায়ী হয় না। আবেগ চলে গেলেই সবকিছু ওলট পালট হয়ে যায়। — তুমি কি তাহলে তোমার কথায়ই অটল থাকবে? এ বলে আমি আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম। — থাক্ থাক্ আর কাঁদতে হবে না। ক’দিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার অবস্থা দেখে ও বিদ্রুপমাখা কণ্ঠে কথাটি বলল। এরপর আমি তাকে বুঝানোর জন্য আরো চেষ্টা করলাম। কিন্তু সব চেষ্টাই বিফলে গেল। কিছুতেই সে মানতে চাইল না যে, তার অবর্তমানে অন্য কোনো মেয়েকে বধূ করে ঘরে তোলা আমার পে সম্ভব নয়। এবার আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী করে তাকে বিশ্বাস করাই! মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। অল্পসময় পরই হয়তো দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে সে। কিন্তু এর আগেই তাকে, যে কোনো উপায়ে বিশ্বাস করাতেই হবে। হঠাৎ আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এল। ভাবলাম, আমি যদি আমার বিশেষ অঙ্গটি কেটে তাকে দেখাতে পারি, তবে তো আর বিশ্বাস না করে পারবে না। যদিও এটি বাস্তবায়ন করা খুবই কষ্টের ব্যাপার, তবু তাকে বিশ্বাস করানোর জন্য এছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। তাই যেমন ভাবনা তেমন কাজ। আমি ণিকের মধ্যে আমার চিন্তার বাস্তবায়ন ঘটালাম। তারপর সেই অঙ্গটি তার সামনে রেখে বললাম– দেখো, ভালো করে তাকিয়ে দেখো। কী কাণ্ড ঘটিয়েছি আমি! এবার তো তোমার বিশ্বাস না হয়ে পারবে না যে, তোমার অবর্তমানে আমার আর কোনো নারীর প্রয়োজন নেই? এবার সে বিশ্বাস করল। বলল– হ্যাঁ, এখন আমি আপনার কথায় পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করেছি। কিন্তু খোদার কী কুদরত! এ ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই আমার স্ত্রী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল। তার রূপ-যৌবন পুনরায় ফিরে এল। সেই সৌন্দর্য, সেই যৌবন, সেই হৃদয়কাড়া চাহনি, সবই আছে তার, কিন্তু আমার কিছুই নেই। তাই ধীরে ধীরে সে অবৈধ পথে পা বাড়াল। এখন সে আমার চাকর বাকরের সাথে জৈবিক চাহিদা পূর্ণ করে। কিন্তু অমতার কারণে আমি তাকে শক্ত করে কিছুই বলতে পারি না। ভাই! এবার আপনিই বলুন, সুঠাম দেহের অধিকারী কোনো পুরুষের স্ত্রী যদি অপর কোনো পুরুষের সাথে আপন চাহিদা পূর্ণ করে, তাও আবার অধিনস্থ চাকর-নওকরের সাথে, তাহলে ঐ পুরুষটির মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে ? সুতরাং বুঝতেই পারছেন, আমি এখন কী পরিমান শান্তিতে আছি! কত সুখ আমার জীবনে! এ ঘটনা শুনে লোকটি চলে গেল। অতঃপর ঘটনাক্রমে একদিন হযরত খিযির আ. এর সাথে লোকটির দেখা হলো। হযরত খিযির আ. জিজ্ঞেস করলেন, ভাই! তুমি তো আর দোয়ার জন্য এলে না। লোকটি আরয করল, হুজুর! আমি বুঝতে পেরেছি এই দুনিয়ায় কেহ নিশ্চিন্ত জীবনের অধিকারী হতে পারে না। সুতরাং এখন আর আমি আপনাকে দিয়ে দুনিয়ার সুখের জন্য দোয়া করাতে চাই না। আপনি বরং আমার পরকালের জন্য দোয়া করুন। যেন পরকালে আল্লাহ পাক আমাকে সুখে শান্তিতে রাখেন। হযরত খিযির আ. তার জন্য পরকালীন শান্তির দোয়াই করে দিলেন। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! আসলেই দুনিয়াটা এমন যে, এখানে কেউ সার্বণিক সুখ-শান্তিতে থাকতে পারে না। সবসময় আরাম-আয়েশে থাকতে পারে না। যত বেশি চেষ্টা-সাধনাই করা হোক না কেন, দুনিয়ার জীবনে এমনটি হওয়া কখনো সম্ভব নয়। সার্বণিক সুখ সে তো পরকালে বেহেশ্তের মধ্যেই হবে। তাই আসুন, দুনিয়ার আরাম-আয়েশের জন্য বেশি ফিকির না করে আখেরাতের আরাম-আয়েশের ফিকির করি। যথোপোযুক্ত চেষ্টা করি বেহেশ্ত লাভের; চেষ্টা করি, মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন করে তাকে রাজী-খুশি করার। তবেই আমাদের জীবন স্বার্থক হবে। সফল হবে। আমরা লাভ করতে পারব, চিরসুখের জায়গা জান্নাত। আল্লাহ পাক আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন। ][সূত্র : আল ইফাযাতুল ইয়াওমিয়্যাহ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৯৪