ভার্সিটি এডমিশন টেস্ট দিতে অন্তু ঢাকা থেকে একটা বাসে করে রাজশাহী যাচ্ছে। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম থাকার কারণে রাত হয়ে এলেও এখনো গন্তব্যে পৌঁছুতে পারেনি সে। পৌঁছুতে আরো কমপক্ষে ঘন্টা খানেক লাগবেই। পরশু পরীক্ষা। তাই হাফ ছেড়ে বাঁচল ও। কাল হলে না ঘুমানোর কারণে পরীক্ষার হলেই হয়তো ঘুমিয়ে পড়ত! ভীষণ ঘুমকাতুরে ও। যাই হোক, পকেটে রাখা মোবাইলটা বের করে আরেকবার তাকাল অন্তু। ঘড়ি বলছে সময় এখন ২ টা পাঁচ। একটু ভ্রু মটকে অদ্ভূত ভঙ্গিতে একবার সামনে তাকাল সে। ভাগ্যিস! বাসের লাইটগুলো অফ ছিল। নয়তো তার চাহনি দেখলে ভয়ই পেত যাত্রীরা। এরপর দু ঠোঁট বাঁকা করে মুখ ভেঁচকে কিঞ্চিত বিরক্তি প্রকাশ করল ও। এত রাত হয়ে গেছে, অথচ এখনো বাস থেকেই নামা হলনা! সেখান থেকে আবার অপরিচিত একটা বাড়ি খুঁজে বের করতে হবে তাকে। তবে পকেটে ঠিকানাটা আছে বলে রক্ষা! কাউকে বলে কয়ে ঠিক বের করা যাবে! কিন্তু এত রাতে কোন মানুষ-টানুষ পেলে হয়!
এর মধ্যে বাস এসে থামল রাজশাহী স্টপিজে। একে একে সব যাত্রী নেমে গেল। তবে যাত্রীদের সংখ্যা বেশি নয়। পনের বিশেক হবে। বাকী যাত্রীরা অন্যান্য স্টপিজে আগেই নেমে গেছে। যাই হোক, পকেট থেকে ঠিকানাটা বের করে একজন যাত্রীকে দেখাতেই বলে উঠল, স্যরি ভাই! আমি এখানে স্থায়ী নই। একটা অফিসিয়াল কাজে এসেছি। কাজেই আপনাকে হ্যাল্প করতে পারছিনা। অন্তু ছোট করে একটা থ্যাংস দিয়ে লোকটাকে যেতে দিল। ইতিমধ্যে স্টেশন পুরো ফাঁকা। আশপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। এ মুহূর্তে কি করা উচিত, কিছুই ভাবতে পারছেনা অন্তু। এমন সময় শুনল, কেউ একজন তাকে ডাকছে। ঘুরে পেছনে তাকাতেই দেখতে পেল বাসের হেল্পার ছেলেটি। প্রায় অন্তুর সমবয়সী হবে ও। জিজ্ঞেস করল, এহানে কি নতুন? – হ্যা! ছোট করে জবাব দিল অন্তু। – যাবেন কোনহানে? – প্রশ্নের সাথে সাথে হাতের ঠিকানাটা দেখাল অন্তু। ছেলেটি একবার তাকিয়ে বলে উঠল, কালাম চাচার বাড়ি! কোন সমস্যা নাই। আপনে আমার সাথে চলেন।আমি ওদিকেই যাব। বলেই এগুতে লাগল ছেলেটি। অন্তু দু ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে সামান্য হেসে তাকে অনুসরণ করল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অন্তু মুখ খুলল, ওখানে বুঝি তোমাদের বাড়ি? ছেলেটি সাথে সাথে জবাব দিল, না! ওহানে আমার খালার বাড়ি। একটু পর অন্তু আবার জিজ্ঞেস করল, আমরা কি হেঁটেই পুরো পথ যাব? ছেলেটি জবাব দিল, আর কোন উপায় নাইতো। তয় ভাল কথা! ভূত-প্রেতে ডর আছেনি আপনার? ভূতের নাম শোনে মুখটা কেমন যেন পানসে হয়ে গেল অন্তুর। তবুও সাহস করে পাল্টা প্রশ্ন করে বসল, কেন? ওসবের সম্ভাবনা আছে না-কি! – আসলে কিছুক্ষণ পরেই একটা জঙ্গল পড়ব তো! হুনছি ঐহানে নাকি রাতের বেলা ওনারা ঘুরে বেড়ায়! সুযোগ পাইলে মানুষের ঘাড়ও মটকায়! তয় আমার কখনো সামনে পড়ে নাই। এরপর কিরকম একটা সুর তুলে যেন উঁচু স্বরে হেসে উঠল ছেলেটি। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল অন্তুর। – ভয় পাইলেন নাকি? অন্তুর প্রতি দুষ্ট জিজ্ঞাসা ওর। অন্তু কোন জবাব না দিয়ে নিরবে হেঁটে চলল। হঠাত্ ছেলেটি গর্জে উঠে ধমকের সুরে বলে উঠল, বেটা! মনে ডর নাই? এহন কিন্তু…..! কি যেন একটা বলতে চেয়েও চুপ করে রইল সে। অন্তু প্রচন্ড ভয় পেয়ে অনড় দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি অন্তুর একটা হাত চেপে ধরে প্রচন্ড জোরে টানতে টানতে এগিয়ে যেতে লাগল। ভয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল সে।
জঙ্গলটার মাঝামাঝি জায়গায় এলে, ছেলেটি অন্তুর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে উঠল, আপনে এহানে কিছুক্ষণ দাঁড়ান, আমি আসতাছি। বলেই লম্বা লম্বা পা ফেলে আঁড়ালে চলে গেল সে। এবার অন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল। এতরাতে একটা জঙ্গলের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ ভয় হচ্ছে ওর। তাছাড়া সাথের ছেলেটির আচরণও কেমন যেন রহস্য জনক মনে হচ্ছে! সাধারণত কখনো হার্টবিট বাড়েনা অন্তুর। কিন্তু এ মুহূর্তে জিনিসটা এত জোরে উঠা নামা করছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি প্রাণটা দেহ ছেড়ে যাবে। ইচ্ছে করছিল এখনি পালিয়ে যাক। কিন্তু এতরাতে একা একা কোথায় পালাবে সে? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও ছেলেটিকে আসতে না দেখে অন্তু সাহস করে এগিয়ে গেল তাকে পাওয়ার আশায়। কিছুদূর যেতেই হঠাত্ থমকে দাঁড়াল সে! দূর থেকে কিছু একটা দেখতে পেল! আকাশে মেঘ ছিলনা বলে একটু খেয়াল করতেই বুঝতে পারল, ওটা তার সাথে আসা ছেলেটিই। তাই আরো কিছুদূর এগিয়ে যেতেই বিস্ময়ে কোটর থেকে চোখ দুটো বেরিয়ে আসতে চাইল তার! উহ! কি বীভত্স দৃশ্য! ছেলেটির চেহারা হঠাত্ করে কেমন যেন একটা বিশ্রী আকার ধারণ করল। দাঁতগুলো দাঁড়ালো চকচকে আর তীক্ষ্ম! মুখটা পচে যাওয়া লাশের মত। যেন এখনি ছিঁড়ে পড়বে! সাথে দেখা গেল তারই মত আরেকটা বিকট চেহারার ছেলেকে। দুজনে কি একটা বিষয় নিয়ে যেন তর্কাতর্কি করছে। কাজেই কৌতূহল বশত এগিয়ে চলল অন্তু। তারা কি বলাবলি করছে তা শোনার জন্য। স্বভাবে অন্তু ভীষণ ভীতু হলেও এমুহূর্তে কিসের একটা প্রবল আকর্ষণে যেন তার সব ভয় ভীতি উভে গেছে। সে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে তাদের দিকে। আরো কিছুদূর এগুতেই যা শুনতে পেল, তাতে যে কেউই পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করবে। কিন্তু তার কোন প্রতিক্রিয়াই দেখা গেলনা। যেন ইচ্ছে করেই মরণ ফাঁদে পড়তে চাচ্ছে ও! আসলে ছেলে দুটু তার ঘাড় মটকে মাথা খাওয়া নিয়ে বাকযুদ্ধ করছিল! যখন দেখল শিকার তাদের হাতের মুঠোয়, যুদ্ধ থামিয়ে অদ্ভূত ভঙ্গিমায় পুতুলের মত এক পা দু পা করে এগিয়ে আসতে লাগল। অন্তু এখনো কেমন যেন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হয় এসব ভূতেরা এভাবেই মায়ার জালে ফাসিয়ে শিকারের ঘাড় মটকে মাথার রক্ত চূসে খায়। অন্তুই বুঝি আজ তাদের শিকার! যখনি ভূতেরা একসাথে অন্তুর মাথাটা চাপটে ধরে মটকে দেবে, ওমনি শোনা গেল ফজরের আযানের আল্লাহু আকবার ধ্বনি। সাথে সাথে মিলিয়ে গেল ভূত দুটি। আর অন্তু লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
সকালে ভোরের আলো ফুটলে জঙ্গলের মাঝখানে একটা ১৭-১৮ বছরের অচেনা ছেলেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে এ পথ দিয়ে চলা লোকেরা থমকে দাঁড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ছোট খাট জটলা তৈরি হল অন্তুকে ঘীরে। তখনো জ্ঞান ফিরেনি তার।
এদিকে এরকম একটি লোমহর্ষক ঘটনা বন্ধুদেরকে বলার পর সবাই তাকে ভাগ্যের জোরেই বেঁচে ফিরেছে বলে মন্তব্য করল । অন্তু কিছু না বলে কেবল হাসল. . . . .