আধুনিক দর্শনে বুদ্ধিবাদের বিকাশ যার হাত ধরে ঘটেছিলো তিনি হচ্ছেন ফরাসি দার্শনিক রনে দেকার্ত। এরপর থেকে বুদ্ধিবাদ শক্তিশালী ধারা হিসেবে বিকাশ লাভ করে। রনে দেকার্তের দার্শনিক জিজ্ঞাসার মূলে ছিলো কোনো কিছুর জ্ঞানে কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়। তার সবচেয়ে বৈপ্লবিক চিন্তা হচ্ছে ‘স্কেপ্টিসিজম’ বা সংশয়বাদ। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা উভয়কেই সংশয় করা যায়। তবে তিনি সংশয়বাদী ছিলেন না। তাঁর সংশয় ছিলো পদ্ধতিগত সংশয়বাদ। পরবর্তীতে জ্ঞানের সমস্যা সমাধানে তিনি একটি পদ্ধতির প্রস্তাব করেন। দেকার্তের মতামত অনুযায়ী, কোনো কিছুকে পরিষ্কারভাবে এবং ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত আমরা সেটাকে সত্য বলে ধরে নিতে পারি না। সেজন্য জটিল সমস্যাকে যতগুলো সম্ভব একক সমস্যায় ভেঙে নেওয়া দরকার। তখন সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সহজ ভাব থেকে আমরা চিন্তা শুরু করতে পারি। তাই দর্শনের অগ্রসর হওয়া উচিত সরল থেকে জটিলের দিকে। চিন্তা সূত্র আকারে তাঁর বিখ্যাত উক্তি হলো- “আমি চিন্তা করি অতএব আমি আছি।” কেননা যতই সংশয় পোষণ করা হোক না কেনো- সংশয় পোষণের জন্য চিন্তার কর্তাকে থাকতে হয়।
তাকে দ্বৈতবাদীও বলা হয়। কারণ তাঁর দর্শন মতে, দুই ধরনের বাস্তবতা বা সারবস্তু রয়েছে। একটি সারবস্তু হচ্ছে, চিন্তা বা মন অন্যটি ব্যাপ্তি বা বস্তু। মন পুরোপুরি সচেতন এবং স্থানগত দিক দিয়ে কোনো জায়গা দখল করে না, ফলে এটাকে ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত করা যায় না। অন্যদিকে বস্তু জায়গা দখল করে এবং একে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংশে ভাগ করা চলে। বস্তুর কোনো চেতনা নেই। দেকার্তের মতে, দুই সারবস্তুই ঈশ্বর থেকে এসেছে। কিন্তু এ দুই সারবস্তুর মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। এজন্য দেকার্তকে দ্বৈতবাদী বলা হয়।
রনে দেকার্তের জীবনেও প্রেম-ভালোবাসা-বিচ্ছেদ ছিলো। তিনি তাঁর প্রাক্তনের উদ্দেশ্যে একটি বিচ্ছেদপত্রে লিখেছিলেন- পান করার জন্যই আমি টিকে আছি, সে কারণেই আমি মাতাল। হা হা হা! ওয়াইনভর্তি ছয় নম্বর গ্লাসটা হাতে তুলে নেওয়ার পর আমার মনে হলো লেখাটা এভাবে শুরু করলে আমার জন্য সহজ হবে। কিন্তু আমি এখনো কী লিখবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ওহ, তুমি ছাড়া আমার জগৎটা যে কত ছোট সেটা কী করে তোমাকে বোঝাবো আমি? আচ্ছা, আমি আবার একটু গুছিয়ে শুরু করি। দর্শন হচ্ছে একটা গাছের মতো, এর সব ডালপালাই পাখা মেলে গাছটা থেকে বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তুমি হচ্ছো ঝোপের মতো। ছোট এবং সুন্দর কিন্তু যুক্তিবাদী চিন্তায় একেবারেই অজ্ঞ। আমি কী বলতে চাচ্ছি সেটা কি তুমি বুঝতে পেরেছো?
রেনে দেকার্তের মনে তরুণ বয়সেই মানুষ এবং মহাবিশ্বের স্বরূপ জানার জন্য একটি অন্তর্দৃষ্টি পাবার প্রবল ইচ্ছা জাগে। গভীর অধ্যয়নের পরে রেনে দেকার্ত এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, ইউরোপীয় মধ্যযুগ থেকে যে জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এসেছে তা খুব বেশি নির্ভরযোগ্য নয়। তিনি তখন ঠিক করলেন, সারা ইউরোপ ঘুরে বেড়াবেন। এ কারণে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধে চলে গেলেন তিনি, তার ফলে মধ্য ইউরোপে কিছু দিন থাকার সুযোগ হলো তাঁর। সেনাবাহিনীতে তিনি কী করতেন তা সঠিক ভাবে জানা যায় না। ১৬১৯ সালে তিনি সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন। এর পর প্যারিসে কাটান কিছু বছর, তারপর ১৬২৯ সালে চলে যান হল্যান্ড। সেখানে গণিত আর দর্শন বিষয়ক লেখালেখি নিয়ে কাটিয়ে দেন প্রায় বিশ বছর। তিনি জ্যামিতি ও বীজগণিতের মধ্যকার সম্পর্ক নিরূপন করেন, যার দ্বারা বীজগণিতের সাহায্যে জ্যামিতিক সমস্যা সমাধান সম্ভব হয়। গণিত পড়েছে কিন্তু কার্তেসীয় গুণজের কথা শোনেনি, এমন মানুষ পাওয়া ভার। এই ‘কার্তেসীয়’ শব্দটি দেকার্তের সম্মানেই রাখা হয়। দেকার্ত এর ল্যাটিন প্রতিশব্দ ‘কার্তেসিয়াস’ থেকে কার্তেসীয় হয়েছে। জ্যামিতির ক্ষেত্রে দেকার্ত একরকম বিপ্লব সাধন করেন। লা জিওম্যাত্রিতে দেকার্ত দেখান, বক্র রেখাকেও দ্বিমাত্রিক সমতলে X ও Y অক্ষরেখায় প্রকাশ করা সম্ভব যা থেকে বীজগণিতে রূপান্তর সহজ হয়ে যায়। তিনি সূচক লেখার আধুনিক পদ্ধতি তৈরি করেন।
রেনে দেকার্ত লেখালেখি করতেন ল্যাটিন ভাষায়। পরবর্তীতে তাঁর বইগুলো বিশ্বের প্রধান সব ভাষাতে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ইসাক বেকম্যনের সঙ্গে যৌথভাবে আ ট্রিটিজ অন মিউজিক অ্যান্ড দ্য এসথেটিকস অব মিউজিক (১৬১৮), রুলস ফর দ্য ডিরেকশন অব দ্য মাইন্ড (১৬২৬-২৮), দ্য সার্চ ফর ট্রুথ (১৬৩০-৩১), ডিসকোর্স অন দ্য মেথড (১৬৩৭), জিওমেট্রি (১৬৩৭), মেডিটেশনস অন ফার্স্ট ফিলোসফি (১৬৪১), প্রিন্সিপালস অব ফিলোসফি (১৬৪৪), দ্য ডেসক্রিপশন অব দ্য হিউম্যান বডি (১৬৪৮), প্যাশনস অব দ্য সোল (১৬৪৯)। এর মধ্যে ডিসকোর্স অন দ্য মেথড ও মেডিটেশনস অন ফার্স্ট ফিলোসফি বাংলায় অনূদিত হয়েছে।
রেনে দেকার্তের বয়স যখন দশ বছর (১৬০৬ সাল) তখন তাকে কোলেজ রোয়াইয়াল অঁরি-ল্য-গ্রঁ জেসুইট কলেজে পাঠানো হয়। তিনি সেখানে ১৬১৪ সাল পর্যন্ত পড়েন এবং ১৬১৫ সালে পোয়াতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। একবছর পর তিনি ধর্মীয় অনুশাসন ও দেওয়ানি আইনে বাকালোরেয়া অর্থাৎ উচ্চ-মাধ্যমিক সনদ ও লাইসেন্স লাভ করেন। ১৬৪৯ সালে রাণী ক্রিস্টিনার আমন্ত্রনে সুইডেনযান এবং সেখানে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের শীতকালে মৃত্যুবরণ করেন।
আজ ৩১শে মার্চ এই বিখ্যাত দার্শনিক, গণিতবিদ এবং বিজ্ঞানীর জন্মদিন। ১৫৯৬ সালের আজকের এই দিনে তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন। জন্মদিনে তাঁর জন্য খিচুড়ির পক্ষ থেকে রইলো সশ্রদ্ধ সম্মান।