রাফায়েল – রেনেসাঁস যুগের অন্যতম প্রধান চিত্রশিল্পী

সিস্টিন ম্যাডোনা, ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড উইথ সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্ট, দ্য ট্রান্সফিগারেশন, দ্য স্কুল অফ অ্যাথেন্স, ডিস্পুটেশন অফ দ্য হোলি স্যাক্রাম্যান্ট-এর মতো বিখ্যাত চিত্রকর্মের স্রষ্টা ছিলেন রাফায়েল্লো সেনজিও দ্যা আরবিনো। যাকে সবাই রাফায়েল নামেই চিনে। তিনি তাঁর ছবিতে মানুষের আবেগ-অনুভূতি জীবন্ত করে তুলতেন। ছোটবেলা থেকেই চিত্রশিল্পে তার হাতে খড়ি হয় ডিউকের শিল্পী তার বাবা জিওভানি দ্য সানতিও-র কাছ থেকে। এরপর তিনি এঁকেছেন একের পর এক বিশ্ববিখ্যাত ছবি।

রাফায়েল ভাস্কর হিসেবেও খ্যাতিমান ছিলেন। রাফায়েলকে বলা হতো নন্দনশিল্পী। তাঁর ছোট্ট জীবন প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিলো। ২১ বছর বয়স পর্যন্ত উচ্চ উচ্চ টাইবার উপত্যকার উম্ব্রিয়া নামক উপত্যকায় অতিবাহিত করেন। ১৫০৪ খ্রিষ্ট্রাব্দের শেষের দিকে তিনি ফ্লোরেন্সে যান এবং সেখানে চার বছর অতিবাহিত করেন। সেখানে তাঁর অবস্থানকালকে ‘ফ্লোরেন্টাইন লেসন’ বলে অভিহিত করা হয়। ১৫০৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে তিনি রোমে যান এবং ১৫০৯ খ্রিষ্টাব্দে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের জন্য ‘দ্য স্কুল অফ এথেন্স’ এর কাজ শুরু ইতিলিয়ান ভাষায় এর নাম- ‘ইস্কোয়ালা দি এতেনে’। ‘দ্য স্কুল অফ এথেন্স’ রেনেসাঁ যুগের একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম। চিত্রকর্মটি তিনি করেছেন ১৫১০-১৫১১ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে। এটিকে রাফায়েলের অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য কর্ম হিসেবে গণ্য করা হয় বিশেষত এটার উচ্চমার্গীয় আত্মিক দিক সম্পর্ক বিবেচনা করে। এটি সংরক্ষিত করা আছে পোপের নিজ বাসভবনে। এটি ঝুলানো আছে লা ডিসপোটার ঠিক উল্টা দিকের দেয়ালে। পোপের একটি কামড়া রাখা আছে শুধুমাত্র রাফায়েলের জন্য; এখানে তার অনান্য চিত্রকর্ম গুলোর সাথে এটি স্থান পেয়েছে। শিল্পী রাফায়েল মাত্র ২৭ বছর বয়সে এ চিত্রটি আঁকেন। চিত্রটির দৈর্ঘ্য ৭৭০ সেন্টিমিটার। এটি আসলে কোন বিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। বরং প্লাটফর্ম, যেখানে প্রাচীনকালের বিখ্যাত দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, কবি সবাই একত্রে উপস্থিত হয়েছেন। চিত্রে বিশাল গম্বুজবিশিষ্ট একটি হলঘর দেখা যায়। ফিগারগুলোকে মাঝ বরাবর সরলভাবে সাজানো হয়েছে। ছবিটিতে ফর্ম এবং রেখার মাধ্যমে ফিগারগুলোর মধ্যে মৌলিকত্ব ফুটে উঠেছে। রাফায়েল চিরাচরিত রং ও আলোর ব্যবহারের পরিবর্তে ফিগারগুলোকে ভেতর থেকে আলোকিত করে তুলেছেন। সম্মুখ ভাগের ফিগারগুলোর নিশ্চল আড়ষ্ঠ ভঙ্গির বদলে সহজ গতি ভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। পেছনের ফিগারগুলোর সঙ্গে তাদের দূরত্ব কমিয়ে এনে একটা কর্মতৎপরতা এবং স্বতঃস্ফ‚র্ততা তৈরি করা হয়েছে। ফলে চিত্রটি হয়ে উঠেছে সাবলীল ও প্রাণবন্ত। প্রতিকৃতিগুলো অনেক প্রাণবন্ত ও গতিশীল। কম্পোজিশনের দিগন্ত রেখা বিস্তৃত ও প্রসারিত। বিষয়বস্তুতে আছে বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি। চিত্রটিতে শিল্পী সময়কে মূর্ত করে তুলেছেন নিপুণ হাতে। চিত্রের ডান দিকে ইউক্লিড শিষ্য পরিবেষ্টিত অবস্থায় একটি প্রতিপাদ্য বিশ্লেষণ করছেন। 

The School of Athens

 

 

‘ম্যাডোনা সিরিজ’ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মের ভেতর দিয়ে বিখ্যাত রাফায়েলের আবির্ভাব। ম্যাডোনা মানে হচ্ছে কুমারী মেরি-মাতা। তার আঁকা এই সিরিজের সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিটির নাম ‘সিস্টাইন ম্যাডোনা’। এটি প্রকৃতপক্ষে যীশুখ্রিস্টের মায়ের ছবি হলেও, এই ছবিটিতে ম্যাডোনার মানবী রূপটিই ফুটে ওঠে। রাফায়েল কীভাবে ‘সিস্টিন ম্যাডোনা’ ছবিটি এঁকেছিলেন সে বিষয়ে একটি গল্প আছে। একজন চাষির স্ত্রীকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নাকি ছবিটি আঁকা। কথিত আছে, একবার রাফায়েল এক গ্রামের মধ্যে দিয়ে হাঁটছিলেন। এমন সময়ে তার চোখে পড়ল এক চাষির স্ত্রী, যার কোলে একটি শিশু আর অন্য একটি শিশু আঁচল ধরে টানছে। এই দৃশ্য দেখার পর রাফায়েলের মনে হলো, এমন অপরূপ মাতৃমূর্তি তিনি আর কখনো দেখেননি। তাই তিনি সেটি দেখে একটি প্রাথমিক নকশা আঁকেন। পরবর্তীতে, ১৫১২ সালে সেই নকশাটি থেকেই তিনি আঁকলেন বিখ্যাত ‘সিস্টিন ম্যাডোনা’। বর্তমানে জার্মানির ড্রেসডেন শহরের কেন্দ্রীয় জাদুঘরে এই ছবিটি রাখা আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া ড্রেসডেন শহর দখল করার পর ছবিটি মস্কোতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে দুই জার্মানি একত্র হলে আবার ছবিটি মস্কো থেকে ড্রেসডেনে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়।

Sistine Madonna

রেনেসাঁর দৃশ্যপটে রাফায়েলের আবির্ভাব ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সে। রোমের বহু বিখ্যাত ভবনের দেয়ালচিত্র এঁকে তিনি ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। এর মধ্যে পোপের পাঠাগার ও দফতর, ভ্যাটিকানের স্তানজা দেল্লা সেইঞাতুরা, স্তানজা দেলিওদোরো প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এর পাশাপাশি সাজসজ্জার কাজের পূর্ণতা সাধনের জন্য ১০টি বৃহৎ পর্দার নকশা অঙ্কনে দক্ষতা ও গ্রহণশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন রাফায়েল। তার সবচেয়ে বিখ্যাত দেয়ালচিত্রের নাম ‘দ্য ফায়ার ইন বোর্গো’।

আজ এই বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর জন্ম ও মৃত্যু দিবস। ১৪৮৩ সালের ৬ই এপ্রিল তিনি জন্মেছিলেন ইতালির উরবিনো শহরে আর ১৫২০ সালের এই দিনেই রাফায়েল মারা যান মাত্র ৩৭ বছর বয়সে; তবে এর মধ্যেই অনেক উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম করে গেছেন। এতো অল্প সময়ে এতো অপরূপ চিত্রকর্ম আর কোনো শিল্পী করেননি। রাফায়েল ইতালীয় রেনেসাঁসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর ছিলেন। তিনি তাঁর কালোত্তীর্ণ শিল্পকর্মের জন্য বিশ্বের চিত্রশিল্প ইতিহাসে বিশেষ স্থানের অধিকারী। মানব প্রতিকৃতির বহু নতুন ধরণ এবং মডেলের জন্য নতুন নতুন মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতির আবিষ্কারকও তিনি।

 

তিনি শিল্পের ইতিহাসে অমর। তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিনে খিচুড়ির পক্ষ থেকে ইতালির রেনেসাঁস যুগের এই বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর জন্য আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।