Site icon খিচুড়ি

একটি অপ্রকাশিত প্রেমপত্র

প্রিয়,
খুব ইচ্ছে ছিল একটা চিঠি লেখার। কিন্তু হঠাৎ করে যেন সবকিছুর ভোল পাল্টে গেল। চিঠির বদলে ইমেইল এসে সেও চ্যাটিং নামক অদ্ভুত কমুনিকেশনের খপ্পরে পরে অফিস আদালত আর ফর্মালিটির মাধ্যম হয়েই রয়ে গেল। ফলে, গুছিয়ে কিছু লেখার, কিছু বলার সুযোগ আর নেই বললেই চলে। দিনতো পালটে গেল কিন্তু আমি পুরনো কালের কলের গানের মতো অথর্ব হয়ে রয়ে গেলাম।  চ্যাটে হাই হ্যালোর ভিড়ে কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলি তার কোন আগামাথা নেই। ঠিক যেমন আধুনিক হাই ডেফিনেশন অডিও এর পাশে ফ্যাসফ্যাসে ঝিরঝিরে কলের গান।
আমি জানি উপরোক্ত কথাগুলো তোমার মান্দাতার লাগবে। এক রাশ বিরুক্তিভরে এড়িয়ে যাবে লাইনগুলো। কিংবা ভাববে পাগলের প্রলাপ। তোমার দোষ নেই, আমি নতুন যুগে জন্মেও পুরনোকে আঁকরে রেখেছি, এটা আমার দোষ।

একটা ঘটনা বলি, শোন।

আমি তখন ছোট, ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ি। একদিন স্কুল থেকে ফিরেছি, বই রেখে বাইরে বেরোব এমন সময় আমার চোখ গেল আমাদের আমার পড়ার ঘরের দিকে। তখন প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে, শেষ বিকেলের রোদ এসে পড়েছে পড়ার ঘরের জানালায়। সেই আলোতেই দেখলাম আমার বড় আপু লুকিয়ে লুকিয়ে কি যেন একটা পড়ছে। খানিকটা পড়েই আবার লুকিয়ে ফেলে চারপাশটা  কেমন সন্তর্পণে দেখে নিচ্ছে। খুব কৌতুহল হল আমার। এগিয়ে গিয়ে খুব গম্ভিরভাবে জিজ্ঞেস করলাম,
– কি পড়িসরে আপা!
বড় আপু  হঠাৎ আমার আগমনে কেমন থতমত হয়ে খেয়ে গেল যেন। সেবার নকল করতে গিয়ে স্যারের হাতে ধরা খেয়ে আমাদের ক্লাসের ইয়াহিয়া যেভাবে চমকে উঠেছিল ঠিক তেমনিভাবে চমকে উঠতে দেখলাম ওনাকে। মুহূর্তে কাগজখানা কোন একটা মোটা বইয়ের ভেতরে চালান করে দিয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন,

যদিও তিনি নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে নিয়ে কথাগুলো বললেন। কিন্তু আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম বড় আপু কেমন তিরতির করে কাঁপছেন। বিকেলের রোদ পড়েছিল তার মুখে, সে রোদের কারনেই কীনা জানিনা হঠাৎ করে ওনার মুখটা কেন লাল হয়ে উঠল বুঝতে পারিনি।
সেই কাগজখানা অবশ্য পরে আমি বইয়ের ভেতর থেকে উদ্ধার করেছিলাম। পড়েওছিলাম। সেই প্রেম পত্রের মর্ম তখন বুঝতে পারিনি।
যখন রাত জেগে বড় কাকু পাতার পর পাতা ছিড়ে গুছিয়ে লিখতে গিয়ে বারবার ভুল করে নিজের উপর রাগ করেই বাইরে পেতে রাখা বেঞ্চিতে ঠায় বসে রাত কাটিয়ে দিতেন, তখনও বুঝতে পারিনি।
বুঝতে পারলাম আজ, যখন তোমাকে লিখতে বসলাম। যে শব্দগুলোকে এতোদিন “আবেগি” , “সস্তা” কিংবা “ফেলনা” ভেবে নিজের সাহিত্যকর্মে স্থান দেইনি আজ দেখো জীবনের সবচেয়ে বড় সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে কেবল ঘুরে ফিরেই সেগুলো ব্যবহার করছি।
যাহোক, তোমার সাথে পরিচয়ের এতোদিন পরে এসে হুট করেই আজযে তোমাকে প্রেম নিবেদন করার জন্য এই চিঠি লিখছি সেটা নিশ্চয় এতোখনে বুঝে গিয়েছ। কিন্তু দুঃখজনক ব্যপারকি জানো, আমি যে বস্তুটার জন্য আজ রাত জেগে যে এতো কথা লিখছি সে বস্তুটা যে ইতোমধ্যে অন্যকেউ দখল করে ফেলেছে এ কথা কিন্তু আমি জানি। তারপরও অন্যায়টা করছি, দোষ নিওনা। আমি বলতে চাইনি, তুমিই আজকে অভয় দিয়েছ বলতে।

রাত প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। আর বেশি কিছু লিখবনা, তুমি পুরো লেখাটা পড়বে কীনা জানিনা। হয়তো পড়বে, তারপর ভ্রূ কুঞ্চিত করে ট্যাবটা ক্লোজ দিবে। আজকাল তো আর কারো ফোনের স্ক্রিনে কেউ তাকায় না, সুতরাং এই লেখাটা তোমার লুকিয়ে লুকিয়েও পড়তে হবেনা। কেউ দেখে ফেলার ভয়ে তোমার তিরতির করে কাপতেও  হবে না, লজ্জায় হয়ে উঠতে হবেনা লালও । তোমার এসব কিছু করা না লাগলেও দেখো কি আজব নিয়ম, আমি কিন্তু বড় কাকুর মত রাত জেগে চিঠি লিখছি। বারবার ভুল করছি, কাটছি, আবার লিখছি। একটুও ব্যতিক্রম নেই। কেবল এই শহরে বাইরে পেতে রাখা বেঞ্চি নেই, কিন্তু বেলকনি আছে। আজকে রাতটা বোধহয় আমার বেলকনিতেই কাটবে, নির্ঘুম!
তোমায় ভেবে অনেক কবিতাই লিখেছি, আজকে আরো একটা লিখলাম। এটাই বোধহয় শেষ। এটাকে কবিতা না ভেবে উপদেশ যদি ভাবো, ভেবে নিও। আমার আপত্তি নেই। 

Exit mobile version