“দ্য স্লেভ বাইবেল”, বা ক্রীতদাস বাইবেল হচ্ছে খ্রীস্টানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের এমন এক সংস্করণ, যা থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল বাইবেলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এটির মাধ্যমে ক্রীতদাসদের খ্রীস্টধর্মে দীক্ষা দেয়া হতো, কিন্তু বাইবেলের যেসব কাহিনী তাদের আবার মুক্তির স্বপ্ন দেখাতে পারে, সেসব কাহিনী এই বই থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল।
দুশো বছরেরও বেশি সময় আগে প্রকাশিত বাইবেলের এই খন্ডিত সংস্করণের একটি দুর্লভ কপি এখন প্রদর্শিত হচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসির বাইবেল মিউজিয়ামে।
বাইবেল মিউজিয়ামের মাটির নীচের কক্ষটিতে বাইবেলের সরু এই সংস্করণটি অন্যগুলির চেয়ে আলাদাভাবে চোখে পড়ে। ব্রিটিশ ইতিহাসের এক অন্ধকার এবং গোলমেলে সময়ের সাক্ষী এটি।
ক্যারিবিয় অঞ্চলের ব্রিটিশ কলোনীগুলোতে যে আফ্রিকানদের ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের পড়ানোর জন্য এই বাইবেল প্রকাশ করা হয়েছিল। ‘সোসাইটি ফর দি কনভার্সন এন্ড রিলিজিয়াস ইন্সট্রাকশন অব নিগ্রো স্লেভস ইন দ্য ব্রিটিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ নামে একটি ব্রিটিশ মিশনারী সংস্থা ছিল। সম্ভবত তাদের জন্যই এই বাইবেলটি প্রকাশ করা হয়।
ডেভিড এন্থনি স্মিথ এই মিউজিয়ামের বাইবেল এবং ধর্ম বিষয়ক কিউরেটর। তিনি বলছেন, নিউ টেস্টামেন্টের ৫০ ভাগ, এবং ওল্ড টেস্টামেন্টের ৯০ ভাগই এই ‘স্লেভ বাইবেল’ থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল। বিশেষ করে স্বাধীনতা এবং মুক্তি সংক্রান্ত বিষয়গুলো। বাদ গিয়েছিল বুক অব এক্সোডাসেরও অনেক অংশ।
“এক্সোডাস অংশটিতে মূলত মিশরে ইসরায়েলাইটদের অবরুদ্ধ দশা এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুত ভূমিতে তাদের মুক্তির কথা বলা আছে। ক্রীতদাস প্রথার শিকার হওয়া আফ্রিকানরা যে বাইবেলের এই অংশটির প্রতি আকৃষ্ট হতেন, তার ঐতিহাসিক কারণ ছিল। কারণ এই ইজরায়েলাইটদের সঙ্গে তারা নিজেদের অনেক মিল দেখতে পেতেন।~
“কারণ তারাও তো অন্য একটি দেশে বন্দী অবস্থায় ছিলেন। তারাও মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। তারা ভাবতেন, আমরা যদি ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রাখি, আমরাও একদিন মুক্তি পাব। ঈশ্বর আমাদের মুক্তি দেবেন। কাজেই এই কাহিনী তাদের নিজেদের কাহিনির সঙ্গে খুবই মিলে যায়। দাস প্রথার শিকার এই আফ্রিকানদের মধ্য থেকে যে আধ্যাত্মিক নেতারা তৈরি হবেন, তাদের অনেকেই কিন্তু এ থেকে অনুপ্রেরণা নেবেন।”
দাস প্রথার পক্ষে মিশনারীরা
যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি রাজ্যের ন্যাশভিলের ফিস্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই বাইবেলটি ধার করে আনা হয়েছে। ১৮০৮ সালে লন্ডন থেকে এই বাইবেল প্রকাশ করা হয়েছিল। যার আগের বছরই কিনা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ক্রীতদাস ব্যবসা নিষিদ্ধ করে আইন পাশ হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে তার পরও কেন ব্রিটিশ মিশনারীরা এরকম একটি বাইবেল প্রকাশ করলেন? যেখানে এই মিশনারীদের অনেকেও দাস প্রথা বিলোপের পক্ষে ছিলেন। ফিস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের এসোসিয়েট প্রফেসর হলি টিপটন হামবি বলছেন, ব্রিটেন এবং আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথা বিলোপের পক্ষে যারা ছিলেন, তাদেরও একটা বিরাট অংশ কিন্তু তখনো বেশ বর্ণবাদীই ছিলেন।
“এরকম একটা বাইবেলের সংস্করণ তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে যায়। আঠারো বা উনিশ শতকে যারা খ্রীষ্টধর্ম পালন করতেন, তাদের অনেকে যদিও ক্রীতদাস রাখতেন না, তারা কিন্তু মনে করতেন শ্বেতাঙ্গ এবং অন্য বর্ণের মানুষরা কখনো সমান হতে পারে না।”
ডেভিড এন্থনি স্মিথের মতে, এর বিপরীতে আরেকটা ব্যাপার ছিল, এই মিশনারীরা বিশ্বাস করতো, যদি উপনিবেশগুলোতে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের মধ্যে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করা যায়, তাহলে হয়তো শ্বেতাঙ্গরা তাদের ক্রীতদাসদের সঙ্গে অনেক সদয় ব্যবহার করবে।
তারা ভাবতো, খ্রীষ্টধর্মের প্রসার ঘটিয়ে তারা তারা উপনিবেশের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারবে। যদিও এই বাইবেল কিনা একটা খন্ডিত সংস্করণ।
ক্যারিবীয় অঞ্চলে ১৮৩৩ সালে দাস প্রথার বিলোপ ঘটানো হয়। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত ঐ অঞ্চলে ক্রীতদাস আনা অব্যাহত ছিল। এই দাস ব্যবসায় ধর্ম কী ভূমিকা পালন করেছিল, স্লেভ বাইবেল, বা বাইবেলের ক্রীতদাস সংস্করণ তারই সাক্ষী।