[su_box title=”সহজ পাঠের গপ্পো” style=”soft”]
- দৈর্ঘ্যঃ ৮১ মিনিট
- রঙঃ রঙিন
- দেশঃ ভারত
- ভাষাঃ বাংলা
- পরিচালনাঃ মানস মুকুল পাল
- প্রযোজনাঃ অভিজিৎ সাহা
- চিত্রনাট্যঃ মানস মুকুল পাল
- অভিনয়ঃ নুর ইসলাম, সামিউল আলম, স্নেহা বিশ্বাস এবং আরো অনেকে…
- সঙ্গীতঃ ইন্দ্রজিৎ দাসগুপ্ত
- চিত্রগ্রহণঃ মৃন্ময় মন্ডল, সুপ্রতিম বোল
- সম্পাদনাঃ সুজয় দত্ত রায়, অনির্বান মাইতি
- শিল্প নির্দেশনাঃ মৃদুল বৈদ্য, সাস্বতী কর্মকার
[/su_box]
সিনেমা সব গল্প নিয়েই বানানো যায়। আসল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মানুষের কঠিনতম রূঢ় বাস্তবকে ও তাঁর সামাজিক কার্যকারণকে খুব সহজ ভাষায় ইঙ্গিত করা। হ্যাঁ, ‘সহজ পাঠের গপ্পো’ ছবিটি খুব সহজভাবেই এই কঠিন কাজটি করে ফেলেছে। চরম দারিদ্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়া একটি পরিবার, দুই বালকের স্বপ্ন ও বাস্তব, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ এবং প্রকৃতির সঙ্গে সেই যাপনের নিবিড়তা- এইসব নিয়েই একটি সহজ গল্প বলতে চেয়েছেন পরিচালক। প্রথম ছবিতেই পরিচালক যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা এক কথায় বিরল। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’। মানস মুকুল পাল কিন্তু সহজভাবেই গল্প বলেছেন ‘সহজ পাঠের গপ্পো’ ছবিতে।
“ও মা, কোথায় যাচ্ছো মা? ও মা, যেও না মা…”
পেছনে কাঁদতে কাঁদতে ছুটছে ছেলেটি। মা ছুটছে আধো অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে। দূর থেকে ভেসে আসছে ট্রেনের আওয়াজ।
“ও মা, শোনো মা…”
গলা দিয়ে উঠে আসে অসহায়ত্ব। কাতর আর্তনাদ হয়ে ওঠে কথা গুলো।
মা ছুটতে ছুটতে পেছন ফিরে ইঁট তুলে ধরে ছেলের দিকে।
“একদম আসবি নে বলছি। যা… যা…”
ছেলে পেছন পেছন ছুটতে থাকে। মায়ের শাড়ির প্রান্তটুকু ধরে ফেলে। মা ছুটে যায় ট্রেনের দিকে, আওয়াজ স্পষ্টতর হয়। খুলে যায় শাড়ি।
এটা “সহজ কথার গপ্পো” সিনেমারই একটা দৃশ্য। এই সিনেমার গল্পটি মূলত দুই ভাই ছোটু ও গোপালকে কেন্দ্র করে যাদের বয়স যথাক্রমে আনুমানিক ৬ এবং ১০। ওদের বাবা ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন কিন্তু বর্তমানে একটি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে শয্যাশায়ী। ফলস্বরূপ সংসারে রোজগার বন্ধ। মা খুব কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছেন। বড় ভাই গোপাল বুঝতে পারে ওকে কাজ করে রোজগার করতে হবে। তাই সে ভাই ছোটুকে সঙ্গে করে বিভিন্ন কাজকর্ম শুরু করে। লোকের বাড়ির কুয়া পরিষ্কার থেকে শুরু করে বাজারে গিয়ে তাল বিক্রি করা পর্যন্ত। এই সময় জন্মাষ্টমী উপলক্ষে গ্রামের একটি ধনী প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ পরিবার বিরাট পুজোর অনুষ্ঠান আয়োজন করে।যার মূল আকর্ষণ গ্রামের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে পোলাও খাওয়ানো হবে। সেইমত দুই ভাই তাদের নিজেদের মত করে পরিকল্পনা করতে থাকে। গোপাল ভাবে পূজা উপলক্ষে যদি দুটো তাল বিক্রি করে কিছু টাকা উপার্জন করা যায় আর ছোটু পোলাও খাওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে। এর আগে সে কোনদিন পোলাও খায়নি। এভাবেই সিনেমাটির গল্প এগিয়ে যায়।
এই সিনেমার মূল শক্তি অনবদ্যভাবে লেখা একটি রিয়েলিস্টিক চিত্রনাট্য ও সংলাপ। অত্যন্ত সহজ, কায়দাবিহীন কিছু দৃশ্য। সংলাপ ও দৃশ্যের ফাঁকে অজান্তে এসে পড়ে অন্য কোনও প্রশ্নের ইঙ্গিত এবং দর্শক সেই ভাবনার পরিসরটুকু পাবেন সহজভাবেই।
সিনেমাটির অন্য একটি সম্পদ অবশ্যই অভিনয়। মূল চরিত্রে শিশু অভিনেতাদের দিয়ে কাজ করানোর একটা সুবিধা হল গোটা ছবির মধ্যে একটা নিষ্পাপ ব্যাপার ছড়িয়ে পড়ে। দেশ-বিদেশের নানা সিনেমায় আমরা সেই উদাহরণ পেয়েছি। কিন্তু শিশু অভিনেতাদের দিয়ে স্বতস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক অভিনয় করানোটাই অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। মানস মুকুল পাল সেই কাজটিই করেছেন অত্যন্ত নিপুণভাবে। মায়ের চরিত্রে অভিনেত্রী স্নেহা বিশ্বাস যে অভিনয়টা করেছেন তা প্রায় আন্তর্জাতিক মানের। মানস মুকুল পাল প্রমাণ করেছেন যে অভিনয়টা তিনি করিয়ে নিতে জানেন। এমনকি একটি আনকোরা ছেলের মধ্যে থেকেও সেরা অভিনয়টা বের হয়ে এসেছে। শ্রেষ্ঠ শিশু-অভিনেতার জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছে সামিউল আর নূর যুগ্মভাবে।
খুব মিনিমাল শিল্প-নির্দেশনা ছবির বিষয়কে ফুটিয়ে তোলে। দেখে বোঝাই যায় যে অন্তঃদৃশ্যগুলি ‘রিয়েল লোকেশন’–এ শ্যুট করা হয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই ছবির বাস্তবসম্মত সিনেমাটোগ্রাফি। ছবির শেষের দিকের মন্তাজ-এর কিছু শটের সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’-র শাপলা ফুল আর ফড়িং ইত্যাদির ক্লোজ আপ -এর মিল টানাই যায়। অত্যন্ত নিপুণভাবে, সামান্য কৃত্রিম আলোর ব্যবহারে বা অনেকক্ষেত্রে স্বাভাবিক আলোতেই দৃশ্যগুলি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ছবির প্রায় পুরোটা জুড়েই বর্ষাকাল। গ্রামাবাংলায় এই সময় যে স্যাঁতস্যাতে আলোটা থাকে সারাদিন ধরে, সেটাই এগিয়ে নিয়ে যায় গল্পকে। নিমন্ত্রণবাড়ির স্বপ্নদৃশ্যে আবার আলোটা বদলে যায়। যেমন বদলে যায় শেষদৃশ্যের মন্তাজেও। কালার গ্রেডিং এর কথাও উল্লেখ করার মতো। এখনকার ডিজিটাল সিনেমাটোগ্রাফি-তে এই বিভাগের কাজ আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, এই ধরণের ধূসর বাস্তবকে ফুটিয়ে তোলার জন্য যে ধরণের অ্যাস্থেটিকস এর প্রয়োজন হয়, এই সিনেমায় তার ছাপ রয়েছে।
এই সিনেমাটি আমার মতে পলিটিক্যাল। সিনেমাটি এইভাবে বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তার ভাষা নির্বাচন, চরিত্র নির্বাচন, অভিনেতা নির্বাচন, পোশাক নির্বাচন, শট টেকিং, ছবি করবার পদ্ধতি এবং সর্বোপরি শাক ভাত এবং পোলাও-এর দ্বন্দ্ব এই সিনেমাটিকে বহুদূরে টেনে নিয়ে যায়। কোনো ভণিতা না থাকার কারনেই প্রাণের ছোঁয়া সিনেমার নির্মাণে দেখা যায়। তাই অল্প বয়সেই ছোটুর দাদা গোপাল বুঝে যায় জীবনের বাণিজ্যিক সত্যিটা। এ সিনেমা আমাকে বাধ্য করে নির্লিপ্তির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে। যে ফ্রেমে জানালায় মুখ রেখে ছোটু বলে ওঠে “ও ভগবান, ওরা আমাদের নেমন্তন্ন করবে তো ভগবান?”
এই সিনেমা দেখার সময় মনে হচ্ছিলো আমার শৈশব আমার কানে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। আমি এক পাঠ মন দিয়ে পড়ছি, যে পাঠে কোনো মন খারাপ নেই; এখানে যেনো সবকিছুই ম্যাজিক্যাল। এ এক ভালোবাসার সহজ পাঠ। সহজ পাঠের গপ্পো বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। প্রযোজককে ধন্যবাদ এই সিনেমাটিকে বড় পর্দা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য। পরিচালকের উদ্দেশ্যে বলতে হয়- হ্যাটস অফ ট্যু মানস মুকুল পাল।
পরিশেষে বলাই যায়, “আর কিছু লাগে না- চিত্রনাট্য,পরিচালনা আর অভিনয় মিলেই হয় ভালো সিনেমা।”