Site icon খিচুড়ি

এক কলঙ্কিত অধ্যায় রুয়ান্ডার গণহত্যা

১৯৯৪ সালের ৬ই এপ্রিল থেকে জুলাই এর মাঝামাঝি পর্যন্ত  সংখ্যালঘু টাট্‌সি গোষ্ঠীর মানুষ এবং সংখ্যাগুরু হুটু গোষ্ঠীর মধ্যে উদার ও মধ্যপন্থীদের নির্বিচারে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিলো। সেই গণহত্যায় অন্তত ৫ লাখ টাট্‌সি এবং এক হাজারেরও বেশি হুটু নিহত হয়। অনেকের মতে, সে সংখ্যা ৮ থেকে ১০ লাখ ছাড়িয়েছিলো। রুয়ান্ডার বাসিন্দাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশই হুটু, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে টাটসিরা দেশটির শাসন ক্ষমতায় ছিলো। ১৯৫৯ সালে টাটসি রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে হুটুরা। তখন হাজার হাজার টাটসি উগান্ডাসহ বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যায়।

 

সরকারি নির্দেশেই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিলো। নির্বাচিত টাটসির একটি দল বিদ্রোহী একটি বাহিনী গঠন করে যার নাম দেয়া হয় রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (আরপিএফ)। ওই বাহিনী ১৯৯০ সালে রুয়ান্ডায় অভিযান শুরু করে এবং ১৯৯৩ সালে শান্তি চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলতে থাকে। এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিল দুটি হুটু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দল: এমআরএনডি এবং সিডিআর। রুয়ান্ডার ঔপনিবেশিক যুগের অবসান ও হুটু পাওয়ার সংস্কৃতির উত্থানের পর সেখানে যে গোষ্ঠীগত ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছিলো তারই চূড়ান্ত পরিণাম এই গণহত্যা। ১৯৯৪ সালের ৮ এপ্রিল রাতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা এবং বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট সাইপ্রিয়েন নটারিয়ামিনা কে (যাদের দুজনেই হুতু সম্প্রদায়ের) বহনকারী বিমানটিকে গুলি করে ভূপাতিত করা হয। ওই বিমানে থাকা সব যাত্রী মারা যান। এই ঘটনার জন্য আরপিএফকে দায়ী করে হুতু চরমপন্থিরা এবং খুব তাড়াতাড়ি মানব হত্যার একটি সুপরিকল্পিত কর্মযজ্ঞ শুরু করে। এই গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলো সরকারি বাহিনী, হুটু  রাজনৈতিক নেতা, এমনকি সাধারণ ব্যবসায়ী সহ ত্রিশহাজার সদস্যের এক বিশাল বাহিনী। পরবর্তীতে সরকারি সেনাবাহিনী সংগঠিত হয়ে টাটসি অধুষ্যিত এলাকাগুলোতে চাপাতি এবং বন্দুক নিয়ে হামলা চালায়। কুপিয়ে এবং গুলি করে মারা হয় লাখ লাখ টাটসিকে, বাদ যায়নি চার্চে আশ্রয় নেয়া রিফিউজিরাও।

 

গনহত্যার ২৫ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু রেশ যায়নি এখনও

হুটু চরমপন্থিরা একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপন করে, যার নাম ছিল আরটিএলএম। ওই বেতার কেন্দ্র এবং পত্রিকার মাধ্যমে বিদ্বেষ মূলক প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হতো। মানুষকে ‘তেলাপোকা’ হত্যা করার জন্য বলা হতো; যার দ্বারা টাটসিদের হত্যা করা বোঝানো হতো। যেসব নামী ব্যক্তিদের হত্যা করা হবে, তাদের নাম ওই রেডিওতে পড়ে শোনানো হতো। প্রেসিডেনশিয়াল গার্ড এবং আনঅফিশিয়াল মিলিশিয়া গ্রুপের প্ররোচনায় অনেক সাধারণ মানুষও এই গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলো। অনেক হুটুকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের প্রতিবেশীদেরকে হত্যা করতে বাধ্য করা হয়। গণহত্যায় অংশ নেওয়ার জন্য অনেকভাবে প্ররোচনা দেওয়া হয় তাদেরকে। এমনকি হত্যার জন্য তাদেরকে খাদ্য এবং টাকাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হয়। অনেককে বলা হয়েছিলো যে, তারা টাটসিদেরকে মেরে তাদের বাড়িঘরও দখল করতে পারবে। ক্ষমতায় থাকা হুটুদের উদ্দেশ্য ছিলো টাটসি সম্প্রদায়কে চিরতরে রুয়ান্ডা থেকে মুছে ফেলা। তাই তারা বাদ দেয়নি শিশু এবং নারীদেরকেও।

 

সারিবদ্ধ কঙ্কাল, গনহত্যার সাক্ষী

রুয়ান্ডায় জাতিসংঘ এবং বেলজিয়ামের সৈন্য ছিলো। কিন্তু গণহত্যা বন্ধে জাতিসংঘ মিশনকে কোন দায়িত্ব দেয়া হয়নি। একবছর আগেই সোমালিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা নিহত হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে আর কোনো আফ্রিকান জাতির লড়াইয়ের মধ্যে ঢুকতে রাজী ছিল না। দশজন বেলজিয়ান সৈনিক নিহত হওয়ার পর বেলজিয়ামের সব সৈন্য এবং জাতিসংঘের বেশিরভাগ সৈনিককে রুয়ান্ডা থেকে সরিয়ে আনা হয়। জাতিসংঘ এই হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অনিচ্ছুক ছিলো। মিডিয়ায় সচিত্র সংবাদ পরিবেশন সত্ত্বেও জাতিসংঘের এমন ব্যবহারে সবাই মর্মাহত হয়েছিলেন এবং জাতিসংঘকে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। এই অনীহার কারণেই রুয়ান্ডায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে গণহত্যা মোকাবেলার মত যথেষ্ট সৈন্য ও কর্মকর্তা ছিল না। রোমিও ডালাইরে এর নেতৃত্বে এই শান্তিরক্ষী দলটি তাই কার্যকরী কিছু করতে পারেনি। একসময় রুয়ান্ডা থেকে সব বিদেশী লোকদেরকে সরিয়ে আনা হয়। কিন্তু সেখানকার অধিবাসীদের রক্ষার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম ও ফ্রান্স সরকারকে এ কারণে এখনও সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। রুয়ান্ডায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছিলো ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস অ্যাসিস্টেন্স মিশন ফর রুয়ান্ডা’। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষিত না হওয়ায় তারা কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ওই হত্যাযজ্ঞের শীর্ষ ব্যক্তিদের বিচারের জন্য তানজানিয়ার শহর আরুশায় একটি আদালত স্থাপন করে যার নাম দেয়া হয়- ‘রুয়ান্ডার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত’। লম্বা এবং ব্যয়বহুল বিচারের পর গণহত্যার জন্য এ পর্যন্ত ৯৩ জনের বিচার হয়েছে, যাদের অনেকেই ছিলেন হুতু সরকারের আমলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তাদের সবাই হুতু সম্প্রদায়ের।

রুয়ান্ডার গণহত্যা ছিলো ভয়াবহ রকমের বীভৎস। এই গণহত্যা ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায় হয়েই থাকবে।

Exit mobile version