Site icon খিচুড়ি

সুচিত্রা সেনঃ বাংলা চলচ্চিত্রের এক নক্ষত্রের গল্প

১৯৫২ সালে প্রথম সিনেমা ‘শেষ কোথায়’ দিয়ে শুরু করেছিলেন রমা। কিন্তু অর্থাভাবে কয়েকদিন পর সিনেমাটির শ্যুটিং আর হয় নি। তারপর পরিচালক সুকুমার দাসগুপ্ত-র সিনেমা ‘সাত নম্বর কয়েদী’ থেকে নিয়মিত হলেন রমা সেন। কিন্তু তখন আর তিনি রমা নয়; সুকুমার দাসগুপ্তের সহকারী পরিচালক নীতিশ তাঁর নাম দেন সুচিত্রা সেন। সিনেমার রূপালি পর্দায় রমা’র নবজন্ম হলো সুচিত্রা সেন হয়ে। আজ সেই কিংবদন্তী নায়িকা সুচিত্রা সেনের ৮৮তম জন্মদিন।

অবিভক্ত ভারতের বাংলাদেশের পাবনা জেলাতে ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রমা দাশগুপ্ত। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আর মা ইন্দিরা দেবী ছিলেন গৃহবধূ। তিনি ছিলেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা। পাবনা শহরেই ছিল তার শিক্ষাজীবন। এছাড়াও তাঁর আরো একটি পরিচয় হচ্ছে তিনি কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনী।

সতেরো বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় রমার। ১৯৪৭ সালে বর্ধিষ্ণু এক শিল্পপতি পরিবারের সন্তান দিবানাথ সেনকে বিয়ের সূত্রে কলকাতায় আসেন পাবনার রমা। বিয়ের পর তিনি একা হয়ে পড়েন নতুন পরিবেশে এবং এই একাকীত্বই একসময় তার অভিনয় জগতে প্রবেশের ইন্ধন হিসেবে কাজ করে। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা সুচিত্রাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিতে চায় তাদের নাটকে। ‘নটীর পূজা’ নাটকে প্রথম অভিনয় করলেন এবং সেই খ্যাতি পৌঁছালো টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায়। স্বামী দিবানাথের মামা বিমল রায় ছিলেন সেকালের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা। বিমল রায় তাঁকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তাঁর শ্বশুরকুলের অন্যান্য সবাইকে প্রস্তাব দেন। এরপর স্বামী ও শ্বশুরের উৎসাহেই সিনেমায় নামলেন রমা সেন।

১৯৫৪ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র জগতে সুচিত্রা সেনের জয়যাত্রা শুরু। এই সিনেমায় তাঁর বিপরীতে ছিলেন উত্তম কুমার। সিনেমাটি বক্স অফিস হিট করে আলোচনায় চলে আসেন সুচিত্রা সেন। এরপর একে একে হিট সিনেমা উপহার দেন উত্তম-সুচিত্রা জুটি। বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে এখনো শ্রেষ্ঠ জুটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একসময় কলকাতার চলচ্চিত্র পাড়ায় উত্তম-সুচিত্রা জুটি ছাড়া সে সময় কোনো সিনেমা ‘হিট’ হবে, এটা নির্মাতারা ভাবতেও পারতেন না। তাঁর অভিনীত বাংলা সিনেমার সংখ্যা ৬১ টি। এছাড়া ৭টি হিন্দি সিনেমাতে তিনি অভিনয় করেছেন। উত্তম কুমার ছাড়াও সুচিত্রা- বিকাশ রায়, বসন্ত চৌধুরী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশোক কুমার এবং হিন্দিতে দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্র ও সঞ্জীব কুমারের সাথে অভিনয় করেছেন। সুচিত্রাই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পান। ১৯৬৩ তে প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসাবে ‘সপ্তপদী’র জন্য পান মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকেও সুচিত্রা সেন অভিনীত ছবি মুক্তি পেয়েছে। স্বামী মারা যাওয়ার পরও তিনি অভিনয় চালিয়ে গেছেন, যেমন হিন্দি সিনেমা আন্ধি। এই চলচ্চিত্রে তিনি একজন নেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। বলা হয় যে চরিত্রটির প্রেরণা এসেছে ইন্দিরা গান্ধী থেকে। 

 

সুচিত্রা সেন অভিনীত শেষ ছবি ‘প্রণয় পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। ওই বছরই তিনি সুদীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয়ের পর চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে চিরতরে অবসরগ্রহণ করেন। বলা হয়ে থাকে, উত্তমকুমারের মৃত্যুর পরই প্রিয় মানুষটিকে হারানোর অভিমানে চলচ্চিত্র ত্যাগ করেন তিনি। এরপর তিনি লোকচক্ষু থেকে আত্মগোপন করেন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হন। তারপর থেকে তিনি মিডিয়ার সঙ্গে আর কথা বললেন না। একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে লাগলেন। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রয়াত হয়েছিলেন এই কিংবদন্তী নায়িকা।

সুচিত্রা সেন শুধু একটা নাম নয়। নামটি নারী বাঙালি হৃদয়ে একটা মিথ হয়ে গেছে। সুচিত্রা সেন বদলে দিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রে নায়িকার সংজ্ঞা। বাঙালিদের কাছে নায়িকা শব্দটির সমার্থক তিনি। প্রেম, হাসি, কান্না, স্ত্রী-সংসার, বাঙ্গালিয়ানা, মাতৃত্ব, মমতা আর আবেদনের প্রাণবন্ত নাম সুচিত্রা সেন। তার রূপ-অভিনয়ের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে আছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। বাঁকা ঠোঁটের হাসিতে তিনি হাজার হাজার তরুণের হৃৎস্পন্দন বাড়িয়েছেন, যেকোনো পুরুষকে প্রেমে পড়াতে বাধ্য করেছিলেন। তাঁর চালচলন, পোশাক ও সাজসজ্জা হয়ে উঠেছিলো বাঙালি নারীর ফ্যাশন। তিনি এক চিরসবুজ প্রেয়সী। যার বয়স এখনো যেনো সেই রূপালী পর্দাতেই স্থির হয়ে আছে। 

আজ এই কিংবদন্তী নায়িকার জন্মদিনে তাঁর জন্য খিচুড়ির পক্ষ থেকে আকুণ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলী।

Exit mobile version