জিউসের ক্রোধ এবং প্রেমের নানা রূপ

জিউস, আইও  এবং চাঁদের বিভিন্ন অবস্থাঃ
আমরা জিউসের বেড়ে ওঠায় আইও নামে এক পরীর অবদানের কথা জানিআইও নামক আরেক নারীর জীবন জিউসের সাথে জড়িয়ে পরেআজ আমরা কাহিনীই জানব
আইও ছিলেন নদীদেবতা ইনাকাস এবং  ওশেনিড মেলিয়া এর সন্তানতিনি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী বড় হয়ে তিনি দেবী হেরার মন্দিরের পূজারিণী হনভালই কাটছিল তার দিনএকদিন ইনক্স নামে এক নারী মায়ার সাহায্যে জিউসকে আইও এর প্রতি আকৃষ্ট করেনকোনো এক সকালে আইও অভ্যাসমতো একাকী নদীতে গোসল করছিলেনএসময় জিউস তাঁর রূপে আকৃষ্ট হন এবং মিলিত হনজনপ্রিয় অন্য একটি মতেজিউস আইও এর সাথে মিলিত হতে চাইলে আইও প্রত্যাখান করে বলেন– ” আমার পিতা কথা জানলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবেনখুব সম্ভবত প্রাণে মেরে ফেলবেন
জিউস নিজেও হেরার আড়ালে তার কাজ সারতে চাইছিলেনতাই তিনি আইওর পিতা এবং হেরার দৃষ্টি এড়াতে ঘনমেঘ দ্বারা আইও নিজেকে আবৃত করেন হেরা অলিম্পাসে বসে পৃথিবীর সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেনএসময় তিনি ঘনমেঘের আস্তরণ দেখে বিস্মিত হনকেনো এই মেঘ তা দেখতে তিনি মর্ত্যে নেমে আসেনতখন জিউস নিজের অপরাধ লুকাতে আইও কে একটি সাদা বকনা বাছুরে রূপান্তরিত করেন এবং নিজে একখন্ড তুষারশুভ্র মেঘে পরিণত হনহেরা যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলেন তাই কাউকে কিছু না বলেই অলিম্পাসে ফিরে আসেন তিনিএরপর জিউস হেরার আগেই অলিম্পাসে ফিরে আসেন এবং  হেরা ফিরে এসেই তার কাছে সেই শুভ্র বাছুরটি দাবী করলেনজিউস হেরাকে খুব ভাল করেই চিনতেনতাই তিনি বাছুরটি হেরাকে দান করলেন হেরা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যেন জিউস আইও এর কাছে যেতে না পারে তাই তিনি সাহায্য নেন শতচক্ষুবিশিষ্ট এক দৈত্য আর্গসেরআর্গস কখনোই তার ১০০টি চোখ একসাথে বন্ধ করত নারাতে ঘুমানোর সময় তার যেকোনো দুটি চোখ খোলা থাকতআর তাই হেরা আইও কে চোখে চোখে রাখার দায়িত্ব তাকেই দেনএদিকে মেয়েকে হারিয়ে ইনাকাস দিশেহারা এবং পাগলপ্রায় হয়ে পরেনতিনি দিকে দিকে খুঁজতে থাকেন মেয়েকেএকসময় তিনি এসে পৌঁছান আর্গসের আবাসস্থলেআর্গসকে আইও এর বেপারে জিজ্ঞেস করলে সে বেপারে কিছুই জানে না বলে দাবি করে
এসময় গাভীরূপী আইও খুরের সাহায্যে পিতাকে তার দুঃখের কাহিনি শোনালেন কিন্তু ইনাকাস সব বুঝতে পেরেও  আইও এর দুঃখের কোনো প্রতিকার না করেই সেখান থেকে চলে যান
এর আরো কিছুদিন পর জিউস আইওকে উদ্ধারের জন্য হার্মিসকে পাঠানহার্মিস আর্গসের বেপারে খুব ভাল করেই জানতেনতাই তিনি নলখাগড়া থেকে একটি বাঁশি প্রস্তুত করে আর্গসের সামনে আসলেন এবং ঘুমপাড়ানি সুর বাজাতে লাগলেনসুরের প্রভাবে আর্গস ঘুমিয়ে পড়লে তিনি আর্গসের মাথা কেটে নেন ঘটনা হেরা জানতে পারলে আর্গসের শতচক্ষু ময়ূরের পাখায় স্থাপন করেনময়ূরের পাখায় থাকা চোখের আকৃতি আসলে আর্গসের শতচক্ষুর প্রতীকক্রোদ্ধান্বিত হেরা এরপর একটি ডাঁশ মাছিকে আইও এর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিলেনগাভীরূপি আইও মাছির জ্বালায় দৌড়াতে থাকলেনআইও প্রায় পুরো পৃথিবীব্যাপী ছুটে বেড়ালেন শেষে আশ্রয়ের আশায় এক সাগরে ঝাঁপ দেন, পরবর্তীতে তাই সাগরের নাম রাখা হয় আইওনিয়ানসাগর ছেড়ে উঠে মাছির তাড়নায় তিনি আবারো ছুটতে লাগলেন ছুটতে তিনি এসে পৌঁছালেন হাইব্রিস্ট নদীর ধারে অবস্থিত ককেশাস পর্বতেআর পর্বতেই বন্দী ছিলেন প্রমিথিউসপ্রমিথিউসকে  দুঃখের কথা জানালে প্রমিথিউস তাকে নীলনদের অববাহিকায় তাঁর মুক্তির ভবিষ্যদবাণী করলেনএবং বললেন,তাঁর বংশে জন্ম নেবে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বীর এরপর আইও প্রমিথিউসের নির্দেশ মতো ছুটতে ছুটতে নানা পথ পাড়ি দিয়ে মিশরে আসেনএখানেই জিউস তাকে মানব রূপে ফিরিয়ে দেন এবং তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়
নাম ছিল তার এপাফাস 

অন্য সংস্করণ অনুযায়ী আইও গাভী থাকা অবস্থায় আইওনিয়া পর্বতের এক গুহায় জিউসের সাথে সম্পর্কের ফলস্বরূপ একটি এঁড়ো বাছুর জন্ম দেন  সন্তান ডাঁশ মাছির কামড়ে মারা যায়জিউস আইওকে মানুষের রূপ ফিরিয়ে দিয়ে  আবারো মিলিত হন এর ফলে জন্ম হয় এপাফাসের
প্রাচীনকালে  গ্রীকবাসীরা চাঁদের সাথে গাভীর সম্পর্ক স্থাপন করেছিলপ্রাচীনকালে জোয়ার ভাঁটায় চাঁদের ভূমিকার জন্য চাঁদকে পানির উৎসসমূহের দেবী হিসেবে কল্পনা করতেন তারাআবার গাভী দুধ দেয় বলে গাভী চাঁদের মর্ত্যের রূপআর বিশ্বাস থেকেই আইও গ্রীকদের কাছে চন্দ্রদেবী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন
গ্রিকরা চাঁদের তিনটি রঙ কল্পনা করত যা ছিল আইও এর জীবনের বিভিন্ন স্তরের প্রতীকযেমনঃ
•  চাঁদের রঙ যখন শুভ্র তখন তা পবিত্রতার প্রতীকঠিক তেমনি প্রথম জীবনে হেরার পুজারিণী হিসেবে আইও ছিল চাঁদের শুভ্রতার মতো পবিত্র
চাঁদের লাল রঙ হল যৌবনের প্রতীকএই লালিমা আমরা দেখি পূর্ণিমার সময়যৌবনে আইও লাঞ্চিত হয়েছিলেন জিউসের কারণে লাল রঙ দ্বারা একই সাথে আইও এর যৌবন এবং বেদনা বোঝানো হয়
চাঁদের কালো রঙ  চাঁদের বার্ধক্য   কলঙ্কের প্রতীকঅমাবস্যায় আমরা কালো আকাশ দেখতে পাইএই রঙ আইওর সমগ্র জীবনের কলঙ্ক এবং নিঃসঙ্গ মৃত্যুর প্রতীক 

জিউস এবং ট্রয়ের প্রাচীরঃ
জিউস সর্বদায় ছিলেন স্বেচ্ছাচারী এবং নারী লুলুপতাঁর স্বভাবে অতিষ্ঠ হয়ে অন্যান্য দেবতারা জিউসকে শায়েস্তা করতে হেরার নেতৃত্বে বিদ্রোহ করলেনএক পর্যায়ে তাঁরা জিউস কে বেঁধে ফেলতেও সক্ষম হলেনকিন্তু তাঁদের মধ্যে জিউসের উত্তরাধিকারী কে হবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব লেগে  গেল সুযোগে থেটিস জিউসকে মুক্ত করে দিলেন জিউস তখন বিদ্রোহীদের নানারূপ শাস্তি দিলেনপোসাইডন এবং এপোলো কে পাঠালেন ট্রয়ের রাজা লাওমিডনের দাস হিসেবেআর অবস্থায় তারা ট্রয়ের বিখ্যাত প্রাচীর নির্মাণ করেনএরপর হেরাকে স্বর্গ এবং মর্ত্যের মাঝে ঝুলিয়ে দিলেনহেরার পুত্র হেফাস্টাস তাঁকে পরবর্তীতে বন্ধন থেকে মুক্ত করেছিলেন


প্রমিথিউসের অবাধ্যতার শাস্তিঃ
প্রমিথিউস ছিলেন টাইটান এয়াপিটাস এর সন্তানকোনো কাজ করার আগে চিন্তা করতেন বলে তাঁর নাম ছিল প্রমিথিউসজিউস পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রাণী সৃষ্টি করতে চাইলেন কাজের দায়িত্ব গিয়ে পড়ল প্রমিথিউস এবং তাঁর  ভাই এপিমিথিউস এর উপরএপিমিথিউস আবার কাজের পরে চিন্তা করতেনপৃথিবীতে এসে দুই ভাই প্রাণী তৈরির জন্য বিভিন্ন স্থানের মাটি সংগ্রহ করতে লাগলেন এপিমিথিউস প্রথমেই মাটি দিয়ে বিভিন্ন পশুপাখি তৈরি করতে লাগলেনঅন্যদিকে প্রমিথিউস অনেকদিন যাবত ভেবে চিন্তে পৃথিবীর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট  মাটি স্বচ্ছ পানি দিয়ে দেবতাদের আকৃতির এক নতুন প্রাণী বানাতে লাগলেন প্রাণী আর কেউ না মানুষ ছিলআকৃতি বানানো হয়ে গেলে প্রমিথিউস জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনাকে এনে মানুষকে জ্ঞান দান করলেন তিনিদেবতার আকৃতি পাওয়ায় মানুষকে ঠিকভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না জিউসকিন্তু তিনি কাউকে সেটা না জানতে দিয়ে বললেন, সৃষ্টিরা যেহুতু সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তাই এরা আমার আরাধনা করবেমানুষ যা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করবে তার  একটা অংশ দেবতাদের উদ্দেশ্যে দান করবে এবং বাকি অংশ থেকে নিজেদের আহার গ্রহণ করবে
দেবতা এবং মানুষরা কে কোন অংশ গ্রহণ করবে তা নির্ধারণ করতে মিসোন নামক স্থানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন প্রমিথিউসপ্রমিথিউস সবসময় ছিলেন মানুষের বন্ধুতিনি সবসময় মানুষদের ভাল চাইতেন তাই তিনি অনুষ্ঠানে কূটকৌশলের সাহায্য নিলেনপ্রমিথিউস করলেন কি উৎসর্গকৃত ষাঁড়ের শরীরের অংশ গুলোকে দুই ভাগ করলেনএকটি জীর্ণ গাভীর পাকস্থলীতে ষাঁড়ের উৎকৃষ্ট মাংস রেখে গাভীটির শরীরে কাদা ময়লা মাখিয়ে রাখলেনঅপরদিকে নাড়িভূড়ি হাড় চর্বি সহ অনুৎকৃষ্ট অংশগুলো  একত্রিত করে সুন্দর চামড়া দিয়ে ঢেকে দিলেনযা দেখতে অনেক আকর্ষণীয় ছিলজিউস অনুষ্ঠানে আসলে প্রমিথিউস তাঁকে একটা স্তূপ বাছাই করতে বললেনজিউস বাইরের চাকচিক্যে আকৃষ্ট হয়ে হাড়গোড়ের স্তূপ বেছে নিলেনতখন থেকে প্রাণীদের হাড়গোড় চর্বি আগুনে পুড়িয়ে দেবতাদের উৎসর্গ করার রীতি চালু হয়ে গেল ঘটনাকে বলা হয় ট্রিক এট মিসোন 
ঘটনায় জিউস প্রতারিত এবং অপমানিত বোধ করতে লাগলেনএকই সাথে ক্রোধে অন্ধ হয়ে তিনি পৃথিবী থেকে আগুন তুলে নিয়ে যান, একবারে উৎসর্গের প্রথা বিলুপ্ত করতে চেয়েছিলেন তিনিপ্রমিথিউস অনেক চিন্তা করে হেফাস্টাসের কামারশালা থেকে আগুন চুরি করে একটি ফাঁপা খোলকে লুকিয়ে মানুষের কাছে দিয়ে গেলেনএই আগুনই  হল  মানব সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি আগুনের কারণেই মানব সভ্যতার বিকাশ এগিয়ে চলল দ্রুততার সাথেজিউস কিন্তু অলিম্পাস থেকে মানুষের অগ্রযাত্রা দেখেই প্রমিথিউসের ধোঁকার বেপারটা বুঝে ফেললেন প্রচন্ড ক্রোধিত হয়ে তিনি প্রমিথিউসকে দিলেন এক ভয়ানক শাস্তিতাকে ককেশাস পর্বতে অনন্তকালের জন্য বন্দী করে রাখার নির্দেশ দেওয়া হলশুধু তাই নয় প্রতিদিন শেকলবদ্ধ প্রমিথিউসের কলিজা ঠুকরে ঠুকরে খেতে এক ঈগল আসতঈগল সমস্ত কলিজা খেয়ে গেলে রাতে আবারো প্রমিথিউসের দেহে নতুন কলিজা তৈরি হত এবং পরের দিন ঈগল আবারো কলিজা খেত হারকিউলিকস পরবর্তীতে প্রমিথিউসকে রক্ষা করে 

জিউস সম্পর্কে আমরা পরের পর্বে আরো অনেক কিছুই জানব।