আমাদের মধ্যে অনেকেরই হয়তো গল্পের বই পড়ার সূচনা হয়েছে ঈশপের গল্প পড়ার মধ্য দিয়ে। অত্যন্ত সহজ ভাষায় বর্ণিত, বিভিন্ন জীব, জন্তু ও প্রাণীদের নিয়ে মজার মজার উপদেশমূলক সে গল্পগুলো আমাদের ছোটবেলাকে রাঙিয়ে দিয়ে গেলেও এইসব গল্পের স্রষ্টা ঈশপ সম্পর্কে আমরা প্রায় বলতে গেলে কিছুই জানিনা। কে এই মহান ব্যক্তি ঈশপ? আসলেই কি এই নামে কেউ ছিল? নাকি এই চরিত্রটি কেবলি অন্য লেখক/লেখকদের কল্পনা প্রসূত একটা চরিত্র?
চলুন সে ব্যাপারে একটু খোঁজ নেয়া যাক।
ঈশপের জীবন
ঈশপ নামে সত্যি সত্যি কারও থাকা নিয়ে রয়েছে ঘোর মতপার্থক্য। কোন কোন ইতিহাসবিদের মতে ঈশপ নিছকই একটি কাল্পনিক চরিত্র। প্রথম দিকে হয়তো কোন লেখক বা গল্পকার এই নামে কিছু গল্প প্রচার করার পর ধীরে ধীরে এই চরিত্রটি এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠে যে পরবর্তীতে এই ধাঁচের আরও অনেক গল্পকেই তাঁর নামের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। তবে সবাই এই যুক্তির সাথে একমত নন। একমত না হওয়ার অবশ্য একটা কারণ আছে। কারণটি হল, গ্রিকের ইতিহাস ঘাটলে সত্যি সত্যিই কিন্তু একজনের ঈশপের দেখা মেলে। বিভিন্ন জায়গায় টুকরো টুকরোভাবে উল্লেখ্য পাওয়া যায় তাঁর সম্পর্কে।
সেইসব উল্লেখ্য থেকেই ধারণা করা হয়যে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬২০ থেকে ৫৬০ পর্যন্ত ছিল ঈশপের জীবনকাল। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন মূলত একজন ক্রীতদাস। কিন্তু সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ও গল্প বলার অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে পরবর্তীতে মালিক তাকে মুক্ত করে দেন। গ্রিক দার্শনিক এরিষ্টটল এর মতে, ঈশপের জন্মস্থান ব্ল্যাক সি এর উপকূল ঘেঁসে থ্রেস নামক একটি স্থানে। যেটি পরবর্তীতে মেসেমব্রিয়া নামক শহরে রুপান্তরিত হয়। কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত কিছু চিঠিপত্রে আবার তাঁর জন্মস্থান হিসেবে ফ্রিজিয়ার নাম উল্লেখ্য করা হয়। গ্রিক কবি কালিমাকাস এক জায়গায় তাঁকে “Aesop of Sardis” বা “সার্দ্দি’র ঈশপ” হিসেবে উল্লেখ্য করেন।
যাহোক, ঈশপের জন্মস্থান নিয়ে বেশ মত পার্থক্য দেখা গেলেও তাঁর বাকি পরবর্তিত জীবন নিয়ে মোটামুটি প্রায় এইধরনের একটা উল্লেখ্য পাওয়া যায় যে, ক্রীতদাস থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিনি ঘটনাক্রমে এসে পৌঁছান রাজা ক্রোইসাসের দরবারে। রাজা ক্রোইসাস ঈশপের বিচক্ষনা দেখে খুবই অবাক হয়ে যান। পরবর্তীতে তিনি ঈশপকে তাঁর রাজদরবারেই রেখে দেন এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অঞ্চলে ঈশপকে তাঁর সদুপদেশসমৃদ্ধ গল্পগুলো প্রচারের জন্য পাঠাতে থাকেন।
ঈশপের মৃত্যু
ঈশপের জন্ম ও জন্মস্থানের মতই তাঁর মৃত্যু নিয়েও রয়েছে রহস্য। এরিষ্টটল ও হিরোডোটাস এর বক্তব্যে ঈশপের জীবনের অন্যান্য ঘটনাবলীর উল্লেখ্য থাকলেও এই দুজনের কারও বক্তবেই ঈশপের মৃত্যু নিয়ে কোন মতামত পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয়যে, ঈশপ যখন রাজা ক্রোইসাসের অধীনে তাঁর উপদেশমালা প্রচারের জন্য ডেলফি নামক একটি স্থানে পৌঁছান। সেখানে কিছুদিন তাঁর অবস্থান করার পর তাঁর প্রজ্ঞা, মানুষকে মোহিত করা ও গল্পবলার অদ্ভুত ক্ষমতায় ক্রমশ ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেন সেখানকার স্থানীয় মন্দিরের পুরোহিতরা। তাঁর বক্তব্য ধর্মবিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক ভেবে মনগড়া বিভিন্ন আইনে একের পর এক অপরাধে তাঁকে দোষী করা করা হয়। ধারণা করা হয় সেসব আইনেই তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ড দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এই মহান ব্যক্তিকে।
ঈশপের গল্প
ঈশপের নামে প্রায় ছয় শতাধিক গল্প বা উপকথা বর্তমানে প্রচলিত আছে। তাঁর সবগুলো গল্পই মূলত অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় বর্ণিত। যেগুলো মূলত শিশুদের প্রতি লক্ষ্য রেখে বলা এবং প্রতেকটা গল্পের মধ্য দিয়েই একটা উপদেশ বা শিক্ষা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মজার কথা হচ্ছে তাঁর রচিত/প্রচলিত অধিকাংশ গল্পের চরিত্রই বিভিন্ন জীব জন্তু। যারা আবার দিব্বি মানুষের মত কথা বলতে পারে। তাঁর কিছু বহুল প্রচলিত গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, রাজহাঁস ও সোনার ডিম,খেঁকশিয়াল ও আঙ্গুর বা আঙ্গুর ফল টক এবং কচ্ছপ ও খরগোশের গল্প।
ঈশপের এইসব গল্পগুলো শত শত বছর ধরে নৈতিক শিক্ষা প্রদান করে আসছে। বিভিন্ন বিনোদনধর্মী ব্যবস্থা বিশেষতঃ শিশুদের খেলাধূলায় ও কার্টুনের বিষয়বস্তু হিসেবেও এ উপ-কথাগুলো প্রয়োগ করা হয়।ঈশপ তাঁর অদ্ভুত মোহময় ভঙ্গিতে এইসব গল্পগুলো উপস্থাপন করেছেন যা তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।
পরবর্তীকালে অনেক বিখ্যাত লেখকরাও তাঁর এ সকল উপ-কথাগুলো সংগ্রহ করে বিশ্বসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে রেখে গেছেন যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার। এ সকল উপকথাগুলোই পাশ্চাত্য সাহিত্য ও পল্লীসাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।
তথ্যসূত্রঃ