শোভা

শেষ পর্যন্ত চাকরিটা ছেড়েই দিলাম। এছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না। আমি মরে গেলেও ঘুষ খাব না। আমি আমার নৈতিকতা, আবার বাবার দেয়া শিক্ষা শুধুমাত্র সংসারের শান্তি ফিরিয়ে আনতে বিসর্জন দিতে পারি না। যেখানে আমার বাবার অফিসের পিয়নের ও ৫ তলা বাড়ি আছে সেখানে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হয়েও বাবা তার স্বপ্নের বাড়ির ২য় তলাও কমপ্লিট করতে পারেনি। নিজে আজীবন সৎ থেকে গেছেন। ছেলে মেয়েকেও সৎ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। আমি কি করে সেই বাবার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হব? আমাকে দিয়ে তা হবে না। সরকারী চাকুরী ছেড়ে আমি বেকারের খাতায় নাম উঠালাম।
আমি একা হলে সমস্যা ছিল না। আমার স্ত্রী শোভা এবং দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে পরিবার। সাত বছরের ছেলে আর সারে তিন বছরের মেয়ে নিয়ে সুখেই ছিলাম। ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম, পরিবারের সবার অনুমতি ছাড়াই। বাবা রাগ করলেও বাসা থেকে বের করে দেন নি। চাকুরী পেতেও কোন সমস্যা হয় নাই। খুবই সুখে দিন কাটছিল আমাদের। সব কিছু শেষ হয়ে গেল এক দমকা বাতাসে। কাল বৈশাখীর ঝড়ের মতই আমার সংসারে নেমে এল অশুভ ঝড়।
আমার জুনিয়র সহকর্মীর মেয়ের জন্ম দিনের পার্টি থেকেই বিপত্তি শুরু। তার বিত্ত বৈভব শোভার মাথা ঘুরিয়ে দেয়। আমার জুনিয়র হয়েও সে শুধুমাত্র ঘুষের টাকায় প্রাসাদ গড়েছে। নিজের বাড়ি, গাড়ীর স্বপ্নে বিভোর শোভা সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। বিভিন্ন উপায়ে আমাকে ঘুষের টাকার প্রতি প্রলুব্ধ করতে শুরু করে। আমি মেনে নিতে পারি না। এই নিয়ে প্রায় প্রতি রাতেই আমাদের ঝগড়া হত। আমি কি করব? সংসারের শান্তি ফিরিয়ে আনতে চাকরিটাই ছেড়ে দিলাম।
ঘুম পাড়ানী গান গেয়ে মেয়েটাকে ঘুমপাড়ানোর চেষ্টা করছি। এমন সময় অগ্নি মূর্তি নিয়ে হাজির হল শোভা।
– ঘুমিয়েছে? কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল আমাকে।
– মনে হয়। আমি ছোট করে উত্তর দিলাম।
– তুমি চাকরি ছেড়েছে কেন?
– আমার পক্ষে ঘুষ খাওয়া সম্ভব নয়।
– সবাই তো খায়। তুমি খেলে সমস্যা কি ছিল? কি আছে আমাদের? তোমার বাবার এই ভাঙ্গা বাড়ি? তাও তো ৫ ভাগ হবে? আমাদের ভবিষ্যৎ ভেবে দেখেছ?
– শোভা, মেয়েটাকে ঘুমাতে দাও। এই বিষয়ে আমি আর কথা বলতে চাই না।
শোভার চেঁচামেচি বন্ধ হয় না। কেউ বোঝে না আমার মনের মাঝে কি ঝড় বইছে। প্রতি দিনের এই অশান্তি আমার আর ভাল লাগে না।

শোভার সাথে আমার তিক্ততা বেড়েই চলেছে। শোভা এখন একটা বাচ্চাদের স্কুলে চাকুরী করে, টিউশনি করে। তার টাকার দরকার। অনেক টাকা, যে টাকা দিয়ে সে রানীর হলে চলতে পারবে। আমার সীমিত বেতনের টাকায় তার শপিং খরচও হয় না। তার প্রতিদিনের অভিযোগ শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে বাবা মার সাথে আলাদা হয়ে গেছি। সারা দিন অফিস করে বাড়ি ফিরে শুনি, আমার ছেলে মেয়ে দুজনই না খেয়ে আছে। মা টিউশনি থেকে ফেরেনি। এভাবে আর কত দিন? আমি আর সহ্য করতে পারতেছিনা।

৬ মাস পর-
ডিভোর্সের সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম। শোভার বাড়ি গাড়ির স্বপ্ন পূরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কি আশ্চর্য! এত বড় সিদ্ধান্ত নেবার সময় ও শোভাকে কেমন শান্ত দেখাচ্ছে। আমি আমার মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলাম। ওদের আঁকরে ধরেই আমি এখন বাঁচতে চাই। শোভা ড্রইং রুমে চলে গেল। মনে হচ্ছে ও ওর বান্ধবীকে ফোন করছে। আমি আমার মেয়েটাকে ঘুম পারানো গান শোনাতে শুরু করলাম। পাশের রুম থেকে হালকা কথা বার্তা শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে শোভা ডিভোর্সের ব্যাপারে কারো সাথে কথা বলছে। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, শোভা নিজের সংসার নয় “কুসুম” এর সংসার ভাঙ্গা নিয়ে কথা বলছে। ভাঙ্গতে বসা নিজের সংসারের চাইতে সিরিয়ালের কুসুমের সংসার নিয়ে শোভাকে বেশি চিন্তিত মনে হল। মেয়েটার গালে আমার চোখের দু ফোটা অশ্রু পড়তেই চমকে উঠল। “কিছু না মা, ঘুমাও” বলে আমি আবারও ঘুমপাড়ানি গান শুরু করলাম। পাশের রুমে শোভা কুসুমের সংসার জোড়া লাগানোয় ব্যস্ত।