বাংলাদেশ সম্পর্কে মানুষ আর কিছু জানুক বা না জানুক একটা তথ্য সবারই জানা। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। একইরকম আরেকটি তথ্য বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ নিয়ে ইদানিংকালের কিছু ঘটনায় কিছু দোটানা তৈরি হলেও বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে উল্লেখ্য করার মধ্যে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
আমাদের শরীরের রক্তের শিরা উপশিরার মতোই এই দেশের বুক চিরে বয়ে গেছে অসংখ্য নদ-নদী। স্বভাবতই তাই আমাদের জীবনযাত্রার সাথে নদী নালা মিশে গেছে আত্নিকভাবে। তাই আমাদের কাছে নদী শুধুই সাগরের সাথে যুক্ত প্রাকৃতিক পানির বয়ে যাওয়া স্রোত নয়, নদী হয়ে উঠেছে একটা জীবন্ত চরিত্রের মত। সেটা কখনওবা ফসলের মাঠে পানির উৎস জুগিয়ে পরম মমতাময় আবার কখনও ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়া যাওয়া সর্বনাশী রুপে।
এতো নিবিড়ভাবে যে সাথে জাতির সাথে নদীর সম্পর্ক, তাদের জন্য একটা ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে গত ৪৭বছরে আমাদের দেশের প্রায় অর্ধেক নদী শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে এতো ভয়াবহ হারে নাহলেও নদী শুকিয়ে যাওয়া কোন নতুন ঘটনা না। অতীতেও এইরকম ঘটনা ঘটেছে [সূত্র]। আর নদী শুকিয়ে যাওয়ার সেইসব ঘটনা নিয়েও রয়েছে অদ্ভুত সব উপকথা। আজকে তেমনি একটা শুকিয়ে যাওয়া নদীকে কেন্দ্র করে লোকমুখে প্রচারিত ঘটনার কথা জানাব আপনাদের। তো চলুন শুরু করা যাক।
আড়িয়াল খাঁ কিশোরগঞ্জ আর নরসিংদীর বুকচিড়ে বয়ে চলা একটি নদী। এইনদীরই একটা উপশাখা চলে গেছে বাহেরচর আর চরসুবুদ্ধি এই দুই গ্রামের মাঝখানে সীমানা তুলে দিয়ে। এককালে মেঘনা নদীর অঢেল পানির উৎসে কলকল করে বয়ে যাওয়া আড়িয়াল খাঁ নদীর মতো এই শাঁখা নদীটিও ছিল তেমনি প্রবাহমান আর উচ্ছল। নদীর পাড় ঘেঁসে বসা চরসুবুদ্ধি বাজারে দূর দুরান্ত থেকে জিনিস পত্রের পসরা নিয়ে হাজির হতো শত শত লোক। তাদের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে থাকতো পুরো বাজার। তখনও সেসব গ্রামে নলকূপের প্রচলন ঘটেনি। পানির উৎস বলতে ছিল এক এই আড়িয়াল খাঁর শাঁখা নদী অথবা নিজ বাড়িতে খনন করে নেয়া কূপ। তবে এই কোয়া বা কূপ খননের খরচও ছিল বেশ। সুতরাং গ্রাম দুটির অধিকাংশ মানুষের পানির প্রধান উৎস ছিল এই নদী।
দল বেধে ছেলে ছোকরাদের নদীতে ধাপাধাপি করা, অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থানে গৃহবধূদের স্নান করা বা কলস কাঁখে পানি নিতে আসা ছিল একটা চিরাচরিত দৃশ্য।
অপেক্ষাকৃত কম স্রোতের এইনদীটির সাথে দুইপাড়ের মানুষের যেন একটা আত্নিক বন্ধনই গড়ে উঠেছিল।
কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হলোনা সে বন্ধন। .
চরসুবুদ্ধি আর বাহেরচরের মানুষের এপার ওপার আসা যাওয়া ছাড়া নদীতে দূর দুরান্ত থেকেও অনেক নৌকা ভেসে আসত। এসব নৌকার কোনটা বা যাত্রীবাহী আবার কোনটায় ভরে নেয়া যাওয়া হতো ব্যবসার না উপকরণ। এমনি মালবাহী এক নৌকার মালিক সাতটি বড় নৌকাবোঝাই করে চুন নিয়ে যাচ্ছিল নদীর উপর দিয়ে।
দুরপাল্লার নৌকা। এবার ফসলের পুরো টাকা দিয়ে দূরের এক চুনের ভাটা থেকে চুন কিনেছে সে। গ্রামে ফিরে বিভিন্ন হাটে হাটে বিক্রি করবে সে এই চুন। বেশ ভালো লাভের আশা নিয়েই সে ফিরছিল। মূল নদী পেরিয়ে যখন সে এই শাঁখা নদীতে প্রবেশ করেছে তখন দিনের আলো নিভে এসেছে। একটু পরেই আকাশে চাঁদ উকি দেয়ায় পথ চলতে কোন সমস্যাই হচ্ছেনা তাদের। পালের হাওয়ায় নৌকা চলেছে তড়তড়িয়ে। সবার সামনে মহাজন পথ দেখিয়ে চলেছে আর তাকে অনুসরণ করে এগোচ্ছে বাকি ছয় নৌকা। নৌকা তখন চলেছে চরসুবুদ্ধি আর বাহেরচর গ্রামের মাঝখান দিয়ে। হঠাৎ করে যেন বদলে গেল বাতাসের আচরণ। এতোখন তীরতীর করে বাতাস বইছিল এবার শুরু হলো দমকা হাওয়া। একটু পরেই মেঘে ঢেকে গেল পুরো আকাশ। চারদিকে ঘনিয়ে আসলো ঘন অন্ধকার। চিন্তিত মুখে বাতাসে কানপাতলো মহাজন। ভয়ানক একটা কিছু একটা আঁচ করে মাঝিদের নৌকা পাঁড়ে বেড়ানোর কথা বলার আগেই শুরু হলো ঝড়। সেকি বাতাসের তান্ডব। মুহূর্তের মধ্যেই যেন উলটপালট করে দিল সব। সে ঝড়ে মহাজন আর তার চুনভর্তি সাত নৌকাযে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল তার কোন দিক নিশানা পাওয়া গেলনা।
সকাল যখন হয়েছে তখন ভোরও হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে জনকোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠতে শুরু করলো নদীর পাঁড়। বিভিন্ন পাঁড় থেকে পাওয়া গেল সাত মাঝি আর মহাজনের লাশ।
সেই সপ্ত নৌকার আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনার কিছুদিন পর থেকেই হঠাৎ করে শুকিয়ে যেতে শুরু করলো নদীটি। সবাই আশায় রইল, এ হয়তো সাময়িক খরা। কিন্তু ভরা বাদলের পরও নদীর পানিতে নৌকা ভাসানোর অবস্থাও থাকলোনা। এরপর একসময় ধীরে ধীরে হারিয়েই গেল এই নদীর দিক নিশানা।
নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণ আর যাই হোক, গ্রামের মানুষের বিশ্বাস সেই সপ্ত নৌকা ভর্তি চুন শুষে খেয়ে ফেলেছে নদীর সব পানি।