Where is Dan? তিন শব্দের ছোট্ট একটি প্রশ্নবোধক বাক্য। যেটা পুরো দুনিয়া উলট–পালট করে দিলো ড্যানের।
আমি যখন টাইম পাস করার জন্য সিনেমা দেখি, তখন ‘কমার্শিয়াল মুভি বা মাসালা মুভি’বলতে যা বুঝায়, সে ধরনের সিনেমা দেখি। কমেডি বা একশন টাইপ। এই ধরনের সিনেমা গুলো হচ্ছে– দেখা শেষ তো কাজ শেষ।
কিছু সিনেমা আছে, যেগুলো চলাকালীন আমি কীভাবে কীভাবে যেন সেই সিনেমার ভেতরে প্রবেশ করে ফেলি। তারপর সেই সিনেমার ভেতরেই থাকি আমি, ঘটনাগুলো আমার চারপাশেই ঘটতে থাকে। বইপড়ার ক্ষেত্রেও আমার এমনটা হয়। বিশেষ করে গোয়েন্দাভিত্তিক লেখাগুলো, যেমন– এরকুল পুয়োরো, ফেলুদা, মিসির আলি ইত্যাদি। আর হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড-এর লেখা তো আমি আমার চোখের সামনেই দেখতে পাই।
আর কিছু লেখা আছে, যেগুলোর লিড ক্যারেক্টারটা আমিই হয়ে যাই পড়তে পড়তে। সে ব্যথা পেলে আমিই ব্যথা পাই। সে উত্তেজিত হলে আমিও উত্তেজিত হয়ে যাই। তার সুখ–দুঃখ, সাফল্য–ব্যর্থতা সব আমারই হয়। এই রকম হয়েছিল ভিক্টর হুগো–র লা মিজারেবল–এ, নিগ পিরোগ–এর থ্রি এ.এম. সিরিজে, রবার্ট লুডলাম–এর বর্ন আইডেন্টিটি সহ আরো অনেক বইয়ে । সিনেমাতেও আমার এমন হয়। সুজিত সরকার-এর অক্টোবর সিনেমাতেও এমনটা হয়েছিল। আমি যেন ড্যানের ভেতরেই প্রবেশ করেছিলাম নিজের অজান্তেই, সিনেমার শুরুর দিকেই।
অক্টোবর নামক এই সিনেমাটির রিভিউ করতে নয়, সিনেমাটি দেখে আমার যে অনুভুতি হয়েছে বা আমি যা অনুভব করেছি, তা জানাতেই আজকের এই লেখা।
সহজ–সরল নিঃসঙ্গ ড্যান যখন জানতে পারে ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার আগে শিউলি তার কথা জিজ্ঞেস করেছিল, তখনই পরিবর্তন হয়ে যায় ড্যানের জীবন। এই একটি বাক্য তাদের দুজনের মাঝে তৈরি করে অদৃশ্য এক বন্ধন। সৃষ্টি হয় ভালোবাসা, যেখানে প্রেম নিবেদন করা হয়নি। তাদের ঠিকমতো কখনো কথাও বলা হয়নি। কিন্তু শিউলির এই ভাবলেশহীন ড্যানের প্রতি মনের কোথাও না কোথাও একটা অনুভূতি কাজ করতো। তাই সে তাদের কর্মস্থল পাঁচতারা হোটেলের নতুন বছরের পার্টিতে ড্যানকে না দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, Where is Dan?
এই সিনেমায় আপনি ভালোবাসার অন্য এক রূপ, অন্য স্বাদ পাবেন। জানতে পারবেন যে, অনেক সময় না বলেও অনেক কিছু বলা হয়ে যায়। দূর্ঘটনার পর থেকে শিউলির প্রতি ড্যানের ভালোবাসা কোমায় থেকেও যেন টের পেয়ে যায় শিউলি। আমার কেমন যেন মনে হয়েছিল, শিউলি নিজেও চাচ্ছে সে যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠে, শুধুমাত্র ড্যানের অত্যাধিক কেয়ার করা দেখে!
আমি এই সিনেমায় ভালোবাসাই দেখেছি। তবে তা শুধুমাত্র ড্যান আর শিউলির না। পরিচালক, লেখক, অভিনেতা–অভিনেত্রী, সবার। সবাই তাদের সবটুকু উজার করে দিয়েছিল অবশ্যই। তা না হলে এইরকম একটা মুগ্ধতা ছেয়ে থাকা সিনেমা নির্মাণ প্রায় অসম্ভব। সিনেমা শেষ হওয়ার পর আমি নিজেই ভাবছিলাম, এ কী অসম্ভবকে সম্ভব করলো তারা!
অসাধারণ কাস্টিং, অসাধারণ স্ক্রিনপ্লে, আর কী মনমুগ্ধকর অভিনয়! কেমন করে যেন সৃষ্টি হয়ে গেল এত সুন্দর একটি সিনেমা। বলিউড থেকে কোনো আশা না থাকার পর যদি এমন একটি সিনেমা উপহার পাই, তা তো অবশ্যই নাড়া দিবে আমাদের। বরুন ধাওয়ানের অন্যান্য সিনেমাগুলোতে তার ওভার এক্টিং দেখে আমি যারপরনাই বিরক্তই ছিলাম তার প্রতি। কিন্তু, পরিচালক যে তাকে পলিশ করে এতো স্মুথ করতে পারবে, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। শিউলি ক্যারেক্টারটা বানিতা তার সবটুকু সামর্থ্য দিয়েই ফুটিয়ে তুলেছে। অসুস্থ অবস্থায় শিউলির যে ভাবলেশহীন দৃষ্টি, সেখানে ড্যানের প্রতিও যে একটা টান কাজ করছে তা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। বরং স্পষ্টভাবেই বুঝতে পেরেছি তা।
আমাদের ভালোবাসায় আমরা অনেক হিসেব–নিকেশ করি, অনেক চাওয়া–পাওয়া থাকে। এখানে ড্যান ও শিউলির ভালোবাসায় কোনো চাওয়া–পাওয়া নেই। যদিও শেষ পর্যন্ত শিউলিকে হারাতেই হয় ড্যানের। তবে শিউলির সেই বাক্যে ড্যানের মাঝে নিয়ে আসে বিশাল এক পরিবর্তন। কর্মস্থলে অমনযোগী থাকা ড্যান নতুন চাকরিতে জয়েন করে। এখানে সে যথেষ্ট আগ্রহ নিয়েই তার কাজ করতে থাকে। আমার কেমন যেন মনে হলো, সিনেমার শুরুতে যে ড্যান তার জীবনের মানে খুঁজে পাচ্ছিল না। অর্থ্যাৎ সে কী করছে, কেন করছে, এসব–ই বুঝতে পারছিল না। সেই ড্যান সিনেমার শেষে গিয়ে তার জীবনের ট্র্যাক খুঁজে পেয়েছিল। তার জীবনে হয়তো শিউলির সেই বাক্যটির–ই অভাব ছিল, কিংবা শিউলির। যে কিনা কোনো প্রকার স্বার্থ ছাড়াই খোঁজ নিয়েছিল ড্যানের। হয়তো অযত্নে–অবহেলায় থাকা ড্যানের প্রতি মমতাবোধ আর ভালোবাসা ছিল শিউলির হৃদয়ের কোনো এক কোণে।
ভালোবাসি না বলেও ভালোবাসা যায়, তবে সে ভালোবাসা অনেক গভীর হতে হয়।
এই সিনেমাটি আপনারও দেখা উচিত। তবে হ্যাঁ, তা শুধুমাত্র ভালোবাসার গল্প দেখার জন্যই না। আমি হয়তো একটু বেশিই ভালোবাসা কপচে ফেললাম। এর বাইরেও আপনি কিন্তু এই সিনেমায় সাবলীল অভিনয় দেখতে পাবেন। আপনাদের সামনে তুলে ধরা হবে খুব গোছানো একটা স্ক্রিপ্ট। ডায়লগ ছাড়াও যে কথা বলা যায়, তারও চমৎকার উপস্থাপন রয়েছে এতে। সহজ–সরলভাবে গভীর একটা গল্প বলে গেল পরিচালক। আর জীবন যে থেমে থাকার নয়, বরং আরো ভালোভাবে বাঁচার, তাও খুব সূক্ষ্মভাবে বলে দেয়া হয় এতে। আশা করি উপভোগ করবেন, যদি সব ধরনের বা ভিন্ন ধরনের সিনেমাপ্রেমী হয়ে থাকেন।