[su_box title=”চলচ্চিত্রের তথ্য” style=”soft”]
- পরিচালনা : ঋত্বিক কুমার ঘটক
- মূল কাহিনী : শক্তিপদ রাজগুরু
- চিত্রনাট্য : ঋত্বিক কুমার ঘটক
- চিত্রগ্রহণ : দিনেন গুপ্ত
- সম্পাদনা : রমেশ যোগী
- শব্দ : সত্যেন চট্টোপাধ্যায়
- শিল্প নির্দেশনা : রবি চট্টোপাধ্যায়
- সংগীত : জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
- প্রযোজনা : চিত্রকল্প
- দৈর্ঘ্য : ১২৬ মিনিট
- ভাষা : বাঙলা
- দেশ: ভারত
- রঙ: সাদাকালো
- অভিনয় : সুপ্রিয়া চৌধুরী – (নীতা), অনিল চট্টোপাধ্যায় – ( শংকর), নিরঞ্জন রায় – (সনৎ), বিজন ভট্টাচার্য – (বাবা), গীতা দে – (মা), দ্বিজু ভাওয়াল – (মন্টু), গীতা ঘটক – (গীতা), জ্ঞানেশ মুখার্জী, রনেন রায়চৌধুরী[/su_box]
কাহিনী সংক্ষেপঃ
বাঙালী জীবনমুখী পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক ১৯৬০ সালের ১৪ই এপ্রিল লোকচক্ষুর সামনে উন্মোচন করেছিলেন ‘মেঘে্ ঢাকা তাঁরা’। তাঁর সিনেমাগুলোর মধ্যে “মেঘে ঢাকা তারা” চতুর্থ ও প্রথম ব্যবসা সফল সিনেমা। ১৯৭৫ সালে একটি বার্ষিক পত্রিকায় তিনি বলেছিলেন “দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপটে নির্মিত মেঘে ঢাকা তারা ( ১৯৬০); কোমল গান্ধার( ১৯৬১); এবং সূর্বণরেখা( ১৯৬২) এই তিনটি মিলে ট্রিলজি নির্মিত হয়েছে।”
“মেঘে ঢাকা তারা” মেলোড্রামা ধাঁচের। কাহিনীর গাঁথুনি রৈখিক। পঞ্চাশ দশকে কলকাতার এক বাঙালি পরিবার ঘিরে কাহিনীর আবর্তন। ১৯৪৭-এর ভারত ভাগের পর এই শরণার্থী পরিবার আশ্রয় নেয় কলকাতা শহরের প্রান্তে। এই পরিবারের বড় মেয়ে নীতা-ই সিনেমার প্রধান ট্র্যাজিডি চরিত্র। বি,এ পাশ করে সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। নীতার বৃদ্ধ বাবা স্কুলে পড়ায়, মা গৃহিণী। নীতার বড় ভাই শংকর, সে সংঙ্গীত চর্চা করে, ইচ্ছে পেশাদার গায়ক হবে। সংসারের কাজে শংকরের মন নেই। নীতার ছোট বোন গীতা ও ছোট ভাই মন্টু স্কুল পড়ুয়া। নীতার সনৎ নামের একজনকে ভালোবাসে। সনৎ নীতাকে কথা দিয়েছে পি এইচ ডি শেষ করে সে তাকে বিয়ে করবে। একদিন নীতার সব স্বপ্ন পূরণ হবে; এমনটাই আশা করে যে- শংকর বড় গায়ক হবে, মন্টু ভালো চাকরি করবে, গীতার ভালো ছেলের সাথে বিয়ে হবে। আর সনৎকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পাবে। এভাবে জীবন-যৌবন নিয়ে নীতার গল্প সামনে গড়াতে থাকে। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, অসুখ কোন কিছুই নীতা পরোয়া করে না। কখনো অফিস থেকে ফেরার সময় মাঝপথে চটিজোড়ার একটি ছিড়ে গেলে, খালি পায়ে হাঁটতে থাকে। তবু আশা ছাড়ে না নীতা। একসময় শংকর অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে বোম্বে চলে যায়, গায়ক হবার জন্য। কাহিনী মোড় নেয় অন্যদিকে। সনৎ পি এইচ ডি শেষ করে দেশে ফেরে। নিয়মিত নীতাদের বাড়িতে আসে নীতার সাথে দেখা করতে। একসময় নীতা জানতে পারে গীতা সনৎ কে ভালোবাসে। সনৎও তাকে পছন্দ করে।
তারা বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে। নীতার পরিবারও তাই চায়। কারণ নীতার বিয়ে হয়ে গেলে সংসারের হাল ধরবে কে! এরপর সনৎ গীতাকে বিয়ে করে শহরের ভালো একটি বাড়িতে আনন্দে সংসার করতে থাকে। হঠাৎ মন্টু অসুস্থ হয়ে যায়, তার চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে নীতা মানসিক ও শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। অবশেষে শংকর বোম্বে থেকে দেশে ফিরে আসে বড় গায়ক হয়ে। কিন্তু ততোদিনে নীতার সব স্বপ্ন মরে গেছে। এখন নিজেকে বাঁচানোই তার জন্য কঠিন হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে শংকর বুঝতে পারে নীতার যক্ষা হয়েছে। সে আর বাঁচবে না। শংকর নীতাকে চিকিৎসার জন্য পাহাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে জীবন মৃত্যুর দোলাচলে এসে নীতা শংকরকে জানায় “দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম, দাদা আমি বাঁচতে চাই”।
‘সঙ্গীত’ – মেঘে ঢাকা তারাঃ
‘মেঘে ঢাকা তারা’র নানা পরিস্থিতিতে ঋত্বিক যেমন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রাগ ও তানের ব্যবহার করেছেন, তেমনই ব্যবহার করেছেন লোকসঙ্গীত, পাহাড়ি গান ও রবীন্দ্রসঙ্গীত। চলচ্চিত্রের শুরুতে শঙ্করের রাগ থেকে শেষে নারীকণ্ঠে গাওয়া সিলেটি অঞ্চলের লোকসঙ্গীত ব্যবহারে ঋত্বিক মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
চলচ্চিত্রে শঙ্করকে হেঁটে হেঁটে রাগ গাইতে দেখা যায়। শঙ্করের চঞ্চলতাও দেখানো হয় রাগটি দিয়ে। বিলের ধারে শঙ্কর গলা সাধার সময় গ্রামের এক মেয়েকে পিছন থেকে দেখে নিতা মনে করে তিনি থামান, পরে বুঝতে পারেন তিনি নিতা নন; শঙ্করের হাসিতে তখন চঞ্চলতা ধরা পড়ে। মেয়েটি চলে গেলে আবার শুরু গাওয়া করেন। এরপর শঙ্কর শহরে গিয়ে সঙ্গীতে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গ্রামে ফিরলে আবারও রাগ সঙ্গীত নিয়ে হাজির হন। শঙ্করের ফিরে আসার আনন্দ এবং শিল্পীর মনের চঞ্চলতা গানের মধ্য দিয়ে উঠে আসে।
সনৎ স্টেশনে দাঁড়িয়ে নিতাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সংসার ও সবার কথা ভেবে তিনি তাতে রাজি হন না। এর পরের দৃশ্যে মুদি দোকানে ব্লেড কিনতে এসে শঙ্করকে কথা শোনায় দোকানদার—কেনো তিনি নিজে কিছু না করে বোনের টাকায় টোটো করে ঘুরে বেড়ান। ছোটো বোনের এমন কষ্টের কথা শুনে শঙ্করও উদাস হন। ঠিক এই সময়ে কাট ওভার সাউন্ডে বাউল গান শুরু হয়। ‘‘দুঃসময়ে দিন গুয়াইয়া অসময়ে রইলাম নদীর পাড়ে; মাঝি তোর নাম জানিনে,আমি ডাক দিমু কারে”- গানের কথাগুলো নীতার অসহায় অবস্থার সঙ্গে মিলে যায়। সামান্য পরে অবশ্য পর্দায় সেই বাউলকে দেখা যায়। আবহে বাউল গান চলছে; নিতা তার বাবার ঘরে ঢোকেন, সেখানে মাও ছিলেন; ভয়ে ভয়ে তিনি তাদেরকে মন্টুর চাকরি পাওয়ার কথা জানান এবং প্রথম মাসের বেতনের টাকা বাবার হাতে তুলে দিতে চান। না জানিয়ে মন্টু পড়াশোনা ছেড়ে চাকরি নেওয়ায় নিতাকে বকাবকি করেন মা। আবহে তখনো বাউল গান চলছে। একদিকে সংসারের টানাপড়েন, প্রেমের সম্পর্ক, অন্যদিকে মায়ের ভুল বোঝা—সবমিলিয়ে নিতা যেনো অসময়ে ঘাটে এসে পড়েছেন।
নিতাকে নিয়ে মায়ের মনে সংশয় কাজ করে- সে যদি বিয়ে করে চলে যায় তাহলে সংসার কোথায় গিয়ে ঠেকবে। ঘরের বারান্দায় মা ও নিতা বসে আছেন, সংসারের অবস্থা নিয়ে মা কথা বলছেন তার সঙ্গে। একপর্যায়ে নিতাকে বিয়ে না করার ইঙ্গিত দেন মা। নিতাও মাকে এ নিয়ে আশ্বস্ত করেন। তখন কাট ওভার সাউন্ডে শঙ্করের কণ্ঠে রাগের আলাপ ভেসে আসতে থাকে। পরে অবশ্য শঙ্করকে রেওয়াজ করতে দেখা যায়। মেঘে ঢাকা তারায় সংসারের ঝিম ধরা পরিস্থিতি বোঝাতে হয়তো এর ব্যবহার করেন ঋত্বিক।
সনতের বাড়িতে অন্য কোনো নারীর উপস্থিতি টের পেয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়িতে ফেরেন নিতা। কিছুক্ষণ পর গীতা বাড়ি আসলে তাকে তিনি সবকিছু বাদ দিয়ে সামনের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বলেন। গীতা উত্তর দেন, তিনি পড়ালেখা করবেন না, বিয়ে করবেন। পাত্র কে—এ কথার উত্তরে সনৎ বাবুর নাম বলেন গীতা। কথা শুনে নিতা স্তব্ধ হয়ে যান। নিতার নীরবতা ও আবহে রাগের তান এক অসাধারণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। করুণ রসাত্মক বৈশিষ্ট্যের রাগ নিতার কষ্টের সঙ্গে দর্শককে যেনো একাত্ম করে। অবশ্য শুধু তানেই থেমে থাকেননি তিনি; তান শেষে ঢাকঢোলের বাজনা দিয়ে নিতার মনের অবস্থাকে ঋত্বিক সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেখিয়েছেন। যে ঢাকঢোলের বাজনা পরের দৃশ্যে গীতার বিয়ের আয়োজনের আবহসঙ্গীত হয়ে ওঠে। সঙ্গে দেখানো হয় বাড়ির উঠোনে ছেলে-মেয়েরা খেলা করছে, শঙ্খ বাজছে। এক রাতে শঙ্কর গানের স্কুলে চাকরি নেওয়ার কথা জানান নিতাকে।
একই কথা মাকে জানাতে নিষেধ করেন তিনি। এছাড়া তিনি প্রাইভেটে এম এ পরীক্ষা দেবেন বলেও জানান। এসব কথা কাটাতে শঙ্করকে উদ্দেশ্য করে নিতা বলেন, ‘‘দাদা আমাকে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাবি।’ এ কথা শুনে রেগে যান শঙ্কর; নিতাকে ধমকের সুরে কথা বলেন। নিতাও তার কষ্টের কথা, অসহায়ত্বের কথা বলেন। একপর্যায়ে শঙ্কর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলেন নিতাকে। দুই ভাই-বোনের চরম আবেগী সেই মুহূর্তে শঙ্কর বলেন, ‘‘গান শিখবি?’ চরম কষ্ট বুকে চেপে নিতা বলেন, ‘‘বাসরে গাইতে হবে না।’ চরম পর্যায়ের এই দৃশ্যের ঠিক পরের শটে শঙ্কর গাইতে শুরু করেন—‘‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে’। যদিও মূল কণ্ঠ দেবব্রত বিশ্বাসের, তার পরও শঙ্করের লিপে আর পরিস্থিতির ব্যঞ্জনায় তা যেনো জীবন্ত হয়ে ওঠে। শঙ্কর গান থামাতেই নিতাকে লো আঙ্গেল শটে দেখিয়ে আবহে আবার সেই চাবুকের শব্দ শোনানো হয়।
নীতাকে দেখতে শঙ্কর পাহাড়ের হাসপাতালে গেলে আবহে পাহাড়ি গান শোনা যায়। সেখানে নীতার সঙ্গে সনৎ পরিবার নিয়ে আলোচনা করার সময় তার মুখে বারবার বাঁচার আকুতি ফুটে ওঠে। একপর্যায়ে নিতা চিৎকার করে তার বাঁচার আকুতি জানান। সেই সময় পাহাড়ে ক্যামেরা প্যান করে, চিৎকারের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। চারিদিকের এই আর্তনাদ নিতার অসহায়ত্বকে এমনভাবে তুলে ধরে, যা দেখে দর্শকের মন ক্ষণিকের জন্য খারাপ না হয়ে পারে না। নীতাকে দেখে শঙ্কর গ্রামে ফেরেন। স্থানীয় বাজারের এক দোকানদার তাকে নিতার কথা জিজ্ঞেস করেন। ঠিক সেই সময় শঙ্করের পাশ দিয়ে নিতার মতোই এক নারীকে হেঁটে যেতে দেখা যায়। শঙ্কর তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই মেয়েটির চটি ছিঁড়ে যায়, চলচ্চিত্রের শুরুতে নিতারও ঠিক এভাবেই একবার চটি ছিঁড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে আবহে নারী কণ্ঠে করুণ এক লোকসঙ্গীত শোনা যায়। গানটি বিয়ে সম্পর্কিত—মায়ের বাড়ি থেকে মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সময়ের বিষয়গুলো এ গানে উঠে আসে। মেয়েটির যখন চটি ছিঁড়ে যায়, তখন শঙ্করের দিকে তাকিয়ে তিনি মুচকি হাসেন; কিন্তু শঙ্কর তার দিকে মন খারাপ নিয়েই তাকিয়ে থাকেন—তিনি হয়তো বোন নিতার মতোই এক নারীকে দেখতে পান।
চলচ্চিত্র শুধু চলমান চিত্র নয়। চলমান এই চিত্রকে প্রাণ দেওয়াই এর সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ। এখানেই প্রয়োজন পড়ে শব্দ ও সঙ্গীতের। যদিও সঙ্গীত ও শব্দ ব্যবহারের সেই চ্যালেঞ্জকে অনেক নির্মাতাই এড়িয়ে যান। তারা চলচ্চিত্রে সঙ্গীত ব্যবহার করেন, তবে অনেক ক্ষেত্রেই তা ব্যবসার জন্য, চলচ্চিত্রকে আরো জীবন্ত করার জন্য নয়। এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে যে দু-চার জন নির্মাতা শব্দ ও সঙ্গীত ব্যবহারে চলচ্চিত্রে অনন্যতা এনেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ঋত্বিক। শুধু ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখেই এ ধরনের মন্তব্য করলে খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। চলচ্চিত্রটিতে শব্দ ও সঙ্গীতের ব্যবহার দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না, এ নিয়ে তার সম্যক জ্ঞান ছিলো অসাধারণ। বর্তমান প্রজন্মের যারা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বোধহয় ঋত্বিকের সঙ্গীত ভাবনা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
তৈরির আটান্ন বছর পরও ‘মেঘে ঢাকা তারা’ অনবদ্য ভঙ্গিতে মনে পড়িয়ে দেয় কি নিঃশব্দ হতে পারে- যারা স্বার্থত্যাগ করে শুধু দিয়েই যায়, যারা তাদের ভালোবাসে আর তাদের মঙ্গলকামী বলে দাবি করে তাদের হাজারও শোষণের পরও তারা সে রকমই থাকবে। এই বীক্ষণের অবস্থান সব শ্রেণী আর আদর্শের ওপরে। আমার মনে হয় ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ঋত্বিক ঘটকের সেরা প্রশংসিত সিনেমা হয়েই থাকবে।
“মেঘে ঢাকা তারা” চলচ্চিত্র থেকে কিছু স্থিরচিত্রঃ