“আমার মনে হয় না, লেখকের জন্য পুরস্কার ই শেষ গন্তব্য হতে পারে। এটা শুধুই একটি স্বীকৃতি। কোন নির্দিষ্ট পুরস্কার লেখকের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে না”। বিবিসি হিন্দিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন ১ম ভারতীয় হিসেবে ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার পাওয়া গীতাঞ্জলি শ্রী। গীতাঞ্জলির লেখা হিন্দি উপন্যাস ‘রেত সমাধি’ এর জন্যই সম্প্রতি লন্ডনে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় বুকার পুরস্কার। পদকের সঙ্গে ৫০ হাজার পাউন্ড অর্থ পেয়েছেন তিনি। তাঁর বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ডেইজি রকওয়েল, যার নাম ‘টুম্ব অফ স্যান্ড’। পুরস্কারের অর্থ তাঁর সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন গীতাঞ্জলি।
ছেলেবেলা থেকেই হিন্দি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তাঁকে আর দশটা বাচ্চা থেকে আলাদা হয়ে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। গীতাঞ্জলি শ্রীর জন্ম হয় ১২ জুন ১৯৫৭ সালে উওরপ্রদেশ রাজ্যের মইনপুরী শহরে। তাঁর বাবা অনিরুদ্ধ পান্ডের সরকারি চাকুরির সুবাদে ছেলেবেলা কাটে উওরপ্রদেশের বিভিন্ন শহরে। ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক এ বৈচিত্রতার মধ্য দিয়ে গীতাঞ্জলির শৈশব পার হয়। গীতাঞ্জলি শ্রীর নাম আগে ছিল গীতাঞ্জলি পান্ডে। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া নাম গীতাঞ্জলি পান্ডে বদলে মায়ের নামে গীতাঞ্জলি শ্রী রাখেন। ছেলেবেলায় প্রথম সাহিত্যে হাতে-খড়ি বলতে মূলত বিভিন্ন হিন্দি ম্যাগাজিনে বইয়ের উদ্ধৃতি পড়া থেকে। তারপর থেকে আস্তে আস্তে গোগ্রাসে গিলতে থাকেন রামায়ণ, মহাভারত, পরাগ, আরব্য রজনীর মতো বই। ইংরেজি ভাষার আর দশটা বাচ্চার চেয়ে নিজ ভাষার সাহিত্যে যে পটু ছিলেন তা আর বলতে!
গীতাঞ্জলি দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজ এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা করেন। নিজ ভাষার সাহিত্যের পাশাপাশি গীতাঞ্জলি জাপানি ও ল্যাটিন সাহিত্যে ও আগ্রহী ছিলেন। গীতাঞ্জলি শ্রী তাঁর গবেষণার বেশিরভাগ অংশেই মুন্সি প্রেমচাঁদের সাহিত্য নিয়ে আলোকপাত করেন। স্নাতকের পাঠ চুকিয়েই লেখালেখির দিকে ঝুঁকে পড়েন। তাঁর প্রথম গল্প, ‘বেল পত্র’(১৯৮৭), প্রকাশিত হয় সাহিত্য সাময়িকী ‘হান্স’- এ। তবে তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন তাঁর লেখা, ছোটগল্প সংকলন, ‘অনুগঞ্জ’ (১৯৯১) প্রকাশিত হবার পর। তাঁর পর থেকে দ্যুতি ছড়িয়েছেন সাহিত্যের নানা শাখায়। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি ‘মাই’ (মা) উপন্যাস দ্বারা আরেক বার তাঁর জাত চেনান। উত্তরভারতীয় মধ্যবিত্ত পরিবারের তিন প্রজন্মের নারী এবং তাদের চার পাশের পুরুষদের নিয়ে। পিতৃতন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ তিন প্রজন্মের এ নারীদের গল্পগুলো তিনি বুনেছেন নিপুন হাতে। সব ধরনের পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এ গল্প নানা ভাষায় অনুদৃত হয়। এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন নীতা কুমার এবং বশির আনওয়ান এটি উর্দুতে অনুবাদ করেন। এর ভূমিকা লিখে দেন বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক ইন্তিজার হোসেন। অ্যানি মন্টাউট এবং রেইনহোল্ড শেইন জার্মান যথাক্রমে এর ফরাসি ও জার্মান অনুবাদ করেন। শ্রীর পরবর্তী উপন্যাস ‘হামারা শেহের উস্ বারাস্’ ও একইভাবে সমাদৃত হয়। ধর্মীয় উন্মাদনা ও একে ঘিরে বেড়ে ওঠা অস্থিরতার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছবিগুলো গীতাঞ্জলি একটি এলবামে সাজিয়ে পাঠকের কাছে মেলে ধরেছেন। এতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কিছু ঘটনা উঠে এসেছে। তাঁর পরবর্তী ও চতুর্থ উপন্যাস, খালি জাগাহ (২০০৬), ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন নিবেদিতা মেনন ‘দ্য এম্পটি স্পেস’ নামে। এর ফরাসি এবং জার্মান অনুবাদ ও হয়েছে। তাঁর পরবর্তী কাজ ‘তিরোহিত’ ও সমানভাবে প্রশংসিত হয়।
এত সব প্রশংসনীয় কাজের পর ও তিনি স্মরনীয় হয়ে থাকবেন, তাঁর অনন্য সৃষ্টি, ‘রেত সমাধি ‘ এর জন্য; যা তাঁকে এনে দেয় ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের স্বাদ। এর প্রশংসা করে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারজয়ী লেখিকা অলকা সারাওগি বলেন, “its sweeping imagination and sheer power of language, unprecedented and uninhibited”; যার অর্থ দাঁড়ায় “ এর বিস্তৃত কল্পনাশক্তি এবং ভাষার বিশেষ ক্ষমতা অভূতপূর্ব এবং বাধাহীন”। ‘রেত সমাধি’ উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট ১৯৪৭ সালের দেশভাগ। দেশভাগের আবহে গড়ে ওঠা এ গল্পের মূল চরিত্র ৮০ বছর বয়সী এক নারী, স্বামীর মৃত্যুর পর যে নিজের অন্য এক সত্তা খুঁজে পায়। গীতাঞ্জলি বলেন, ‘‘আমি অনেক বৃদ্ধাকে দেখেছি যাঁরা গোটা দিন বিছানায় শুয়ে কাটায়। আমাদের দিকে পিঠ করে থাকেন তাঁরা। আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে, তাঁরা কি আমাদের দিকেই পিছন ফিরে থাকেন, না জীবনের থেকে।” এমনটিই ঘটেছে ‘রেত সমাধি’র মূল চরিত্রের সাথে। স্বামীর মৃত্যুর পর বিষন্নতায় চলে যাওয়া অশীতিপর নারী চরিত্রটি যেন অস্তিত্ব সংকটে ভোগা সকল নারীর পক্ষ থেকে বলে, “না, না, আর আমি উঠবো না”। তাঁর ছেলে-মেয়েরা যেন তাঁর ভিতর হারিয়ে যাওয়া আরেকটি সত্তা। তারা চিৎকার করে বলে উঠে, “উঠো মা, বাবা মারা যাবার সময় যেন তোমাকেও সাথে করে নিয়ে গেল”। এক সময় তিনি জেগে উঠেন তাঁর চিরাভ্যস্ত জড়তা থেকে; নতুন করে খুঁজে ফেরেন জীবনের মানে। মৃত্যু মানে তো শেষ নয়, বরং নতুন কিছু শুরুর ধাপ মাত্র। এ গল্প ভারত ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে সব দেশের এবং সব বয়সের মানুষের মাঝে। দেশ-কাল-বয়স-লিঙ্গ এ সবের বর্ডার বা সীমানা পেরিয়ে এ গল্প যেন সার্বজনীনতার কথা বলে, এক অভিন্ন রাষ্ট্রের কথা বলে।
হিন্দিতে লেখা ‘রেত সমাধি’ ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়। পরে উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ডেইজি রকওয়েল যা ‘টুম্ব অব স্যান্ড’ নামে যুক্তরাজ্যে প্রকাশিত হয়। এটি যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত গীতাঞ্জলি শ্রীর প্রথম বই। ‘রেত সমাধি‘ হিন্দি ভাষায় লেখা প্রথম বই যেটি আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার পেল। এর আগে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার কোন নাগরিকই এ পুরস্কারের লাভ করেন নি। তবে ইংরেজিতে লিখে বুকার ও ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছেন অরুন্ধুতী রায়, ভি এস নাইপল, সালমান রুশদি, কিরন দেশাইয়ের মতো লেখকেরা। কিন্তু তারা কেউই নিজ ভাষায় লিখে এ পুরস্কার পান নি। গীতাঞ্জলি শ্রী আর দশজন লেখকের মতো ইংরেজিতে লিখে খ্যাতি পেতে চান নি। শুধুমাত্র নিজ ভাষায় লেখার কারনে যে তাঁর বই আন্তর্জাতিক মাধ্যমে ওতোটা পৌঁছতে পারবে না তা তিনি ঠিক ই বুঝেছিলেন। কিন্তু ওই যে, লেখক মাত্রের ই পুরস্কার বা প্রশংসা পাবার জন্য লেখা উচিত না, তা তিনি মনে গেঁথে নিয়েছিলেন শক্ত করে। লেখকের শক্তি যে তার কলম; গীতাঞ্জলির লেখার এত শক্তি যে তাকে কারো কাছে যেতে হয় নি; বিদেশি অনুবাদক ডেইজি রকওয়েল নিজে উড়ে এলেন গীতাঞ্জলির এ অনবদ্য সৃষ্টি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। রকওয়েল মূল হিন্দি উপন্যাসের মৌলিকতা বজায় রেখে নিপুণভাবে ভাষান্তরিত করেন। রকওয়েলের মতে, ‘‘লেখক ও অনুবাদকের সম্পর্ক দুই বলরুম ডান্সারের মতো। সঙ্গত ঠিক মতো হলে অপূর্ব শিল্পকীর্তি সৃষ্টি হতে পারে।’’ নিজে নারী বলেই কিনা নারী লেখকদের লেখা অনুবাদ করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
গীতাঞ্জলি তাঁর এই জয়কে নিজের জয় মানতে নারাজ৷ এই জয় হিন্দি এবং দক্ষিণ এশিয়ার জয়। তিনি মনে করেন এ মাটির আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা অসাধারণ লেখনীগুলো বিশ্ব দরবারে পরিচিতি পাওয়ার ক্ষেত্রে এবার আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল।
শর্টলিস্টে থাকা আরো পাঁচজনকে পেছনে ফেলে এবারের বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ জেতা গীতাঞ্জলি উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলেন, “আমি কখনোই বুকারের স্বপ্ন দেখিনি। এই পুরস্কার পেতে পারি, তা কখনো ভাবিনি… বিশাল স্বীকৃতি! আমি বিস্মিত, আনন্দিত, সম্মানিত ও শ্রদ্ধাবনত।’ এও জানান হিন্দি সাহিত্যের কোনো বই প্রথম আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার পাওয়ায় তিনি আনন্দিত। ভাষাগত ও অবস্থানগত পার্থক্য যে আসলে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না এ পুরস্কার যেন তাই বলে দেয়। এ পুরস্কার যেন তাঁর পুরস্কার জয়ী উপন্যাসের মতোই দেশ-কাল-ভাষা-লিঙ্গের সকল বেড়াজাল ভেঙে দেবার জথা বলে।