বন্ধু জাফরকে দেখলাম ভয়াবহ রকমের কাঁপছে।
বললাম, এক জায়গায় সুস্থির হয়ে বস। তারপর না হয় শুনা যাবে কি হয়েছে।
চায়ের দোকানে একটা বেঞ্চিতে হাত ধরে নিয়ে বসালাম ওকে। দুজনে প্রায় নীরবেই বলতে গেলে দুকাপ চা শেষ করলাম। এই সময়ে নিজেকে অনেকটাই গুছিয়ে নিলো সে। হাত পায়ের কাপাকাপি কমে গেছে। ওর চোখ সোজা রাস্তায়। অনুসরণ করে তাকালাম আমিও। দেখলাম রাস্তা পাড় হতেগিয়ে একটা তেলাপোকা গাড়ি চাপা পড়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। একটু পরেই আরেকটা গাড়ি এসে সেটাকে একেবারে থেঁৎলে দিয়ে চলে গেল। খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু অধিকাংশ সময় এগুলো চোখ এড়িয়ে যায়। তেলাপোকা হোক, আর আশেপাশে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা চোখ এড়িয়েই যাওয়া হোক, ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি।
চোখ ঘুরিয়ে জাফরের দিকে তাকালাম। ওর দৃষ্টি তখনও রাস্তায়ই পড়ে আছে।
– কারেন্ট ছিলনা বুঝলি? অন্ধকারে একটা চিৎকার…
প্রায় ফিস ফিস করেই বলতে গেলে কথা শুরু করলো সে। আমি অবশ্য বাধা দিলাম। মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
– গোঁড়া থেকে খুলে বল। কোথায় কারেন্ট ছিলনা? কখন ছিলনা?
জাফর খানিকটা সময় চুপ করে রইলো। রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে সামনের গাছটার পাতার আড়াল দিয়ে বোধহয় আকাশের দিকেই তাকালো। কথাগুলো গুছিয়ে নেওয়া হতেই আবার বলা শুরু করলো সে,
– আমি গিয়েছিলাম আমার এক আত্মীয়ের বিয়ের দাওয়াত খেতে। ঢাকার আশেপাশেই একটা জায়গায়। বিয়ের আয়োজন ছিল একটা কমিউনিটি সেন্টারে। কিন্তু ঢুকতে গিয়ে পড়লামে এক আজব ফ্যাসাদে। কি এক অজ্ঞাত কারণে মোবাইল ফোন নিয়ে ঢুকা নিষেধ করে দিলো সবাইকে। অদ্ভুত ব্যাপার আগে দেখিনি। কিন্তু সেজে গুজে গেছি, দাওয়ার না খেয়েতো আর ফেরা যায়না। তাই আর সকলের মতো আমিও সেলফোনটা বাইরে একটা জায়গায় জমা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। আর পাঁচটা বিয়ের মতোই নাচগান হৈ হুল্লোড় চলতে থাকলো। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটলো একটু পরে। হঠাৎ করে কারেন্ট চলে গেলো!
– তারপর অন্ধকার সেই চিৎকারটা শুনতে পেলি?
– নাহ! কে একজন যেন চেঁচিয়ে বলে গেলো জেনারেটরের কি যেন একটা সমস্যা! ঠিক হতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগবে।
– ওহ!
– একদিকে কারেন্ট চলে যাওয়ায় সব আলো চলে গেছে। তার উপর আবার কারো কাছেই সেলফোনও নেই যে একটু আলো জ্বালবে। একটা অদ্ভুত বিকট অন্ধকার নেমে এলো পুরো হলটা জুড়ে। হৈ হুল্লোড় থেমে গেছে ইতোমধ্যেই। কেউ কেউ অবশ্য নিচু গলায় একে অপরের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে থাকলো। ওখানে আমার তেমন কেউ পরিচিত ছিলনা, তাই সরে গিয়ে একটা কোনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। অন্ধকারটাও ধীরে ধীরে চোখে সয়ে আসতে লাগলো। ছায়া ছায়া মানুষের অবয়ব চোখে পড়ছে এখন। ঠিক তখনই একটা চিৎকার কানে এলো…। একটা মেয়ের গলা। ভয়াবহ চিৎকারটা মুহূর্ততেই পুরো হলটাকে হিম করে দিলো যেন। কিছু বুঝে উঠার আগেই বাইরে জেনারেটরের একটা মৃদু গুঞ্জন শুনা গেল আর তারপরেই দপ করে জ্বলে উঠলো আলোগুলো। দেখলাম…
এই পর্যায়ে এসে জাফর চুপ করে গেল। চোখদুটো কেমন যেন ছলছল করে উঠলো। এতক্ষণের স্থিরতা যেন হঠাৎ-ই কোথায় মিলিয়ে গেলো। হাত পা আবার আগের মতোই কাপতে শুরু করল। আমি অবশ্য ততক্ষণে কৌতূহলে নিজের স্বাভাবিক জ্ঞান খুইয়ে বসে আছি। তাই আর ওকে ধাতস্থ করতে গিয়ে সময় নষ্ট করলাম না। খুব দ্রুত বার কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম,
– কি দেখলি তারপর? দেখলিটা কি?
জাফর এবার মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর মাথাটা নুইয়ে বেঞ্চে আমার আর ওর বসার মাঝখানের ফাকা জায়গাটাতে কাঁপা কাঁপা হাতে আঙুল চালিয়ে আঁকিবুঁকি টানতে টানতে বললো,
দেখলাম একটা মেয়ে, আমার থেকে হাত তিনেক সামনে দাঁড়ানো। হ্যাঁচকা টানে কে যেন তাঁর বুকের কাপড়টা ছিঁড়ে নিয়েছে। প্রায় উন্মুক্ত হয়ে মেয়েটার ডান স্তনে একটা ভয়াবহ নখের আচরের দাগ!
আগেরবার মেয়েটা বোধহয় ব্যথায় চেঁচিয়েছিল। আলো ফিরতে কম করে হলেও প্রায় কুড়ি জোড়া চোখের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো তাঁর উপর। এবার দ্বিগুণ শব্দে লজ্জায় চিৎকার করে মেঝেতে এলিয়ে পড়লো সে। তাঁকে ঘিরে মুহূর্তের মধ্যেই একটা জটলা তৈরি হয়ে গেলো। আমিও এগিয়ে গেলাম। ভিড়ের মধ্যেই দেখতে পেলাম মহিলারা এসে ইতোমধ্যেই আগলে ধরেছে মেয়েটাকে। কারো একজনের চাদর দিয়ে শরীরটাও ঢেকে দেওয়া হওয়া তাঁর। কিছুক্ষণের মধ্যেই কয়েকজন চেনা আত্মীয় স্বজন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেড়িয়ে গেলেন।
একটানা কথাগুলো বলে জাফর থামলো।
– যৌন হেনস্থা। বুঝাই যাচ্ছে, অনুষ্ঠানে আগতদের মধ্যে বিকৃতমনা কেউ সুযোগ পেয়ে ঘটনাটা ঘটিয়েছে। যাহোক, আজকাল তো এগুলো প্রায় নিত্যকার ব্যাপার হয়ে গেছে। রাস্তা, ঘাটে চলতে ফিরতে এমন কত ঘটনা দেখি! তুই আগে কখনও দেখিসনি?
– দেখেছি। কিন্তু সেগুলো একটু পরেই ভুলে গেছি। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা অন্য!
– অন্য?
– হ্যাঁ! ঘটনাটার পর থেকেই আমি একটা একটা সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছি।
– কি রকম? মানুষিক? ট্রমা?
– অনেকটা ওরকমই।
– খুলে বল।
– মেয়েটাকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সে একবার ফিরে আমার দিকে তাকিয়েছিল। সেই সময় আমার মনে হলো মেয়েটার চেহারা ঠিক টুম্পার মতো!
– টুম্পার মতো? টুম্পাটা আবার কে?
জাফর অপরাধীর ভঙ্গিতে একবার আমার দিকে তাকালো। দেখলাম ওর চোখ ছল ছল করছে। দিনের আলো অনেকটাই কমে এসেছে এতক্ষণে। চায়ের দোকানে জ্বালানো আলো গিয়ে পড়েছে ওর চোখে। অদ্ভুত রকম দেখাচ্ছে এখন ওকে। মনে হচ্ছে কয়েকটা খুন করে এসে যেন স্বীকারোক্তি দিচ্ছে কেউ।
– আমাদের এলাকায় থাকতো! আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন সে পড়তো ক্লাস সেভেনে। আমার বড় ভাইয়ের কাছে একসাথেই পড়তে বসতাম দুজন। একদিন ভাই যেন কোথায় বেড়িয়েছিল। টুম্পা আর আমি একা একাই বসে পড়ছিলাম। এমন সময় কারেন্ট চলে গেল। আমি সেই সুযোগে…
– বুঝেছি! আর বলা লাগবেনা!
– ঠিক এইভাবেই চেঁচিয়ে উঠেছিল সে…
– ছি! তুইও দেখি তাদের দলেই পড়িস। তুই আমার বন্ধু এটা ভাবতেই এখন লজ্জা লাগছে আমার!
তীব্র ক্রোধে কথাগুলো বললাম ওকে। প্রচণ্ড একটা আক্রোশ আর ঘৃণা ঘিরে ধরলো আমায়। জাফর বোধহয় বুঝতে পারলো আমার মনোভাব। সে মাথা নুইয়ে আগের মতোই টেবিলে আঁকিবুঁকি টানতে লাগলো। ওর দিকে আর তাকাতেই ইচ্ছে করছেনা আমার। মনে হলো জঘন্য লোকটার গায়ে থুথু ছিটিয়ে দেই। কিন্তু শেষ অবধি সামলে নিলাম নিজেকে। কিছুটা সংযত স্বরেই বললাম,
– তুই আর আমার বন্ধু থাকার যোগ্যই নস। আজকের পর থেকে আর আমার সাথে কোনরকম যোগাযোগ করবিনা।
জাফর মুখ তুলে তাকালো আমার দিকে। প্রথমে ওর চেহারায় আগের সেই অপরাধী ভাবটা থাকলেও ক্রমেই দেখলাম সেটা মিলিয়ে গিয়ে একটা বিস্ময়ে হতবাক হওয়ায় পরিণত হলো। ভালো করে খেয়াল করতে দেখলাম ঠিক বিস্ময় যেন নয়, কিসের একটা ভয় চিকচিক করছে ওর চোখে।
আমি বললাম, উঠি।
– এক মিনিট!
খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল সে। কেমন যেন ভড়কে দেয়ার মতো শুনালো গলার আওয়াজটা। কি যেন একটা বলতে গিয়েও থতমত খেয়ে গেলাম আমি। তাই পালটে বললাম,
– কি! এক মিনিটের সময় নেই! তোর সাথে আর কোন কথা নেই আমার!
– আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছি!
জাফর তেমনি অদ্ভুত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো।
– পাগল?
– হ্যাঁ! তখন ওই মেয়ের মুখে টুম্পার চেহারা দেখেছিলাম, এখন কি দেখতে পাচ্ছি জানিস?
– কি?
– তোর মুখে আমার চেহারা!
– কি বলছিস যা…তা!
জাফরের কথায় ঢোক গিলে বললাম আমি। একটু অদ্ভুত রকম ভয়ের অনুভূতি হলো কেমন যেন। মনে মনে নিজেকে সাহস দিতে ভাবলাম, যত যাই হোক আমার কথা আমি কাওকে বলবনা। অন্ধকার ছেড়ে আলোতে আমি কিছুতেই আসবনা।