সন্দেশপুরের বিপদ

সে বছর গরমের শুরুতে সন্দেশপুরে এক বিপদ নেমে এলো।
দুষ্টু এক জাদুকর ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে দিল আকাশ থেকে। ওতে কি হল ?
অচেনা ভয়ংকর এক রোগ ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। মানুষজন টপাটপ করে মরতে লাগল। আজ এখানে মরে, কাল ওখানে মরে। লাশের পাহাড় হয়ে গেল। সব দেশের রাজবৈদ্যরা পাগল হয়ে গেল এই ভীষণ রোগের দাওয়াই বের করার জন্য। দিনরাত তারা জড়ি বুটি সেদ্দ করছে তো করছেই। কিন্তু ওষুধ বানাতে পারছে না।
কেউ বলে দূর দেশের নীল রঙের শ্যাওলা হলে বানাতে পারবে ওষুধ। কেউ বলে ময়াল উপত্যাকার ওখানের ঘাসের উপর জমে থাকা শিশিরের জল হলে ওষুধ বানাতে পারবে।
কিন্তু কেউ পারছে না।
দিনরাত তারা চুলার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লতাপাতা জ্বাল দিতে লাগল পেতলের হাঁড়িতে।
মানুষ মরছেই।
তখন রাজবৈদ্যরা বলল, সবাই ঘরে বসে খিল এঁটে থাকো। দুষ্ট জাদুকরের ভাঙ্গা কচের টুকরো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। যার শরীরে পড়বে সে মারা যাবে।
রাজা ঘোষণা দিল সবাই, বাড়িতে বসে থাকো।
তেমন হল। কিছু ফচকে লোক অবশ্য বাইরে ঘুরতে চায়। ওরা খারাপ। রাজার পেয়াদারা লোহার পোশাক পরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। হাতে বল্লম আর রুটি বানানো তাওয়ার মত ঢাল। কাউকে পেলেই শক্ত পিটুনি দেবে ।
সন্দেশপুর একদম সুনসান হয়ে গেল।
পথে ঘাটে কেউ নেই। বাজারে লোক নেই। শুধু লোহার জামা পরে পেয়াদারা হেঁটে বেড়াচ্ছে।
একদিন দেখে বাজারে একটা চায়ের দোকান খোলা।
সুন্দর প্রাচীন এক কেটলিতে চায়ের পাতা ফুটানো হচ্ছে। সামনে চীনেমাটির কয়েকটা পেয়ালা। পেয়ালাতে নীল রঙের ফুলের ছবি। বাঁটুল এক বয়াম ভর্তি লাল চিনি।
পেয়াদা রেগে গিয়ে বলল, ‘ তোমরা এখানে কি করছ ??
গোল দাড়িওয়ালা, গোলাপি জামা পরা একজন মেজাজ দেখিয়ে বলল,’ বাড়িতে আমার গিন্নি চা দেয় না। চা খেতে এসেছি। খাওয়া হলেই চলে যাব। রাজাকে বলবেন আমরা আড্ডা দিতে আসিনি।’
একজনের চেহারা রাবণের মত। মাথায় ঘিল্লি করা চুল। পেল্লায় গোঁফ। মুখটা সরু।
লোকটা বড় ভাল। শুধু মিহি গলায় জানতে চাইল, ‘ আমরা খাব না চা ? চা খাব না আমরা ? ‘
মাত্র দুটো কথা। বলার আর কিছু নেই তার।
যেন ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করলো।
তিন নাম্বার লোকটা সত্যজিৎ রায়ের মত দেখতে। সে বিরক্ত হয়ে চেয়ে রইল। একটা কথাও বলল না।
পেয়াদা ফিরে গেল।
সব শুনে রাজা অবাক হয়ে পেয়াদাকে বললেন, ‘ উনাদের শাস্তি দিলে না যে ?’
পেয়াদা বলল, ‘ এই তিনজন সেই তিনজ্ঞানির মত। যারা যীশুর জন্য উপহার এনেছি। আসল প্রজা কিন্তু এরাই। একজন প্রতিবাদ করলো। পরের জন অসহায় ভাবে জানতে চাইল তার অধিকার। শেষের জন হাল ছেড়ে দিয়েছে রাজার উপর থেকে। কারন সে হয়তো ভাবছে দুষ্টু জাদুকরকে আগেই কেন রাজা ধরল না। বিদেশী বনিকরা যখন অসুখ নিয়ে ঢুকল তখন কেন রাজা কিছু করল না। হেন তেন। তাছাড়া জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জাদুকরের কাচ ভাঙ্গার ভয়ে বাসায় থাকবে কেন ? এই এক পেয়ালা চা ছাড়া আর কোন আনন্দ গত চল্লিশ বছরে সে কারও কাছ থেকে পায়নি।রাজার কাছ থেকেও না।’
প্রাসাদের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইল রাজা। মন খারাপ হয়ে গেছে তার। মনে মনে ঠিক করলেন, সব ঠিক হলে প্রজাদের ভাল মন্দ খেয়াল রাখবেন ।
তখনই পেল্লাই কাঁচের একটা বিকার নিয়ে হাজির হল রাজবৈদ্য। ভেতরে কচি কলাপাতার রঙের সবুজ তরল।
বলল, ‘ মহারাজের জয় হোক। ওষুধ বানানো হয়ে গেছে।’