২১ফেব্রুয়ারি স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। তার তোড়জোড়ই চলছে বেশ কদিন ধরে। নামমাত্র একটা কি দুটো ক্লাস। তারপরই বসছে গানের ক্লাস। সেটা শেষ হওয়ার পর কবিতা আবৃত্তির রিহার্সাল। সে গান কবিতার রিহার্সালেই তপন প্রথম তনুপুকে আবিষ্কার করে। তার ক্লাসটেন পড়ুয়া বড়পুর মত দেখতে একটা মেয়েযে ক্লাস সেভেনে তার ক্লাসমেট হতে পারে ,এটা তার কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার হয়ে দাড়ায়।
ও প্রথম ভেবেছিল হয়তো বড় ক্লাসের ছাত্রী হবে। কিন্তু বাংলা ক্লাসে রোল কল করার সময় যখন দেখল ঠিক তার পাশের সারিতেই বসে তনুপু তাকে দিব্বি মুখ ভেঙ্গাচ্ছে তখন তার ভুল ভাঙল।
সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে মুখ ফসকে বলেই ফেলল ,
: একি তনুপু ,তুমি বুঝি এই ক্লাসে পড় ?
তনুপু তেমনি মুখ ভেংচিয়ে বলল ,
না আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি। হাঁদারাম ফাঁকিবাজ!
তপন আর উত্তর দিবে কি ,লজ্জায় আর ওদিকে তাকাতেই পারলোনা। কেন জানি তনুপুর কথায় এতদিন স্কুল কামাই করাকে অধিকার ভেবে আসা তপনের কাছে ব্যাপারটা অপরাধ হয়ে দাঁড়াল।
লজ্জার ঘোরে কখন তার রোল কল হয়ে গেছে টেরই পেলনা বেচারা। ফলাফল ,পরদিন ক্লাসে কান ধরে একপায়ে টানা পনেরো মিনিট দাড়িয়ে থাকা।
শহরেরগুলো বলতে পারবনা কিন্তু পাড়াগাঁয়ের এ স্কুলগুলো চলে তিনরকমের ছাত্রতে।
১. ভাল ও নিয়মিত। এরা ক্লাসে যেমন নিয়মিত আবার ফলাফলও করে তেমন। তবে একটু হিংসের ধাঁচ আছে এদের। তপনদের ক্লাসের মোক্তার আর শরিফকে ফেলা যায় এ ক্যাটাগরিতে। এদের কেউ একজন কোন কারণে (সে কারণটা জ্বর কিংবা পেটব্যথা নয় । গাছে আম পাড়তে গিয়ে হাত ভাঙা , বর্ষায় স্কুলে আসার সময় পিছলে পড়া কিংবা ডায়রিয়ার কারণে কাহিল অবস্থা) স্কুলে আসতে না পারলে অন্যজনকে একদিন স্কুল কামাই করাবার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনা।
২. খারাপ ও নিয়মিত। এরা রোজ ইস্ত্রি করা জামা কাপড় পড়ে ,মাথার চুলে বেশ করে নারকেল তেল-মেখে ডানপাশে সিঁথি করে নায়ক রাজ্জাক সেজে আদর্শ ছাত্রের মত স্কুলে আসে। কিন্তু পড়ার ক্ষেত্রে ঠুনকো। দোষ এদেরকেও দেওয়া যায়না । কেননা বছরের ৯০% দিনই এদের বারান্দায় হয় কানে ধরে একপা তুলে দাড়িয়েই কেটে যায়। পড়ার সময়টাইবা পায় কোথায়!
তবে এদের পড়া মনে থাকুক আর না থাকুক , ক্লাসের কোন মেয়ে কবে সিনেমা দেখতে যায় ,কোন ছেলেটা কোন মেয়ের পেছনে ঘুরছে ,কোনস্যার ক্লাসে আড়চোখে মেয়েদের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে , কোন মেয়েটা মোবাইলে ঘণ্টা ঘণ্টা কথা বলে এসব ওদের একেবারে ঠোটস্থ। খালি একটু চান্স পেলেই হলো,গড়বড় করে সব বলে দেয়।
আর ৩নম্বরে হচ্ছে ফাঁকিবাজ স্কুল পালানোর দল। এরা সপ্তাহে দুদিন জ্বর হয়েছে ,পেটব্যথা ইত্যাদি অজুহাতে বৈধভাবে স্কুল কামাই করে । তিনদিন স্কুলে যাবার নাম করে নদীর ওপাড়ে জেলেপাড়ার ছেলেদের সাথে ডাংগুলি খেলে কাটায়। আর বাকি একদিন ৫দিন স্কুল বন্ধ করা শাস্তি সরূপ স্কুলের বারান্দায় দুপায়ের ফাঁক দিয়ে কান টেনে ধরে দলবেঁধে বসে পরবর্তী ৫দিন স্কুলে না এসে কোথায় কি করে বেড়াবে তার শিডিউল প্রস্তুত করে ফিসফিস করে।
তপন এদের মধ্যে তৃতীয় দলে। ক্লাস সিক্সে সে স্কুলে সবমিলিয়ে মাত্র ২৫দিন হাজিরা দিয়ে সেরা ফাঁকিবাজ হিসেবে নাম করেছিল বেশ।
কিন্তু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রাথমিক নির্বাচনে একাধারে গান ও কবিতা আবৃত্তিতে সিলেক্ট হয়ে তপন বেশ নিয়মিত হয়ে উঠলো।
পাড়ার ছেলেরা বলে,
: স্কুলে ক্লাস হয়না। চল তপন জেলে পাড়ায় গিয়ে একটু ক্রিকেট খেলে আসি ।
তপন গম্ভীরভাবে বলে,
: আমার রিহার্সাল আছে। স্কুলে যেতে হবেই হবে।
শুনে ওরা তো অবাক হয়ই। এক আধবার তাদের তপনকে ভূতে টুতে পেয়েছে বলেও মনে হয়।
স্কুলের অঙ্কস্যারই সঙ্গীত টিচারের দায়িত্বটা পালন করছেন। স্যারের হারমোনিয়ামের সাথে রিনরিনে গলায় তনুপু গায়,
আমার গানের মালা
আমি করব কারে দান..
তপন অবাক হয়। গানের আবার মালা কি ?
রিহার্সালের এক ফাকে তনুপুকে জিজ্ঞেসই করে ফেলে ,
: তনুপু ,গানের মালা জিনিসটা কিগো ?
তনুপু যেন ভারি অবাক হয়। চোখ দুটো বড় বড় করে বলে,
: তাও জানিসনা ? মালা দেখিসনি কোনদিন।
তপন ঢোক গিলে বলে,
: সেতো দেখেছি। কিন্তু সেটাতো ফুলের। টুনুপুকে অবশ্য পাতা দিয়ে মালা বানাতে দেখেছি। কিন্তু গান দিয়ে আবার মালা হয় কি করে?
শুনে তনুপু ভেঙচি কাটেন।
: হয়। তুই ভারি বোকা কিনা তাই বুঝিস না !
তপন আবার লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
তনুপুকে তপনের ভারি ভাল লাগে। তনুপু গায়ও ভারি চমৎকার। যেমন রিনরিনে ফিনফিনে গলা, তেমন আওয়াজ।
তপন কল্পনা করে তনুপুর গলার ভেতর গানগুলো সব জট পাকিয়ে মালা হয়ে আছে।
তপনের গলায় তেমন দম নেই। তপনের মত এই দম ফুরিয়ে যাওয়াদের স্যার দিয়েছেন জাতীয় সঙ্গীত। দলবেঁধে গাইবে সবাই। কারও দম ফুরিয়ে গেলেও সমস্যা নাই, গাইতে না পারলেও সমস্যা নাই। বাংলা ছবির নায়কদের মত স্যারের সাথে ঠোট মেলালেই চলবে।
কবিতার রিহার্সালে তনুপু বলেন,
: তুই ভারি চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করতে পারিস তপন !
তপন হাসে। লজ্জাও পায়। তারপর বলে ,
: তুমিও ভারি চমৎকার গাও তনুপু ! তোমার গান শুনলে বুকে কেমন হুহু করে কি যেন ।
তনুপুর চোখ কপালে উঠে যায় ।
: সেকিরে আবার আমার প্রেমে পড়ে যাসনা যেন!
তপন লজ্জায় লাল হয়ে বলে ,
: ধুর ! খালি ফাজলামি করো।
এ কথা কেমন করে জানি দ্বিতীয় ক্যাটাগড়ির ছাত্র সালুর কানে যায়।
: কিরে তনুপু নাকি তোকে প্রপোজ করেছে ?
তপনের মুখ শুকিয়ে কালো হয়ে যায়। একথা আবার কে ছড়ালো! স্যারের কানে গেলেতো পিটিয়ে লাট বানিয়ে দেবে।
আর তনুপু! সেইবা কি ভাববে?
ভাববে হয়তো, তপন আমার নামে বাজে কথা ছড়াচ্ছে।
তপন প্রতিবাদ করে বলে,
: যা কিসব যাতা বলিছ! তনুপু আবার কত বড় হবে জানিস?
সালু শুনে মুখ টিপে হাসে।
: ছাই ! বড় হবেনা মোটেই! মেয়ের অমনই। দুদিনেই লম্বাটে হয়ে তালগাছ হয়ে যায়। আমাদের ক্লাসের বিশুর ছোট বোনকে দেখেছিস? ক্লাস ফোরে পড়ে। বিশুর দুগুণ লম্বা।
তপন রাগে ফুলে বসে থাকে। যতসব বাজে ছেলের দল। ইচ্ছে করি ঘুসি মেরে সালুর চৌকা নাকটা থ্যাবড়া করে দেয়।
এই সালুই একদিন এক জমজমাট খবর নিয়ে এলো। সামনের মাসেই তনুপুর বিয়ে।
তপনের বিশ্বাস হয়না। বানিয়ে কথা বলায় ওস্তাদ সালু।
: তনুপুর বিয়ে তুই জানিস কি করে? তোর বাড়িতো তনুপুদের বাড়ি কাছে নয়?
তপন জেরা করে।
: তাতে কি? আমার মামার বাড়ি তনুপুদের ঘরের একেবারে কাছে।
মামা এসেছিলো কাল। ওনি বলে গেছেন।
: সেতো ওনি ভুলও বলতে পারেন।
: মোটেও না।
: কেন?
: প্রমাণ আছে আমার কাছে।
: কি প্রমাণ?
: কালকে সিঁড়ির নিচে দাড়িয়ে তনুপুকে কথা বলতে দেখেছি।
বিশু এতখন চুপ ছিল। সে বলে ,
: সেকিরে বিয়ের আগেই স্কুলে দেখা করতে চলে এলো?
এদের কথায় তপন কেমন অসহায় বোধ করে। সে পিটপিট করে সালুর দিকে তাকায়। সালু ওর সহায় হয়।
: মোবাইলে কথা বলছিলো। তনুপুর হবু বর দুবাই থাকে। বিয়ের পর শুনেছি তনুপুকেও সেখানে নিয়ে যাবে।
গানের রিহার্সাল শেষে তপন কথা তনুপুকে জিজ্ঞেসই করে বসে।
তনুপু শুনে ফিক করে হেসে উঠেন।
: এ খবর কোত্থেকে পেলি?
: সালু বলেছে।
: সে জানে কি করে?
: ওকে ওর মামা বলেছে।
শুনে তনুপু চুপ মেরে যান। তনুপুকে কেমন অন্যরকম দেখায় তখন। কেমন লাজুক মিটমিটে একটা হাসি, কি যেন ভাবছে ।
: কি বল তনুপু?
: কি?
: সত্যি নাকি কথাটা?
: না মিথ্যে ! যা পাঁজি ..কনেকে বুঝি কেউ এসব জিজ্ঞেস করে ?
: কেন করলে কি হয় ?
: লজ্জা লাগে!
: তুমি কি এখন লজ্জা পাচ্ছ?
: হউ। যা ..বোকা কোথাকার।
তনুপু তপনের কান মলে দেন। তপন আর এগোয় না। সেখানেই ঠায় দাড়িয়ে থাকে। তনুপু দ্রুত পায়ে হেটে চলে যায়।
এর পরদিন আর গানের ক্লাসে তপনকে পাওয়া যায়না।
স্যার বলেন, ফাঁকিবাজটা এখানেও ফাঁকি দিয়েছে। হাবলু দেতো ওর নামটা লিস্ট থেকে কেটে!
কিন্তু তনুপু যখন রিনরিনে গলায়,
আমার গানের মালা .. গানটা ধরেছে তখন যদি কেউ বাঁপাশের জানালাটার নিচ দিয়ে তাকাতও তাহলে এক জোড়া চোখ দেখতে পেতো। সে চোখে একরাশ অভিমান জল হয়ে পড়ছে!