ফেরার পথের ফকির

এক 

লোকটা একটু আগেও দিব্বি সুস্থ সবল মানুষ ছিলেন। ষাটোর্ধ বয়স। গায়ে বড়লোকি পোশাক আশাক। মেহেদি লাগানো লাল চুল দাঁড়ি। দামী গাড়িতে নিজেই ড্রাইভিং করে এলেন। গাড়িটা রাস্তার পাশে থামিয়ে পকেট থেকে বের করে একটু সিগারেট ধরালেন ঠোটে। সিগারেটের ধোয়ার সাথে একটা বোধহয় দীর্ঘশ্বাসও ছাড়লেন। আর তারপরেই হঠাৎ বুক চেপে চিৎ হয়ে পড়ে গেলেন। কাছেই দোকানপাটে লোকজন গিজ গিজ করছিলো। ফলে মুহূর্তের মধ্যেই লোকটাকে ঘিরে একটা জটলা তৈরি হয়ে গেলো। ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বললো, আরে ভাই দেখেন কি হাসপাতালে নিয়া যান।
অনেকেই “হ হ, হাসপাতালে নিয়া যান” বলে তাঁর কথায় গলা মেলাল। কিন্তু হাসপাতালে নেয়ার মতো কাওকেই এগিয়ে আসতে দেখা গেলনা। ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ ধাক্কাধাক্কি করে একটু লোক ঢুকে গেলো। লোকটার বোধহয় এক আধটু ডাক্তারি বিদ্যা জানা ছিলো। চিৎ হয়ে পড়ে থাকা লোকটার একটা হাত তুলে নাড়ি দেখতে লাগলেন তিনি। ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠলো, আছে? নাকি গেছে?
নাড়ি দেখতে বসা লোকটা হাত ছেড়ে দিলেন। হতাশ ভঙ্গিতে বললেন, না নেই। মারা গেছেন।
– আহারে!
– ভদ্রঘরের লোক। রাস্তায় পড়ে মরলেন।
ভিড়ের মধ্যে শোর উঠলো। কে যেন চেঁচিয়ে বললো, চিনেন কেউ? এলাকার কে আছেন?
ভিড় ঠেলে একজন লোক এগিয়ে আসলেন, দেখি ভাই… আমারে একটু দেখতে দেন। একটু আলো ধরেন তো কেউ?
মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠলো কয়েকটা।
– চিনলেন?
– না।
– দেখেন তো পকেটে কিছু আছে নাকি?
একটা দামী মোবাইল, মানিব্যাগ, গাড়ি চাবি বেরোল পকেট থেকে। মানিব্যাগের মধ্যে পরিপত্র মিলল। ঠিকানাও পাওয়া গেলো। ১৫ এর এ। এলাকার সবচেয়ে সুদৃশ্য বাড়ি। লোকটাকে না চিনতে পারলেও, বাড়িটা সকলেই চিনতে পারলো।

দুই

ভাঙ্গা একটু ঘর। দুটো চৌকি পাশাপাশি রাখা। একটা চৌকিতে চাদর মুড়ি দেয়া একটা লাশ রাখা। অন্যটাতে কিছু ছেলেমেয়ে বসে একটানা কোরআন পড়ছে সুর করে। মেঝেতে কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ হয়ে আছেনে একজন মহিলা। তাঁকে ঘিরে আরো কিছু মহিলা সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। বাইরে ভিড় কোলাহল।
কে যেন বললো, ভালো মানুষটা বের হইলো। ফিরলো মরা।
– কি হইছিলো? এক্সিডেন্ট?
– আরে না! হেরা দুই ভাই। বড় ভাই আর ছোট ভাই দুইয়েই রিশকা চালায়। সকালে  গ্যারেজে যাইতাছিলো। হঠাৎ করে ছোট ভাই রাস্তার মধ্যে বইস্যা পড়লো। বড় ভাই জিগাইলো, কিরে কি অইছে?
ছোট ভাই কইলো, ভাইরে বুকতে কেমন লাগে! এক গেলাস পানি খাওয়াও।  বড় ভাই গেলো পানি আনতে, আইস্যা দেখে ছোট ভাই মইর‍্যা পইড়া আছে।
বর্ণনা শুনে হা হুতাশ করে লোকে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, জানাজা কহন? কাফন দাফনের কি ব্যবস্থা?
ঘরে দাওয়ায় মাথায় দিয়ে বসা ছিলো বড় ভাই। কাফন দাফনের কথা কানে যেতেই যেন আবার ভাইয়ের শোক  উতলে উঠে তাঁর। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সে।
লোকে ভাবে, কাফনের টাকা হয়তো নেই। দাফনের ব্যবস্থা নিয়া হইতো পেরাশান। নাইলের গরীবের আবার এতো শোক কি?
যারা জটলা বেধে কথা বলছিলো তারা এগিয়ে যায়। একজন সান্ত্বনা দিয়ে বলে, চিন্তা কইরোনা মিয়া। কাফনের দাফনের জন্য ঠেইকা থাকবোনা।
অমুক বলে, আমার কাপড় দোকান আছে। কাফনের কাপড়টা নাহয় আমিই দেব।
তমুক বলে, আমার বাঁশের ঝাড় আছে। বাঁশ যে কয়খান লাগে আমার এখান থেকেই নিও।
বড় ভাইয়ের কান্না থামে। সে চোখ মুছে মন শক্ত করে বলে, কারো দেয়া লাগবোনা। আমার ভাইয়ের দাফন কাফন কারো দানে করুমনা আমি।

তিন

বিশাল বাড়িখানা আলোতে ঝলমল করছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বোধহয় কোন বিয়ে বাড়ি বোধহয়। অবশ্য কোলাহল নেই। একদম শান্ত শিষ্ট। বাড়ির গেইটে দারোয়ানের পাশে বসে হঠাৎ বাতাসে কান পেতে কি যেন একটা শোনার চেষ্টা করলো বাড়ির কুকুরটা। তারপর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। দুর থেকে একটা শোরগোলের শব্দ শোনা যেতে লাগলো। কাঁধে করে একটা খাটিয়া নিয়ে হাজির হলো বেশ কিছু লোকজন।
– গেইট খোলেন। গেইটের মধ্যে মাথা ঠেকিয়ে বললেন একজন। দারোয়ান গেইটের কাছে এগিয়ে গেলেন। বললেন, লাশ বাইরেই রাখতে বলছে।
– বাইরে রাখবো মানে? বাড়ির কেউ দেখবোনা?
দারোয়ান গেইট ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে এলেন। একটা জায়গা দেখিয়ে সেখানে খাটিয়াটা রাখতে দেখিয়ে বললেন, স্যারের ছেলেমেয়েরা আদরে মানুষ। লাশ বাড়িতে ঢুকাইলে ভয় পাবে।
লোকজন দারোয়ানের কথা শুনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। কেউ কেউ অবশ্য দারোয়ানের কথায় তাল দিয়ে বলে, হ! বাচ্চা কাচ্চাদের লাশ না দেখানোই ভালো। মনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। বয়স কতো তাদের?
– ছোটটার  পঁচিশ! আর বড়টা… , দারোয়ান নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে।
বাকি কথা আর কানে ঢুকেনা লোকের। পঁচিশ বছরের বাচ্চা? বাপের লাশ দেখলে ভয় পাবে? আর কিছু ভাবতে পারেনা তারা। শেষে একজন “বড়লোকদের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা” বলে পুরো ব্যাপারটা মীমাংসা করে দেন। একজন লোক এগিয়ে গিয়ে দারোয়ান কে বললেন, ভাই, লাশটা উদোম পড়ে আছে। একটা চাঁদর টাদর কিছু আছেন কিনা দেখেন তো!
দারোয়ান মাথা নেড়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। কে যেন ইতোমধ্যে নিজের টাকায় কিছু আগরবাতি এনে লাশের খাটিয়ায় গেঁথে দিয়েছে। আগর বাতির গন্ধে ম ম করছে পুরো জায়গাটা। একটু পরেই দারোয়ান ফিরে আসলো। জানালো, বাড়িতে লাশ ঢাকার জন্য সস্তা কোন কম্বল নেই। এতো রাতে দোকান খোলা পাওয়া যাবে? টাকা দিয়েছে কিনে নেওয়ার জন্য।
লোকজন বললো, তাঁর আর দরকার নেই। ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
শীতের রাতে অনেকেই গাঁয়ে চাদর জড়িয়ে এসেছিলেন। তাদের মধ্যেই একজন নিজের চাদরটা দিয়ে লাশের উপরটা ঢেকে দিয়েছেন ইতোমধ্যে। রাত গভীর হতে থাকলো। শীতের প্রকোপও বাড়তে শুরু  করলো। উৎসাহী যারা এতক্ষণ লাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের ভিড় কমতে শুরু করে ধীরে ধীরে।
একসময় প্রায় খালি হয়ে যায় জায়গাটা। শেষ যে কয়জন ছিলেন যাওয়ার আগে  দারোয়ান কে ডেকে বললেন, ভাই, আমাদের তো এবার যেতে হয়। কিন্তু লাশের পাশে তো কারো না কারো থাকা দরকার।
দারোয়ান বললো, বাড়ির সবাই তো ঘুমিয়ে গেছে। এক কাজ করেন, লাশটা একটু ধরাধরি কইর‍্যা আমার গেইটের কাছে রেখে যান। আমিই পাহারা দেই।

চোখটা  যেন একটু লেগে এসেছিলো দারোয়ানের। চোখ খুলতে দেখে ভোর হয়ে এসেছে। প্রচণ্ড কুয়াশা পড়ছে বাইরে। সেইসাথে একটু একটু দমকা হাওয়া শীতটাকে আরো ঝাঁকিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। গেইট ফাঁক গলিয়ে বাইরে তাকাতে দেখলো দমকা হাওয়ায় লাশের উপরে দেওয়া চাদরটা সরে গেছে। বাইরে বেরিয়ে এলো সে। চাদরটা ঠিক করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন ওনি। লাশটা কি কাঁদছে নাকি? নাহ! পরক্ষনেই বুঝতে পারলেন ভুল দেখেছেন। আসলে কুয়াশার ফোঁটা লাশটার চোখ থেকে ঠিক অশ্রুর মতো গড়িয়ে পড়ছে।