আকাশের বুকে মুক্ত স্বাধীন পাখিদের উড়া দেখে বোধহয় মানুষের মনে খানিকটা ঈর্ষা-ই জমা হয়েছিল। তাই বহু বছর আগে থেকেই মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে পাখির মতো উড়ার। এই স্বপ্ন কিন্তু শুধু স্বপ্নতেই থেমে থাকেনি। বাস্তবায়নের চেষ্টা চলতে থাকে যুগ যুগ ধরে। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরোতে থাকে, বার বার ব্যর্থ হতে থাকে অজস্র মানুষের হাজার রকম চেষ্টা। উড়তে গিয়ে প্রান বিসর্জনও দেয় অনেকে। এর নিরন্তর নিরাশার মধ্যে সর্বপ্রথম আলো দিশা দেখতে পান একজন। তার নাম Otto Lilienthal। মানব জাতির ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি গ্ল্যাডারে চড়ে আকাশে উড্ডয়নের চেষ্টায় সফল হয়েছিলেন।
সময় ১৮৯১ সালের শুরু। লিলেন্থেল আকাশে উড়ার জন্য ইতোমধ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে দিয়েছেন। তার এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে ১৮৯৬ সাল অবদি। ইতোমধ্যে তিনি বেশ কয়েকবার নিজের গ্ল্যাডারের ডিজাইনে পরিবর্তন করে ফেলেছেন। এবং সেসব পরীক্ষা নিরীক্ষার সময় তিনি কম করে হলেও প্রায় ২০০০ বার গ্লাডারে চেপে উড়ার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে কোনবার তিনি আংশিক আবার কোনবার পুরোপুরিভাবেই ব্যর্থ হোন।
এই সময় তিনি পাখির উড়া এবং পাখার ব্যবহার নিয়ে প্রচুর গবেষনা করতে থাকেন। সেসব গবেষনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে গ্ল্যাডারের ডিজাইনে আনতে থাকেন পরিবর্তন। অবশ্য শুধু পাখির উড়াউড়িই নয়, তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপরও বেশ পাণ্ডিত্য লাভ করেল যা তাকে তার জ্ঞান এবং যন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় আনতে বেশ সাহায্য করে।
লিলেন্থেল ১৮৭০ সালে বার্লিনের রয়্যাল টেকনিক্যাল একাডেমী থেকে গ্রেজুয়েশন শেষ করে, কিছুদিন একটা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে চাকরি করেন। এরপর তিনি কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে C.Hoppe Machne Factory তে যোগ দেন এবং ১৮৭৩ সালে তিনি গ্রেইট ব্রিটেনের Aeronautical Socity এর সদস্যপদ লাভ করেন। সেখানেই তিনি পাখির উড্ডয়ন কৌশল নিয়ে প্রথম লেকচার প্রদান করেন। ১৮৮৩ সালের দিকে তিনি একটি ইঞ্জিন তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। যেখানে তিনি মূলত বয়লার এবং স্টিম ইঞ্জিন প্রস্তুত করতেন। এই সময় তিনি এই ইঞ্জিনগুলোর ডিজাইনেও বেশ অবদান রাখেন।
গ্ল্যাডারে চড়ে আকাশে উড়ার ভূতটা মূলত তার মাথায় চেপেছিল এর আগে থেকেই। ১৮৬৭ সালের দিকে। সেই সময় তিনি কয়েকটি মডেল তৈরি করে সেগুলো নিয়ে উড্ডয়ন প্রচেষ্টা চালান এবং ফলাফল একটি সায়েন্স জার্নালে রিসার্চ পেপার হিসেবে প্রকাশ করেন।
রিসার্চ পেপার প্রকাশের ঠিক একবছর পর তিনি প্রথম মানুষসহ উড্ডয়ন উপযোগী গ্ল্যাডার তৈরির প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করেন। তার প্রথম সফল প্রচেষ্টায় তিনি গ্ল্যাডারে চড়ে প্রায় ২৫ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। এই সাফল্য তাকে আরো বেশি করে উৎসাহী করে তোলে।
১৮৯৩ সালে তিনি গ্ল্যাডারের ডিজাইনে আর বেশকিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন এবং সেটাতে চড়ে তিনি প্রায় ২৫০ মিটার পথ অতিক্রম করতে সফল হোন। তার মৃত্যু অবদি আর কেও এই রেকর্ড ভাঙতে পারেনি।
পরীক্ষার নিরিক্ষার শুরুর দিকে তিনি মূলত ছোটখাটো উপত্যকা এবং পাহাড় ব্যবহার করতেন গ্ল্যাডারে চড়ে লাফ দেয়ার জন্য। পরবর্তীতে তিনি প্রায় ১৫ মিটার উঁচু একটি ফ্লাইট স্টেশন নির্মাণ করেন। এই ফ্লাইট স্টেশন থেকেই তিনি অনেকগুলো সফল নিরীক্ষা চালান।
এই ক্রমাগত সাফল্যই মনে হয় তাকে ক্রমশ আরো বেশি আত্নবিশ্বাসী করে তুলেছিল। ১৮৯৬, দিনটা ছিল রবিবার। লিলেন্থেল সিদ্ধান্ত নিলেন একটি পাহাড়ের উপর থেকে গ্ল্যাডারে চড়ে নিচে নামবেন।
ঝাঁপিয়ে পড়ার কিছুখন পর প্রায় ১৫ মিটার উপর থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হলেও, এর পরেরদিনই মারা যান তিনি।
লিলেন্থেল যে শুধু নিজেই উড়ার চেষ্টায় সফল হয়েছিলেন তানয়, তিনি আগ্রহ জুগিয়েছিলেন পরবর্তী আর এক গাদা ইঞ্জিনিয়ারকে। তিনিই মানুষকে বুঝতে শিখিয়েছিলেন মানুষের উড়ার স্বপ্ন, শুধুই স্বপ্ন নয়। এঁকে বাস্তবেও পরিনত করা সম্ভব।
যে রাইট ব্রাদারকে আধুনিক উড়োজাহাজের স্থপতি ধরা হয়, তাদের গবেষনায়ও লিলেন্থেল এর প্রকাশিত রিসার্চপেপারগুলো প্রচুর সাহায্য জুগিয়েছিল।
জার্মানির উড়ন্ত মানব
Loading books...