সত্যি ! পৃথিবীটা বড় আজব একটা জায়গা ! এখানে কেউ কারো নয় । তবে প্রয়োজনের বেলায় ঠিক উল্টো । আপনার কাছ থেকে যদি কিছু নেওয়া বা পাওয়ার থাকে , তাহলে পা চাটতেও রাজি অনেকে । এতে মান গেল না কি হল , তা ভাবার মত সময় কারো হাতে নেই এখন । বুঝলেন ! সবাই শুধু স্বার্থটাকে চিনে । তাই মুখে মধু ঢাললেও অন্তরে কিন্তু ঠিকই বিষের বৃষ্টি ঝড়ে । সেই বিষে যেকোন সময় নীল হয়ে যেতে পারে আপনার বদনখানি । প্রচন্ড আক্ষেপ থেকে কথাগুলো বলল , করিম মিয়া । আসলে কদিন হল তার বউটা পালিয়ে গেছে কোন এক জোয়ান ছেলের হাত ধরে । সাথে নিয়ে গেছে তার এতদিনকার রোজকার । কত কষ্ট করে কারবারটা দাঁড় করিয়েছে সে । প্রথম বারেই লাখ টাকা লাভ । তার কিনা সবটাই নিয়ে চলে গেল ! আরে মুখপুরী , গেলি যখন এক কাপড়ে যেতে পারলিনা ! আমার টাকা পয়সা নিয়ে গেলি কেন ? এভাবেই মনের সমস্ত ক্ষোভ ঝাড়ল সে । পাশে বসা রহিম শেখ হু-হ্যা কিছুই বলছেন না । শুধু ক্ষাণিক বাদে মুচকি হেসে উঠছেন , আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন । এসময় তারেক নামের একটি ছেলে এসে জানাল , চাচী ফিরে এসেছে । এই মাত্র দেখে এল সে । কথাটা শুনেই খুন চেপে গেল করিম মিয়ার মাথায় । কি ! এত্ত বড় সাহস ? আবার ফিরা আইছে আমার ভিটায় ! আমি যদি ওরে ঝেঁটিয়ে বিদায় না করি তো আমার নাম করিম মিয়াই না । বলেই হন্ত-তন্ত করে বাড়ির পথে পা বাড়াল সে ।
উঠোনে পা রেখেই হাঁক ডাক ছাড়ল করিম মিয়া । সাথে সাথে ঘোমটা মাথায় বেরিয়ে এল একজন মাঝাড়ি গড়নের মহিলা । ঘোমটা দেখে আর একমহূর্তও ঠিক থাকতে পারলনা সে । ক্রোধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে হেঁচকা টানে সরিয়ে ফেলল ওটা । এরপর জোর গলায় বলতে লাগল , – কুলটা , বেহায়া , বহুকামী ডাইনি ! নাগরের সাথে রং তামাশা কইরা আবার পা দিছস আমার ভিটায় ! তোরতো দেখি অজগরের চাইতেও বড় কইলজা ! এরকম যত গালি গালাজ জানা ছিল , এক এক করে মাঠে নামাল করিম মিয়া । কিন্তু তার সব আয়োজনই ভেস্তে গেল । একটা টুঁ শব্দও করলনা তার বউ । বরং আরো এগিয়ে এসে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেল তাকে । তখনও সে বকে যাচ্ছে অনবরত ।
আজ বছর পাঁচেক হয় করিম মিয়ার মাথা নষ্ট । অনেক বৈদ্য কবিরাজ দেখিয়েছে , কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি । হাতে টাকাও নেই যে , একজন ভাল ডাক্তার দেখাবে । তাই এভাবেই কোনমতে দিন কাটছে তাদের । করিম মিয়ার একটাই পাগলামি , খালি বউকে গালি গালাজ করা আর অন্যের কাছে বউয়ের নামে মিথ্যে নিন্দা করা । এতে একটুও রাগ করেনা তার বউ । ছেড়েও যায়না তাকে । বাবা-মা কত চেষ্টা করেছেন , পাগলের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে । কিন্তু কিছুতেই রাজি হয়নি সে । তার এক কথা , সুখের সময় যার সাথী ছিল এখন তার দুঃখের বেলায় তাকে একলা ফেলে চলে যাবে ! কখনোই না ! সেযে সত্যিই ভালবাসে তাকে ।
করিম মিয়ার কপাল ভাল , যে পূণ্যের উছিলায় এরকম একটা বউ পেয়েছে সে । নইলে আজকের জমানায় এরকম বউ-ভাগ্য কারো হয়না । তবে সেও খুব ভালবাসতো বউকে । একমুহূর্তের জন্য আড়াল হতে দিতনা । সব আবদার মিটাতো খুশি মনে । কখনো রাগ মুখে কথাও বলতনা সে । সবসময় মন বুঝে চলত । তাই বোধ হয় বউটাও তাকে এমন করে ভালবাসতে পারছে , পুরণো স্মৃতিগুলো মনে করে ।
করিম মিয়া আসলেই খুব সরল মনের মানুষ ছিল । কারো চোখের পানি একদম সইতে পারতনা । একদিন হল কি , নিজের জন্য আর বউয়ের জন্য কেনা কাটা করতে বাজারে গেল সে । সেখানে দেখা পেল এক অচেনা পাগলের । যে কিনা ক্ষুধার জ্বালায় কাদা মাটি থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে পচা ফল খাচ্ছিল । তা দেখে আর স্থীর থাকতে পারলনা সে । তত্ক্ষণাত হোটেলে নিয়ে গিয়ে পেট ভরিয়ে খাইয়ে দিল তাকে । সেদিন সেই পাগল দুহাত তুলে দোয়া করেছিল তার জন্য । এরকম চেনা অচেনা অনেক লোকেরই উপকার করেছে সে । কিন্তু তবুও কেন যে আল্লাহ তাকে পাগল বানিয়ে দিলেন , তিনিই জানেন । শুনেছি ভাল মানুষেরা নাকি বেশি দিন বাঁচেনা । হয়তো সে জন্যই আজ সে পাগল ! তবে এ কথা সত্যি যে , করিম মিয়ার সরলতার কাছে তার পাগলামি একেবারেই পরাস্ত । কেননা সে আগেই সবার মন জিতে বসে আছে । হয়তবা আল্লাহরও । তাই তার মুখের কঠিন গালিও আজ খাঁটি মধুর মত লাগে সবার কাছে ।
করিম মিয়ার বউটা অনেক কষ্ট করে । খেয়ে পড়ে বাঁচার জন্য সেলাইয়ের কাজ করতে হয় তাকে । ঘরে বসেই নিজের শখের সেলাই মেশিনটা দিয়ে আশ পাশের মেয়ে বউদের জামা কাপড় আর ছায়া ব্লাউজ বানিয়ে দেয় সে । বিনিময়ে গ্রহণ করে অল্প কিছু টাকা মজুরি । ফলে সবাই আসে তাদের প্রয়োজনে করিম মিয়ার বউয়ের কাছে । এতে দু পয়সা রুজি হয় তার । তাই দিয়ে মস্তিষ্ক বিকৃত স্বামীকে নিয়ে কোনরকমে চলে যায় । বউটা তার দেখতে সুন্দরীই বটে । তবে অতিরিক্ত খাটুনির ফলে চেহারা ভেঙে গেছে । তাই বলে কোন অক্ষেপ নেই তার । সবসময় কামনা করে স্বামীর সেবা যত্ন করেই কাটিয়ে দিবে বাকিটা কাল । পাগল হোক , তবুওতো সে স্বামী । তার পায়ের নিচেইতো বেহেশত !
এদিকে একদিন দুপুরে করিম মিয়াকে গোসল করিয়ে বারান্দায় পাটি বিছিয়ে খেতে দিয়েছে তার বউ । করিম মিয়া কেবল মুখে দিবে , এসময় এক ভুখা ফকীর এসে বলল , মা ! কিছু খেতে দিবি ? আজ কদিন হল কিছুই খেতে পাইনি । পেটের ভিতরটা কেমন যেন মুচড়ে উঠছে । দেনা মা ! কিছু খেতে ! ক্ষুদার্থ ফকীরের কথা শুনে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল মেয়েটি । মনে হল চোখের কফোটা জল যেন ভীষণ দাপট দেখিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে । কিন্তু কি করবে সে , ঘরে যে আর খাবার যোগ্য কিছুই নেই । কি দিবে কাঙাল এ মানুষটাকে ! কিছুক্ষণ এদিক সেদিক করে বয়োমটা হাতে নিয়ে একবার দেখল । কিন্তু কিছুই পেলনা তাতে । কি করে পাবে ? এতে যে , মাস কয়েক ধরে কিছুই রাখা হয়না । তাই আর কিছু না পেয়ে পিতলের গ্লাসে করে এক গ্লাস পানি হাতে বেরিয়ে এল সে । ওমা একি ! স্বামীর পাতে যে ফকীরটা খেতে বসেছে ! আর তিনি আনন্দে হাত তালি দিচ্ছেন । এবার আর চোখের জল সামলে রাখা গেলনা । অনায়াসেই বেরিয়ে এল গর গর করে । এদিকে ফকীরটা পেট পুরে চেটে পুটে খেয়ে অনেক দোয়া করতে করতে চলে গেল । ফকীরটা চলে গেলে করিম মিয়াকে বসা থেকে উঠিয়ে দাঁড় করাল তার বউ । তখনো তার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক বিদ্যমান । বউটা তার এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে । সেইসাথে চোখ থেকে বয়ে গেল আনন্দ অশ্রু ।