আমি একজন পড়ুয়া মানুষ ছিলাম। ছিলাম বলছি, কারণ আমার গত দেড় বছরে প্রায় কিছুই পড়া হয়নি বললেই চলে। কিছুদিন আগে দীর্ঘ সময় এবং আগ্রহ নিয়ে ‘দ্য আলকেমিস্ট’-এর অনুবাদ পড়লাম। মূলত দীর্ঘ সময় আমার লাগে না। দুইটা কারণে লেগেছে বলে আমি মনে করি। এক- অনেকদিন পর একটা দীর্ঘ উপন্যাস পড়লাম, তাই। আর দুই- অনুবাদটার সাথে আমি নিজেকে পুরোপুরি যুক্ত করতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, লেখকের সাথে পেরেছি বলে মনে হয়। সেই হিসেবে লেখাটার সাথেও যুক্ত হয়েছি। ভালোভাবে বা পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই হয়েছি।
এবার আসি উপন্যাস বিষয়ে। বইটা পড়ার পর আমি দুই-তিনটা রিভিউ পড়লাম এটা নিয়ে। বেশিরভাগই বলছে এটা রূপক এবং অনুপ্রেরণামূলক। এরপর গেলাম এটার ঘরানা জানতে, মানে জনরা। জনরাতে বলছে এটি “Quest, Adventure, Fantasy” টাইপ। এর মনমতো অর্থ খুঁজে পেলাম না। আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে এটি হচ্ছে একটি ‘অনুসন্ধান, অভিযান এবং কল্পগল্প’। সেইসাথে জানলাম- এটা লিখতে সময় লাগেনি, কিন্তু সফলতা পেতে সময় লেগেছিল। কাহিনিটার মতোই কাহিনি হলো লেখকের এই উপন্যাসটা নিয়ে। এছাড়াও উপন্যাসটা নিয়ে আরো অনেক তথ্য জানলাম । সেগুলো আর না-ই বা বলি, যেহেতু ইন্টারনেট ঘাঁটলে তা পাওয়া যাবে।
এরপর আমি বইটার ইংরেজি অনুবাদটা পড়েছি। যদিও আমার ইংরেজি জ্ঞান নাই বললেই চলে। যদি থাকতো, তবে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও বইটা নিয়ে লিখতাম। ইংরেজি পড়তে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। এরও কারণ আছে। প্রথমত- এটার অনুবাদ আগে পড়েছিলাম। দ্বিতীয়ত- এটা খুব সহজ ভাষায় লেখা। আর সাপোর্টিং হিসেবে ডিকশনারী, গুগল ট্রান্সলেটর তো আছেই। সিম্পল।
আমি মূলত বইটা পড়ার পর আমার যে অনুভূতি হলো তা এবং লেখকের সাথে আমার যে কাল্পনিক যোগাযোগ হলো তা নিয়েই লিখতে চেষ্টা করছি।
গল্পটা যতটা না মোটিভেশনাল, তার থেকেও বেশি ইন্সপিরেশনাল। এই দিকটা আমার বেশি ভালো লেগেছে।
এটা সান্তিয়াগোর জার্নি, তার লক্ষ্য পূরণের বা অর্জনের। এই জার্নিতে আমিও ছিলাম, কিংবা আমার বাস্তব জার্নিতে সেও আছে। দুইটা জিনিস লেখক আমাদের মাথায় প্রবলভাবে ঢুকিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। এক- কখনো লক্ষ্যচ্যুত হওয়া যাবে না। দুই- ভাগ্যকে অস্বীকার করা যাবে না। এই দুইটা জিনিসই আমার মাথায় গেঁথে ছিলো। আর তার জন্যই হয়তো লেখাটা আমার এতো ভালো লেগেছে। এই কাহিনিটা আমাকে আকর্ষণ করার আরো একটা কারণ হলো- উপন্যাসের উক্তিগুলো। এই উক্তিগুলো যে কাউকেই নবোদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে সহায়তা করবে। আমাদের যেমন রিডার্স ব্লক হয় কিংবা অনেক লেখকের যেমন রাইটার্স ব্লক হয়, এই ধরনের অনেক প্রতিবন্ধকতা দূর করবে আশা করি। লেখক আপনার ভেতরের আপনাকে জাগিয়ে তুলতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। আমার ক্ষেত্রে অনেকটা সফল হয়েছে। তবে এই সফলতা আসলে আপনার নিজের উপর নির্ভর। আপনি চাইলেই সেটা সম্ভব। নিজের ভেতরের গুপ্তধন খুঁজে বের করতে পারাটাই আসল।
জীবন কিন্তু একটা চলমান প্রক্রিয়া। আপনি সক্রিয় মানেই আপনি জীবিত। আপনি যখন আপনার লক্ষ্যস্থির করে সেদিকে এগিয়ে যেতে থাকবেন, তখন বাধা আসবেই। এটা স্বাভাবিক যে, আপনি পরাজিত হবেন-ই, অনেক ক্ষেত্রে বা সব ক্ষেত্রেই। পরাজিত হয়ে ভয় পেয়ে গেলে বা পরাজয়-ই শেষ কথা ভাবলে কিছুই অর্জন হবে না। ভয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ভয় যাতে আপনাকে নিয়ন্ত্রণ না করে। এটাই লেখকের মূলমন্ত্র ছিলো এই উপন্যাসে।
কাহিনিটাতে আধ্যাত্মিকতা যা দেখানো হয়েছে, তা দিয়ে মূলত ইচ্ছাশক্তিকে বুঝানো হয়েছে। আপনার জীবন সুন্দর তখনই হবে, যখন আপনি সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবেন।
সান্তিয়াগো যখন মরুভূমিতে বিচরণ করছিলো, আমি সেটা খুব অনুভব করতে পারছিলাম। আমার মাথায় তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ঘুরছিলো-
ইহার চেয়ে হতাম যদি
আরব বেদুয়িন!
চরণ-তলে বিশাল মরু
দিগন্তে বিলীন।
আরেকটা দৃশ্য আমার চোখের সামনেই ভেসে উঠেছিলো, একদম স্পষ্ট ছিলে সেই দৃশ্যটা। যখন সান্তিয়াগো বলছিলো ফাতিমাকে, “আমি তোমাকে ভালোবাসি, কারণ-”। বাক্যটা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই ফাতিমা তার আঙুল দিয়ে সান্তিয়াগোর ঠোঁট চেপে ধরে বললো, “তুমি আমাকে ভালোবাসো, কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো। এতে অন্য কোনো কারণের প্রয়োজন নেই”। কি অসাধারণ দৃশ্য!
“প্রতিটা দিনকে একইভাবে দেখে আপনি অন্ধ হয়ে যেতে পারেন। প্রতিটা দিনই আলাদা, তার নিজস্বতা আছে”– এই উক্তিটা আমার মধ্যে বিশাল একটা পরিবর্তন এনেছে।
ব্যর্থতাকে ভয় পেলে চলবে না। এতে অসফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তার আগে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে আপনি কী চান? আপনার জীবনের লক্ষ্য কী?
ধন্যবাদ লেখক পাওলো কোয়েলহো, আমাদের সুন্দর একটা উপন্যাস উপহার দেয়ার জন্য। যেটা নিছক একটা উপন্যাস নয়, জীবন দর্শনও বটে। আপনি যদি বই পড়ুয়া হয়ে থাকেন, তবে এই বইটা আপনার অবশ্যই পড়া উচিত। ভালো লাগার সম্ভাবনাই বেশি।
সবশেষে জানিয়ে রাখি, বইয়ের শেষদিকে দারুণ একটা টুইস্ট আছে। যেখানে উপন্যাসটা যেন আবার শুরু হয় শেষের দিক থেকে, আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে। রোমাঞ্চকর এই উপন্যাস পড়ে আপনিও সান্তিয়াগো’র অভিযানের সঙ্গী হোন।