জানালা গলিয়ে সূর্যের আলো পড়ে ঘরটাতে। সে জানালা ঘেঁসে ছেলের জন্য শীতের কাপড় বুনে এক মা। শীত আসছে, ছেলে যেন এসে কষ্ট না করে। এইজন্য তাড়াহুরার অন্ত নেই মায়ের।
লোকে বলে, ছেলে কই তোমার? যুদ্ধে গেছি নাকি?
মা বলেন, সে যেখানেই যাক। মায়ের কাছে নিশ্চয় আসবে!
শীত চলে যায়। প্রতিবছরের মতো মা শীতের কাপড়খানা আলমারিতে তুলে রাখেন। ছেলে আর আসেনা। মা নিরাশ হোন না তবু।
নতুন ঋতু আছে। প্রকৃতি আবার নতুন করে সাজে। গাছ গাছরা ছেয়ে যায় ফলফলাদিতে। মা গাছ থেকে ফল পাড়তে গিয়ে ভাবেন, ছেলে যদি ফিরে আসে? তাহলে তো তাঁর কমতি পড়ে যেতে পারে। হাত গুটিয়ে নেন মা। গাছের ফল গাছেই শুকিয়ে যায়। মা পাড়েন না, কাওকে পাড়তেও দেননা। শুধু কি ফল? এর ওর দেয়া এটা সেটাও মা নিজে না খেয়ে ছেলের জন্য জমিয়ে রাখেন। ছেলে আসলে দিবেন এই আশায়। সেই আগের মতো। ছেলে যখন তাঁর ভার্সিটিতে পড়তো। মাঝে মাঝেই বাড়ি আসতো তখন। এসেই আবদার, মা কি আছে খেতে দাও!
মা জানতেন ছেলে কি চাইছে। জমিয়ে রাখা আমটা, আপেলটা, পিঠাটা, মিষ্টিটা হাজির করতেন ছেলের সামনে। খেয়ে দেয়ে আবার একটু পরেই আবদার করতো, মা আর কিছু আছে?
মা হাসতেন। মিথ্যে করে বলতেন, না নেই।
বলেই তিনি বয়াম ভর্তি কয়েক পদের আচার হাজির করতেন ছেলের সামনে। ছেলে তাঁর সামনে বসে গ্রোগ্রাসে খেতো। মা তৃপ্তি ভরে দেখতেন।
ছেলে ফিরতো একগাদা নোংরা কাপড় চোপড় নিয়ে। তিনি লেগে যেতেন সেগুলো ধুতে। ছেলে ফিরে যাওয়ার সময় ভোল পালটে যেতো তাঁর। পড়নে থাকতো তকতকে পরিস্কার কাপড়। সেই নোংরা কাপড় গুলাও মা যত্ন করে ধুয়ে পুরে দিতেন ব্যাগে।
ছেলে চলে গেলে মা আবার শুরু করতেন এটা ওটা জমানো। আচারের খালি বয়ামগুলো ভরে রাখতেন আবার।
এখনও মা তেমনি আছেন। এটা ওটা সেটা জমে থেকে নষ্ট হয়ে যায়। আচারের বয়ামগুলোরে শ্যাওলা জমে। মা ধুয়ে মুছে নষ্ট খাবারগুলো ফেলে আবার নতুন করে জমিয়ে রাখেন। ছেলে আসেনা।
আত্মীয় স্বজন বলে, পাগলামী এবার ছাড়ো! ছেলে কি তোমার যুদ্ধে গেছে নাকি? একবারও তো আসেনা।
মা তবু আশা জাগিয়ে রাখেন। বলেন, এবার আসবে। এবার নিশ্চয় আসবে!
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। মা ধীরে ধীরে বুড়িয়ে যান। শেষে একদম শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। আবার শীত আসে। মা ভাবেন, এবার কি করি? উঠতে পারিনা, চোখেও ভালো দেখিনা। ছেলের জন্য শীতের কাপড় বুনি কি করে?
ছেলে যদি ফিরে আসে, এই শীতে তো অনেক কষ্ট হবে তার।
তাই বিছানায় শোয়ে শোয়ে আবার তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে তুলে নেন সুঁই, সুতা। আবছা দৃষ্টিতে ক্রমাগত কাপড় বুনে চলেন তিনি। সুইয়ের আঘাতে আঙুল ছিন্নভিন্ন হয় তাঁর, লোকে বাঁধা দেয়। মা তবু থামেন না।
কাপড় বুনা শেষ করে তবেই নিশ্চিন্তে চোখ বুজেন। ভাবেন , ছেলে এবার নিশ্চয় ফিরবে। সেকি আর যুদ্ধে গেছে যে আসবেনা?
মা আর চোখ খুলেন না। ছেলের কাছে খবর যায়। ছেলে আসেনা। একটা চিঠি আসে,
“ব্যবসার খুব চাপ। আমার পক্ষে এই মুহূর্তে আসা সম্ভব না। কিছু টাকা পাঠালাম, মায়ের শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করুন। ”
মায়ের পাশে তখনও ছেলের নতুন শীতের কাপড়টা পড়ে আছে। বয়াম ভর্তি আচারে শ্যাওলা পড়েনি। জমিয়ে রাখা আমটা,আপেলটা,পিঠাটা, মিষ্টিটা তখনও নষ্ট হয়ে যায়নি।