ব্রুস লি বনাম ওং জ্যাক ম্যান: মার্শাল আর্ট ইতিহাসের বিতর্কিত লড়াইয়ের নেপথ্য কাহিনী

১৯৬০ এর দশকের শুরুর দিকের কথা। সান ফ্রান্সিসকোর চায়নাটাউন তখন তরুণ মার্শাল আর্ট শিল্পীদের কাছে রীতিমতো তীর্থস্থানরূপ। তৎকালীন কারাতে নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তাভাবনা করা প্রতিটি ব্যক্তির স্বপ্নের শহর ছিল এটি। অঙ্কুরিত হতে থাকা চারা গাছের মতো যত্ন নিয়ে সম্ভাবনাময় তরুণদের মার্শাল আর্টের দীক্ষা দিতেন তাদের গুরুরা। উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্শাল আর্ট তখন এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, তরুণ ব্রুস লি তার দ্বিতীয় জুন ফ্যান মার্শাল আর্ট স্টুডিও সিয়্যাটল থেকে ওকল্যান্ডে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেন। ব্রুস লির পাশাপাশি তখন ওং জ্যাক ম্যানও মার্শাল আর্ট শিল্পী হিসেবে খুব জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। জুন ফ্যান গুং ইন্সটিটিউটের মালিক জ্যাক ম্যান শিক্ষার্থীদের উইং চুন শেখাতেন।

ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত লড়াইয়ে মুখোমুখি ব্রুস লি এবং ওং জ্যাক ম্যানঃ
১৯৬৪ সাল। মাত্র ২৪ বছর বয়সী ব্রুস লি তখনো কুংফুর এক ও অদ্বিতীয় সম্রাটে পরিণত হননি। তবে সমসাময়িক অন্যান্য মার্শাল আর্ট গুরুদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন ওং জ্যাক ম্যান আর ব্রুস লি। সান ফ্রান্সিসকো মার্শাল আর্ট দুনিয়ার শীর্ষ এই দুই শিক্ষক আক্ষরিক অর্থেই নিজেদের মতাদর্শ নিয়ে একেবারে বিপরীতমুখী অবস্থানে চলে যান। ব্রুস লির কাছে মার্শাল আর্ট ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত এক শিল্পের নাম। জাতি-বর্ণভেদে সবাইকে কারাতে শেখাতেন তিনি। এমনকি তার সান ফ্রান্সিসকোর ওকল্যান্ড স্টুডিওতে চাইনিজ শিক্ষার্থীদের চেয়ে বরং শ্বেতাঙ্গদের আনাগোনা বেশি ছিল। এই ব্যাপারটি একদমই পছন্দ হয়নি ওং জ্যাক ম্যানের। তার ভাষ্যমতে, মার্শাল আর্টের গোটা ব্যাপারটাই চীনা সংস্কৃতির সাথে জড়িত। কাজেই চীনদেশীয় ব্যতীত অন্য কাউকে এই শিল্পের ভাগ দেওয়া একেবারেই অনুচিত। এই নিয়ে শীতল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন মার্শাল আর্টের দুই গুরু। ওং এই বিষয়ে এতটাই দৃঢ় ছিলেন যে, তিনি ব্রুস লিকে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান পাঠান। আহ্বানের পাশাপাশি একটি হুমকিও ছুঁড়ে দেন ওং, যুদ্ধে হেরে গেলে স্টুডিও বন্ধ করে দিতে হবে ব্রুস লির।

বিতর্কিত এই লড়াই নিয়ে বেশ কিছু মতভেদ আছে। ভিন্ন একটি বক্তব্য অনুযায়ী, ব্রুস লি নিজেই ওং জ্যাক ম্যানের সাথে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। সান ফ্রান্সিসকোর যেকোনো মার্শাল আর্ট শিল্পীকে হারানোর ক্ষমতা রাখেন তিনি- এই বলে ব্রুস লি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন ওংয়ের উদ্দেশ্যে। এমন কথা শুনে তো আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। কাজেই ব্রুস লিকে দাঁতভাঙা জবাব দিতে মাঠে নামতে বাধ্য হন ওং। ওং নাকি চেয়েছিলেন সম্মুখযুদ্ধটি যেন সবার সামনে অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু তাতে রাজি হননি লি। পরবর্তীতে লির স্কুলে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যক্তিকে সাক্ষী রেখে দুজনের মধ্যকার বিতর্কিত যুদ্ধটি অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা যায়। তবে এই মতবাদটি নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। জ্যাক ম্যানকে নিজের স্কুলে নিয়ে গিয়ে গোপনে লড়াই করে লি তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবেন- ব্যাপারটা একটু হাস্যকরই বটে! জনসম্মুখে লড়াই না করার পিছনে ঠিক কী কারণ ছিল, তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও সাক্ষ্য প্রমাণ অবশ্য এই মতটির পক্ষেই কথা বলে।

সে যা-ই হোক, ঘটনাটি সংঘটিত হওয়ার সময় প্রায় ১৫ জন সাক্ষী সেখানে উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করলেও এখনও পর্যন্ত মাত্র তিনজন সাক্ষীর পরিচয় নিশ্চিত করা গেছে। তারা হলেন- লির তৎকালীন স্ত্রী লিন্ডা, তার স্টুডিও সহযোগী জেমস লি এবং উইলিয়াম চেন নামের স্থানীয় এক তাই চি প্রশিক্ষক। রুদ্ধদ্বার সে লড়াইয়ে আদতে কী ঘটেছিল, তা নিয়ে জনমনে কৌতূহলের কোনো শেষ নেই। পরস্পরবিরোধী বেশ কিছু বক্তব্যও পাওয়া গেছে তাদের এই চ্যালেঞ্জিং যুদ্ধ নিয়ে। তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় ব্রুস লির স্ত্রী লিন্ডার বক্তব্যটি। তার ভাষ্যমতে, লড়াই শুরু হওয়ার মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায় ওং জ্যাক ম্যানকে কুপোকাত করে ফেলেন লি।

“দু’জন ঘরের দু’প্রান্ত থেকে বেরিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। আনুষ্ঠানিকভাবে মাথা নুইয়ে পরস্পরকে অভিবাদন জানায়। তারপরই শুরু হয়ে যায় লড়াই। শুরুতে লির বিরুদ্ধে ওং একটি ক্ল্যাসিক ভঙ্গিতে স্ট্রেট পাঞ্চ ছুঁড়ে মারেন। ওং তখনো তার উইং চান স্টাইল ধরে রেখেছিল। গতানুগতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে লিকে ধরাশায়ী করে তাকে ভুল প্রমাণ করাই ছিল ওংয়ের প্রধান উদ্দেশ্য। অন্যদিকে লি তখন দুর্বারগতিতে তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছিল ওংকে। মিনিটখানির মধ্যে ওংয়ের লোকজন বুঝতে পারে, অবস্থা বেশ বেগতিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তারা ওংকে বোঝায়, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এদিকে জেমস লি তাদের ব্যঙ্গ করা শুরু করে, এত সহজে হার মেনে গেলে চ্যালেঞ্জ কেন গ্রহণ করলে? ওং পক্ষের লোকজনের মুখ শুকিয়ে আসে, লি তখন ক্ষিপ্রগতিতে বারংবার আঘাত হানছে। ওং এবার আক্রমণাত্মক ভূমিকা বাদ দিয়ে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। যত দ্রুত সম্ভব সরে গিয়ে লির হাতের নাগালের বাইরে যাওয়াই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য।

একপর্যায়ে আক্ষরিক অর্থেই সে দৌড়ে মঞ্চ থেকে নেমে পালিয়ে যাওয়ার উপক্রম করে। কিন্তু ব্রুস লি তখন রাগে-জেদে রীতিমতো কাঁপছে। চিতাবাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে খপ করে ওংয়ের জামার কলার টেনে ধরে আবার তাকে মঞ্চের মাঝখানে নিয়ে আসেন লি। পাগলের মতো চিৎকার শুরু করে সে, “এবার বিশ্বাস হয়েছে তোমাদের?” সঙ্গীকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠে পড়া সাঙ্গপাঙ্গরা সাথে সাথে পাল্টা চিৎকার করে জানায়, “আলবৎ হয়েছে! যথেষ্ট হয়েছে!” সবার কাছ থেকে আরও একবার একই উত্তর শুনে নিজের বিজয় নিশ্চিত করে লড়াই খতম করে লি।”

হেরে যাওয়ার পর পরাজিতরা কী ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়াতে পারে, তার অদ্ভুত অদ্ভুত নিদর্শন ইতিহাসে রয়েছে। বাইজেন্টাইনের রাজা পঞ্চম কন্সটেন্টাইনের (৭৪১-৭৭৫) শত্রুরা তার নামে গুজব রটিয়ে দিয়েছিল, শৈশবে তিনি নাকি একবার উপাসনালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে মলত্যাগ করে কাপড় নষ্ট করে ফেলেছিলেন। একজন রাজার জন্য এহেন গুজব যথেষ্ট লজ্জাজনক তো বটেই। শত্রুদেরই বা কী দোষ? মাত্রই কন্সটেন্টাইনের কাছে হেরে গিয়ে তার ইমেজ খারাপ করতে এর চেয়ে বাজে গল্প বানানোর সময় মোটেই তাদের হাতে ছিল না। ওং অবশ্য অতটাও নিচে নামেননি, তিনি কেবল ঘটনাটির নানা সংস্করণ বের করতে সবাইকে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন আর তথ্যের খোরাক প্রদান করেছিলেন।

ওংয়ের ভাষ্যমতে লি পুরোপুরি ‘বুনো ষাঁড়ের’ মতো তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, পরাজয় স্বীকার না করলে তাকে খুন করে নিজের বিজয় নিশ্চিত করতেও পিছপা হতেন না লি। কাজেই ওং কেবল লির মারগুলো ঠেকিয়ে গেছেন, সামান্য একটি চ্যালেঞ্জকে জীবন-মরণ লড়াইয়ে পরিণত করার কোনো ইচ্ছাই নাকি তার ছিল না। তিনি জানান, প্রায় বিশ মিনিট ধরে চলা এই লড়াইয়ে লি কিছুটা এগিয়ে ছিল এ কথা অনস্বীকার্য, তবে লিন্ডা যেভাবে তার পলায়ন আর লির চিতাবাঘ স্টাইলে তাকে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন, তা গালগল্প ছাড়া আর কিছুই নয়! এমনকি কোনো হুংকার বা চিৎকার-চেঁচামেচি নয়, বরং পারস্পারিক বো ডাউনের মাধ্যমে শান্তিচুক্তির মতো করেই শেষ হয় তাদের লড়াই।

লির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সরাসরি কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। উইলিয়াম চেন, যিনি মার্শাল আর্টের ক্ষেত্রে গৎবাঁধা স্টাইলগুলোকে প্রাধান্য দিতেন, জানান ব্রুস লি বনাম ওং জ্যাক ম্যানের লড়াইটি শেষ পর্যন্ত টাই হয়। তার বক্তব্যের সাথে লিন্ডার চেয়ে বরং ওং এর কিছুটা মিল পাওয়া যায়। তিনি অকপটে বলেন, লড়াইয়ের সময় হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে লি খুবই আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। লড়াইটিকে ওং স্বাভাবিকভাবে নিলেও লি নিজেই সেটিকে জীবন-মরণ পর্যায়ে নিয়ে যান। ২০-২৫ মিনিট ধরা চলা সে লড়াইয়ে লি এগিয়ে থাকলেও ওং কখনোই তার পালিয়ে বাঁচতে চাননি বলে জানান উইলিয়াম চেন।

ব্রুস লি বনাম ওং জ্যাক ম্যানের মধ্যকার এই লড়াইটিকে মার্শাল আর্ট জগতের সবচেয়ে বিতর্কিত ও রহস্যজনক লড়াই বলেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়, হাতেগোনা কয়েকজন স্বঘোষিত সাক্ষীই কেবল এ কথার বিরোধিতা করে। তবে এই যুদ্ধের ফলে লির মধ্যে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে, তা নিয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। বিজয় যেভাবেই হোক, এই লড়াইয়ে বিজয়ী লি বুঝতে পারেন, তার নিজস্ব একটি মার্শাল আর্ট স্টাইল আছে যাকে উন্নত করা তার একান্ত কর্তব্য। নিজের সেই স্টাইলটির তিনি নাম দেন ‘জিত কুনে দো’, যাতে সংমিশ্রণ ঘটে উইং চুন, তায়কোয়ান্দো, মুষ্টিযুদ্ধ, অসীচালনা আর পশ্চিমা বক্সিংয়ের।
‘ব্ল্যাক বেল্ট’ নামক এক ম্যাগাজিনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজস্ব স্টাইল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিতর্কিত এই লড়াই নিয়েও প্রচ্ছন্নভাবে কথা বলেন ব্রুস লি। অবশ্য ওংয়ের নাম সেখানে একবারও উচ্চারণ করেননি তিনি, ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে নিজের ক্ষোভের কিছুটা বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন কেবল।

“বেশ কয়েক বছর আগে সান ফ্রান্সিসকোতে একবার এক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ি আমি। প্রতিপক্ষ ছিল এক কুংফু বেড়াল, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওকে একেবারে মাটিতে শুইয়ে ফেলি আমি। আমার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গাধাটা উল্টো দিকে ফিরে দৌড় শুরু করল। আমিও বোকার মতো ওকে ধাওয়া করে পেছন থেকে ওর মাথা আর পিঠে লাগাতার পাঞ্চ বসিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে হাত যেন ব্যথায় ফেটে যাচ্ছিল আমার। ঠিক সেই মুহূর্তেই অনুধাবন করলাম, উইং চুন স্টাইলটি খুব বেশি প্রায়োগিক নয়। কাজেই ওসব ছেড়ে নিজের একটি স্টাইল দাঁড় করাতে মরিয়া হয়ে উঠলাম। ফলাফল আপনাদের সামনেই বসে আছে!”
পরবর্তীতে তাদের এই লড়াইয়ের উপর ভিত্তি করে ‘বার্থ অফ দ্য ড্রাগন’ নামক একটি সিনেমা নির্মাণ করা হয়।