অন্ধকারের ছায়া – ৪

চার 

ধান রোপনের সময়টা শাহজাহানদের মত কামলাদের কাছে একটা আনন্দের সময় হয়ে উঠে। ভূঁইয়াদের দক্ষিন ঘরে জমে উঠে তাদের আড্ডা। গোয়ালঘর লাগোয়া ঘরটায় ভূঁইয়াদের সারা বছরের জ্বালানি ডাল পাল আর গরুর খড়ের সাথে এইসময়টায় ময়মনসিংহ থেকে আসা কামলাদেরও ঠাঁই জমে । দিনভর পরের খেতে পরিশ্রম শেষে অনেকটা রাত ধরে আড্ডা চলে তাদের । তাদের আড্ডা শুধু যে দু দান তাস পিটানো কিংবা দু একটা হাসরসাত্নক কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা নয় । সেই আড্ডার বৈচিত্রটা ‘জবর’ ।
যে যত আজব জিনিস দেখেছে শিখেছে তা দিয়ে যেন চলে একটা ছোটখাট প্রদর্শনী ।সন্ধরাতে বাইরের উঠোনে হয় তার উদ্ভোবন । বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘিরে ধরে তাদের । বউরা দরজার কোন দিয়ে তাকিয়ে দেখে কখনও বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে আবারও কখনও মুখে আচল দিয়ে হাসি চাপতে গিয়ে হিমশিম খায় ।

শাহজাহান আজকে সন্ধা হতে ভাত খেয়ে এসে দেখে আড্ডা জমে গেছে।বাইরের ইলেকট্রিক বাতিটা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে । লাল আলোয় কিছু আঁধারে আলো পরিবেশ। বাতিটা থেকে একটু দক্ষিনে যে আম গাছটা তার পাশে চেয়ার পেতে বসেছে ইমান ভূঁইয়া।
: শাজান মিয়া দেড়ি কইরা ফেলছ ।টুনু মিয়া যে খেইল দেহাইল ।
ইমান ভূঁইয়া হেসে বলে। শাহজাহান রা করেনা। রা করার সুযোগও পায়না ।
নজু মিয়া নাকি কার গেছে এক পয়সাকে দু পয়সা করার ম্যাজিক শিখে এসেছে ।এখন তারই প্রদর্শনী হবে। আড্ডার দর্শকদের ভিড়ে একটা জায়গায় বসে পড়ে শাহজাহান।
নজুর ম্যাজিক শুরু হয়ে গেছে।
খুব গম্ভির হয়ে চোখ বুজে সে দাড়িয়ে রইল কিছুখন । মুখ বিড়বিড় করে যেন মন্ত্র পড়ল কিছুখন ।
তারপর বেশ হাত নেড়ে পকেট থেকে একটা এক টাকার কয়েন বের করে সেটা সবাইকে দেখল ।
ভূঁইয়া তার তিন ব্যাটারির লাইটের আলো ফেললেন নজু মিয়ার হাতে ।হ্যা , এবার ভাল দেখা যাচ্ছে । এক টাকার লাল কয়েন।
কয়েনটা এবার হাতের মধ্যে পুরে আবার বিড়বিড় করতে মন্ত্র শুরু করে সে । চারদিকে নিশ্চুপ ।সকলের দৃষ্টি নজু মিয়ার হাতে।
হঠাত্ করে বুড়ো হায়দার কাশতে শুরু করে। সে বসেছে শাহজাহানের পাশেই । একটা ভাঙা পিড়িতে বসে এতখন ফুকফুক করে বিড়ি টানছিলো সে।
ম্যাজিকের আড়ষ্টতায় হয়তো শেষবার ধোয়া ছাড়তেও ভুলে গিয়েছিল। কাশির দমে দমে ধোয়া ও বেরিয়ে আসছে নাকমুখ দিয়ে সমানে। শাহজাহান তাকে একটা কড়া কথা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল ।
নজু মিয়া হাত খোলছে।আস্তে আস্তে । তারমুখে এক চিলতে হাসি ।হঠাত্ করে সে এক ঝটকায় একটা হাত সরিয়ে ফেলল ।অমনি সেখানে পড়ল লাইটের আলো । একটা পয়সা দুটো হয়ে গেছে । শাহজাহান খেয়াল করল দ্বিতীয় পয়সাটা লাল নয় ।রুপালী । লাইটের আলো পড়ে সেটা চিকচিক করছে।
খেলা চলল এশার আযান পর্যন্ত।

অন্ধকার বেশ ঝেকে বসেছে। শাহজাহান ভূঁইয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছোট রাস্তাটায় উঠে পড়ে। বেশ চিন্তা জমেছে মনে।সেইদিনের কুড়িয়ে পাওয়া মাফলারটা পরে সে আজ আড্ডায় গিয়েছিল। ভূঁইয়ার পেছনে বারান্দায় একটা কাঠের উঁচু পিড়ির উপর বসেছিল কবির মোল্লা। শাহজাহানকে দেখে সে যেন কেমন চমকে উঠেছে। আসার সময় আবার জিজ্ঞেসও করেছে কোথা থেকে সে এটা পেয়েছে।
তবে কি মাফলারটা কবিরেরই ?
সেইকি তবে সত্যিই করিম মোল্লা কলা চুরি করেছে ?
দুটো জিনিস কেমন যেন মিলমিশ লাগে শাহজাহানের।
ঘরে এসে সটান বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে সে। নিচে চটের উপর ছেড়া কাঁথা বিছিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে শুয়েছে তার বউ।সহসা তাদের দেখে কেমন যেন হয়ে পড়ে সে। নাহ! এবারের ফলকটা গেলে যে টাকা পাবে সে টাকা দিয়ে একটা চৌকি কিনে আনবে সে।
কালকেই ভূঁইয়া কাছে দাম জিজ্ঞেস করবে।

মাঝ রাত্রে হঠাত্ ঘুম ভেঙ্গে যায় শাহজাহানের।ভয়ঙ্কর একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। তার দুদিকে দুটি অথৈ নদী। মাঝখানে একটা এক চিলতে মাটি।সেখানে শুয়ে আছে শাহজাহান।হঠাত্ করেই যেন দুপাশ থেকে লাফিয়ে উঠে দুটো প্রকান্ড সাপ ।
তবে কি কোন বিপদে পড়তে যাচ্ছে সে ?

রাত্রে আর ঘুম হয়না। ফজরের একটু পরেই দড়িতে ঝুলানো চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নেয় সে। মাফলারটার দিকে একবার তাকায়। নিতে গিয়েও কি মনে করে যেন আর ছোঁয়না ওটা সে।
ঝাপিটা খুলতেই বউ বলে ,
: কই যাও ?
: তোর জাইন্যা কাম কি ?
শাহজাহানের শুধু শুধু রাগ চড়ে যায়।সে যাবে এখন ভূঁইয়া বাড়ি।সেখান থেকে টুনুদের সাথে নিয়ে যাবে খেতে। আজ একটা খেতে ধান রোপতে হবে।
এটা বললেও পারত। কিন্তু সব কাজ বউকে বলে করায় কেমন যেন একটা অপমান বোধ করে সে । তারমতে , বউ রাঁধব ,খাইব ,পোলাপান পালব ।এর বেশি জানার দরকার নাই ,অধিকারও নাই । বাকিটুকুতে হচ্ছে তার একচেটিয়া অধিকার।
শাহজাহান হাটা শুরু করে। শীতটা মনে হয় আজকে আরও বেড়েছে। সেইসাথে কুয়াশাও । দুইহাত দূরে কোন কিছুও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা।
পুকুর থেকে গোসল করে বাড়ি ফিরছিল ফজলের নতুন বউ । তাকে দেখে লজ্জায় লাল হয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ফজল সম্পর্কে শাহজাহানে চাচাত ভাই। ভাদাইম্যা হিসেবে পাড়ায় সে নামকড়া। কয়েকদিন পর পর এর নাক ফাটায় তো ওর হাত ভেঙে দেয়। শাহজাহানের বড় ভাইটা মরার পর তার এক চিলতে জমিটা বেচে তাকে কাঁচামালের ব্যবসা দিয়ে দিয়েছিল সে। কে জানে হয়তো সে ব্যবসার টাকা দিয়েই বিয়ে করে বউ এনেছে সে।
শাহজাহানকে জানায়নি অবধি।
সেদিন বাজারে মুখোমুখি হওয়ায় শুধু বলেছে ,
: কাকা , বউ দেখতে গেলা না যে ?
শাহজাহান উত্তর দেয়নি । না শুনার ভান করে এড়িয়ে গিয়েছিল ।
ভূঁইয়াকে পাওয়া গেল তার সিম খেতে। শাহজাহান সালাম দিয়ে দাড়িয়ে রইল। একবার ভাবল চৌকির দামটা জিজ্ঞেস করে।
: কিও খাড়ায়া রইলা ক্যান ? টুনুরারে নিয়ে খেতে যাও। বেলাযে বসে যাইতাছে ।
ভূঁইয়া তাড়া খেয়ে চৌকির দামটা আর জিজ্ঞেস করা হয়না তার ।
সে দ্রুত পা বাড়ায়। কুয়াশা ভেদ করে দ্রুত এগিয়ে চলে।শেষমেষ ভাবে , চৌকি কিনে লাভ নাই । আগে দরকার মেয়েটার বিয়ে । মেয়েটা তরতর করে বড় হয়ে যাচ্ছে। বেশি বয়সে আবার যৌতুকও লাগবে ঢেঢ়। ফলক শেষে যে টাকা উঠবে তাতে হয়তো কুলাবেনা । কিছু টাকা ধার করতে হবে। ভুঁইয়ার কাছে চেয়ে দেখতে হবে ।