পৃথিবীর জন্য ভালবাসা

সবুজ- শ্যামল পরিবেশে বড় হয়েছি আমি।
চারিদিকে ছিল চেনা অচেনা গাছ পালা।পোকা মাকড়। লতা -গুল্ম।বুক ভরে নিয়েছি তাজা নির্মল বাতাস।
বাড়ির সামনে ছিল বড় খোলা মাঠ। সবুজ লম্বা দীঘল ঘাসে ভর্তি। হাতির শূর , টাকা পাতা আর বাসক পাতার দঙ্গল। বড় বড় নিম গাছ ছিল দুটো। ওদের চিকড়ি মিকড়ি পাতা দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। গাছের নীচে নিম ফল ঝরে থাকত কত।
সারা দিন একগাদা কাক সেই নিম ফল খাওয়ার লোভে ঝগড়া করত। নদী ছিল কাছেই। রাত গভীর হলে নদী থেকে হুড় মুড় করে দৌড়ে আসতো ভেজা বাতাস। বাড়ি ঘর ঠাণ্ডা হয়ে যেত। গভীর রাতে ইস্টিমারের সিটি শুনতে পেতাম ঘুমের অতলে থেকেও।

আমাদের বাড়ির পিছনে ছিল একটা জংলা মত বাড়ি। এক গাদা আম গাছ বাড়িটা পাহারা দিত। এক মৌসুমে আম গাছের পাতাগুলো তামার মত লাল হয়ে যেত। তারপর হলুদ মঞ্জরীতে ভরে যেত। মিষ্টি একটা ঘ্রানে পাগল হবার দশা হত আমাদের।
কিছু সাই বাবলা গাছ দেখতাম। হলুদ গোল বলের মত ফুল ফুটত। ঝিরিঝিরি পাতা ওদের। কি একটা গাছ ছিল যেন। ফুল থেকে পাকা কাঁঠালের ঘ্রান ভেসে আসতো। বড় রাস্তার মোড়ে ছিল একটা কৃষ্ণচুড়া গাছ। ফাল্গুন মাসে লাল ফুলে ভরে যেত পুরো গাছটা।
রাস্তাটা ছিল কালো পিচের। লাল কৃষ্ণচুড়া ফুলের স্তূপ পরে থাকতো কালো পথের উপর। অপূর্ব এক দৃশ্য।
আমরা প্রকৃতিকে ভালবাসতাম। প্রকৃতিও আমাদের তার সন্তানের মত ভালবাসত।

কত জাতের দূর্বা ঘাস দেখেছি তার কোন হদিস নেই। আকন্দ, জারুল, নিশিন্দা, স্বর্ণলতা। প্যাপেরোমিয়া নামে দারুন একটা পিচ্চি গাছ পেতাম। আমরা রান্না বান্না খেলার সময় ঐ গাছের পাতা লুচি হিসাবে ধরতাম। দল কলস নামে ঝাড়ে সাদা ফুল ধরত।
ফুলে কালো কালো পিঁপড়ে থাকতো। কারন ফুলটা ভর্তি ছিল মিষ্টি একটা রস।

থানকুনি পাতা হয়ে থাকতো গিজিমিজি করে। শার্পনার দিয়ে কাঠ পেনসিল
কাটলে যেমন কাঠের কুঁচি খসে পরে, থানকুনি পাতা ঠিক তেমন মনে হত আমার কাছে।
বিচিত্র সব ঢেঁকি শাক হয়ে থাকত বাড়ির আশে পাশে। জোনাকি ফুল নামে দারুন একটা ফুল দেখতাম ফলসের মাঠে। ছোট্ট গুল্ম জাতীয় গাছ। পিচ্চি একটা ফুল হয়। পাঁচ পাপড়িওয়ালা। মাঝে হলুদ কেশর। কত দূর থেকে চোখে পড়ে।
বড় বাজার থেকে ফেরার পথে বিশাল এক কদম গাছ দেখতাম। হলুদ গোল্লা গোল্লা ফুল হয়। বাদলার দিনে মাতাল করা এক ঘ্রান ছড়ায়। কৃষ্ণ না কি কদম গাছের তলায় বসে থাকতো।

বিকেল বেলা হাঁটতে বেরুতাম।
নির্জন পথ চলে গেছে দূর শহরের দিকে। পথের দুই পাশে কত গুলো কড়ই গাছ। ওদের শুকনো পাতা হলুদ হয়ে ঝিরি ঝিরি হয়ে খসে খসে পড়তো।
মনে হয় মুঠো মুঠো সোনার মোহর ছুড়ে দিচ্ছে খাম খেয়ালি কোন রাজা। প্রকৃতি প্রেমিক বলতে যা বুঝায় তা হয়তো ছিলাম না। কিন্তু চারিদিকের পরিবেশ, গাছ পালা , পাখী, ঘাস ফড়িং বা প্রজাপতির উপর ভালবাসা অনুভব করতাম।
বন কলমির হালকা বেগুনী ফুল দেখে মুগ্ধ হতাম। দিঘীর পাশে ভেজা জলজ ঘাসের দঙ্গল । থালার মত বড় পদ্মপাতা ভেসে থাকত। তার নীচে পরিবার নিয়ে থাকত মাছেরা।

বিকেলের কমলা রঙের রোদে ভিজে বাড়ি ফিরত টিয়ে পাখীর ঝাঁক। বাউ কুড়ানি বাতাসে ভেসে যেত ঘাসের দানা। লাল টকটকে ফুল দিয়ে ভর্তি হয়ে যেত পথের ধারের শিমুল গাছটা। চারি দিকে ছিল রঙ আর রঙ। বর্ষার বৃষ্টিতে সারা বছর ঘুমিয়ে থাকা বীজ গুলো জেগে উঠত। সবুজ কচি
চারা গজাত। নতুন ঘাস হত। জিওল মাছের পোনা গিজ গিজ করত দীঘি জলে। মাঠের ঘাস আর কচুর দঙ্গল বড় হয়ে যেত।
মানুষ নিজের হাতে প্রকৃতি ধ্বংস করত না। জংলা গাছ পালা নষ্ট করলেও রাগ করতো বুড়ো আর মুরুব্বিরা।

পরিবর্তন কখন, কি ভাবে হয়েছে জানি না।
তবে হয়েছে। প্রকৃতি নষ্ট হয় মানুষের দোষে। আর কোন প্রাণী প্রকৃতির এত বিপুল ক্ষতি করতে পারে না।
আজও মায়াবী শীতের বিকেলে হাঁটতে বের হই। বুনো তুলসির ঝাঁঝাল ঘ্রান পাই না শেষ বিকেলের হাওয়ায়।
পথের ধারে হলুদ শিয়াল কাঁটার ফুল দেখি না। পদ্ম দীঘির কালো জলে স্ট্রিঙ রে মাছের মত শাপলার পাতা দেখি না।
আমাদের প্রকৃতি কত নষ্ট হয়ে গেছে। কল কারখানার ধোঁয়ার জন্য বিষাক্ত সীসে ভেসে বেড়ায় আকাশে বাতাসে। পরিবেশ এতটাই নষ্ট হয়ে গেছে যে চির চেনা গাছ পালা লতা গুল্ম হাজার খুজেও পাওয়া যায় না।

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী গ্রাব্রিয়েল মার্কোস বলেছিলেন- ‘শুধু একটা পাখীর ডানা মেলার জন্য এই পৃথিবীকে লক্ষ লক্ষ বছর অপেক্ষা
করতে হয়েছিল।আজ প্রতি বছর পৃথিবীতে ১০০ মিলিয়নের বেশি প্রাণী পরিবেশ দূষণের জন্য মারা যায়।’
১০০ কোটির মত মানুষ আজ পরিষ্কার নিরাপদ পানি পান করতে পারে না। প্রতি দিন ৫ হাজার মানুষ মারা যায় অপরিচ্ছন্ন পানি পান করে।
প্রতি বছর ১৪ বিলিয়ন পাউনড ময়লা আবর্জনা সমুদ্রে ফেলা হয়। বেশির ভাগই প্ল্যাস্টিক। সমুদ্রে ময়লা ফেলার কারনে প্রতি বছর ১০ লক্ষ সামুদ্রিক পাখী আর ১০০ মিলিয়ন সামুদ্রিক প্রাণী মারা যায়।

৩ মিলিয়নের বেশি শিশু মারা যায় প্রতি বছর পরিবেশ দূষণের জন্য। ভারতের ৮০% কারখানার বজ্য ওরা গঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়।
এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ৫০০ মিলিয়ন গাড়ি আছে। আগামীতে সংখ্যাটা বাড়বে। মানে আরও বেশি যানজট। আর পরিবেশ দূষণ।
কৃষকেরা মাঠে যত কীট নাশক ছড়ায় তার চেয়ে ১০ গুন বেশি বিষাক্ত জিনিস আমরা বাড়িতে ব্যবহার করি। মশা মারার ওষুধ হতে হরেক পদের ক্যামিকেল। একটা ছোট গাড়ি হাফ টন কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়ে বছরে। আর নাসার একটা স্পেস শাটল ২৮ টন কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়ে।

শুধু আমেরিকানরা ২৯ মিলিয়নের বেশি প্ল্যাস্টিকের পানির বোতল কেনে। তার মধ্যে মাত্র ১৩% বোতল রিসাইকেল করা হয়।
জাহাজে করে যখন ১ মিলিয়ন টন তেল অন্য কোথাও নেয়া হয় তখন গড়ে ১ টন তেল সমুদ্রে পড়ে যায়। আমেরিকানরা বছরে পৃথিবীর মাত্র ৫% জন সংখ্যা বাড়ায়, কিন্তু সারা দুনিয়ার ৩০% ময়লা আর বজ্য ওরাই বানায়। আর দুনিয়ার ২৫% সম্পদ ব্যবহার করে।
প্রতি ৮ সেকেন্ডে একটা শিশু মারা যাচ্ছে দূষিত পানি পান করার জন্য। পানি অপচয় করার আগে ভাবো সেটা ?

২০১২ সালে আমরা ৪৯ মিলিয়ন টন ইলেকট্রনিকস বজ্য বানিয়েছি। নষ্ট টিভি, ফোন, বাতিল কি বোর্ড, মাউস হেন তেন।
শুধু মাত্র আমেরিকায় প্রতি ঘণ্টায় আড়াই মিলিয়ন টন প্ল্যাসটিকের বোতল ফেলা হয়। একটা বোতল মাটির সাথে মিশে যেতে সময় নেবে ৫০০ বছর। বা তারচেয়ে অনেক বেশি। শুধু কল কারখানা ই যে পরিবেশ দূষণ করে এমনটা না কিন্তু। ঘরের কাজেও ময়লা আর বজ্য উৎপাদন হয়।
২০১০ সালে আমেরিকায় ২৫০ মিলিয়ন টন বজ্য তৈরি হয়েছিল। সবই ঘর গেরস্থালির বাতিল জিনিস। খাবারের প্যাকেট, পানীয়ের বোতল,
বাতিল আসবাব পত্র, পুরানো জামা জুতা, ব্যাটারি, খবরের কাগজ আর নানা রকম টিনের কৌটা।
হিসাহে দেখা যায় একটা মানুষ রোজ প্রায় ১.৯৫ কেজি বজ্য তৈরি করে। এবং দিনের শেষ সেই বজ্য গিয়ে পড়ে ডাম্পিঙে অথবা সমুদ্রে।
অনেক বিজ্ঞানীর মতে দূষণ যেই ভাবেই শুরু হোক সবচেয়ে বেশি দূষণ হয়েছে এবং হচ্ছে সমুদ্র।
সমস্যা এত বেশি হবার কথা না। কারন ৮০% জিনিস চাইলেই আমরা পুনরায় ব্যবহার করতে পারি। যেটাকে রিসাইকেল ( recycle )বলে।
বজ্যের মধ্যে একটা বড় সমস্যা হল প্ল্যাস্টিক। একজন আমেরিকান গড়ে বছরে ১৮৫ পাউনড প্ল্যাস্টিক ব্যবহার করে।
৫০% প্ল্যাস্টিকের জিনিস আমরা মাত্র একবারের জন্য ব্যবহার করি। তারপর ফেলে দেই।
সেটা ফেলিও বেশ অবহেলা করেই।যেখানে সেখানে ফেলি। সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো প্ল্যাস্টিক ব্যাগ জেলি ফিস মনে করে খেয়ে ফেলে
কচ্ছপ, ডলফিন আর বড় মাছেরা। ফলাফল মৃত্যু। পরিবেশ দূষণ নিজের চোখে দেখেছি। আমার শৈশবেই।

কোত্থেকে এক ধনী মানুষ এসে আমাদের বাড়ির কাছেই এক কারখানা বসিয়ে দিল।
দিন নেই রাত নেই ঝপ ঝপাং করে কাপড় ছাপা হচ্ছে। কারখানার রঙিন নোংরা জল ড্রেন ভর্তি হয়ে কুল কুল করে্ গিয়ে পড়ছে কারখানার পিছনের জলাভূমিতে। যেটাকে আদর করে সবাই বলতো পদ্মদীঘি। পদ্মদীঘি ছিল জলে টলমল। হেলেঞ্চার দঙ্গল ভর্তি। কত মাছের বাসা। জলাভূমির মাঝে ঝিলিক দিয়ে উঠত বিঘত খানেক লম্বা সরপুঁটি। সারা বছর জলে ভেজা মিষ্টি হাওয়া বইত। মাত্র এক সপ্তাহ পরেই মরে ভেসে উঠতে লাগল দুঃখী মাছেরা। ওদের সারা শরীর ভর্তি ফোঁটা ফোঁটা ঘা।
সেই মরা মাছ খেয়ে মরল কয়েক ঝাঁক মাছ রাঙ্গা। মরে স্তূপ হয়ে গেল রাজ্যের যত গুগলি আর শামুক।
জলাভূমির সব জলজ ঘাস লতা গুল্ম মরল একে একে। অদ্ভুত কালচে রঙে মোটা সর পড়লো লজাভুমির উপরে।

রুগ্ন জলাভূমিটা ধীরে ধীরে মরে গেল চোখের সামনে,পাশে ছিল মস্ত বড় দুই ডুমুর গাছ। ঝাকে ঝাঁকে লাল ডুমুর পেকে থাকত।পাকা ডুমুর খাওয়ার লোভে রাজ্যের যত পাখী এসে জুটত সেই গাছের ডালা পালায়। সেই ডুমুর গাছ দুটোও মরে গেল বীণা আপত্তিতে। ভরাট জলাভূমিতে টঙের দোকান হল। চায়ের দোকান। আসমা টেইলারস।মোতালেব ব্যাটারি। দিন রাত গান বাজে রেডিওতে আর এক গাদা মানুষের আড্ডা চলে। চোখের সামনে প্রকৃতিকে কষ্ট পেয়ে মরতে দেখেছি। ছোট খাট অনেক কারনেই প্রকৃতির চক্র বদলে যায়।
বিজ্ঞানীদের জরিপে দেখা গেছে সারা পৃথিবীতেই সামুদ্রিক কচ্ছপ বিলুপ্ত হয়ে আসছে ।ওরা এখন চরম বিলুপ্তির পথে।
কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল বিশেষজ্ঞের দল। পরিবেশ দূষণ বা আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের কচ্ছপ
বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ঠিক। তার চেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে আমরা ওদের বাসভুমি আর ডিম পাড়ার পরিবেশ নষ্ট করছি। ট্যুরিজম হচ্ছে একটা কারন এই কচ্ছপ বিলুপ্ত হবার পিছনে। গত বিশ বছরে সমুদ্রের সৈকতে বার, রেস্টুরেন্ট, হোটেল আর টুরিস্ট লজ বানানোর একটা হুজুগ হয়েছে।
এই সব জায়গা গুলোতে সারা বছরই টুরিস্ট যায়। গভীর রাত পযন্ত হৈ চৈ করে। প্রচুর শব্দ আর আলোর মধ্যে চিল্লা ফাল্লা করে বিনোদনের আয়োজন করে আমোদ প্রিয় মানুষ। এই জন্য ভয়ে সৈকতে উঠে ডিম পাড়ার সাহস হারিয়ে ফেলে কচ্ছপেরা।

প্রচণ্ড শব্দ আর আলোর জন্য ডিম পাড়ার প্যাটান নষ্ট হয়ে যায়। কত ভাবে প্রাণী আর পশুর প্রাণ নষ্ট করি আমরা।
ভাল ফসলের লোভে খেতে গাদা গাদা কীট নাশক দেই। সেই কীট নাশকের বিষ বৃষ্টির জলে ভিজে সোজা গিয়ে পড়ে খেতের পাশের জলাভূমিতে। মরে ওখানের ব্যাঙ আর মাছ। খাবারের অভাবে মরে এক গাদা পাখী। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, জলাভূমির বিষাক্ত শামুক আর গুগলি খাওয়ার জন্য পাখীদের ডিমের খোসা পাতলা হয়ে যাচ্ছে। ফলে বাচ্চা বের হবার আগেই সেই ডিম ভেঙ্গে অনেক পাখী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
প্ল্যাস্টিকের কথায় ফিরে আসি। এই মুহূর্তে আমেরিকার ১০০ টা শহরে প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করা হয়েছে আইন করে। প্ল্যাস্টিকের বদলে বাদামী রঙের কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে সিডনী শহরে দেখেছি সবুজ রঙের উন্নত মানের পাট জাতীয় আঁশের ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে।
একজন আমেরিকান গড়ে বছরে ৩০০ টা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করে। আর এই ব্যবহারের সময় সীমা মাত্র গড়ে মাত্র ১২ মিনিট। তারপর সেই ব্যাগ চলে যায় ডাম্পিঙে। পরিবেশের সাথে মিশে মাটির সাথে এক হতে সময় লাগে ৫০০ থেকে ১০০০ বছর।
৮৫% সামুদ্রিক কচ্ছপ মারা যায় সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ খেয়ে। আপাতত মনে হতে পারে দুনিয়াতে জলের কোন অভাব নেই।
সারা দুনিয়ার ৭০% ভাগই জল । জল আর জল। কিন্তু মনে রাখা দরকার মাত্র ২.৫% জল পান করা যাবে। বাকি সবই রয়েছে সমুদ্রে।
নোনা। বাকি টুকু উত্তর মেরুতে। বরফ হয়ে জমে আছে। সারা দুনিয়ার কল কারখানার ৭০% ময়লা আবর্জনা ফেলা হয় সমুদ্রে।
এই মুহূর্তে খোদ আমেরিকার ৪০% নদী আর ৪৬% জলাভূমি নিরাপদ না। সেখানে মাছ ধরা বা সাঁতার কাঁটা নিষেধ। বিষাক্ত হয়ে গেছে।
গাছপালা বনভূমি খুবই দরকার। সবাই জানি। এই মুহূর্তে পৃথিবীর ৩০% জুড়ে আছে বনভূমি। তবে হিসাবে ১০০ বছর পর
দুনিয়ায় কোন বন থাকবে না যদি আমরা সচেতন না হই।

বেশির ভাগ বন জঙ্গল কাঁটা হয় চাষ বাসের জন্য বা বসত বাড়ি বানানোর জন্য। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে প্রতি সেকেন্ডে দেড় একর বনভূমি কাঁটা হচ্ছে। কল্পনা কর, প্রতি মিনিটে প্রায় ২০ টা ফুটবল খেলার মাঠের মত জায়গা মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বাস করবে কিনা জানি না , শুধু মাত্র আমাজনের সেই বিখ্যাত বনভূমি পৃথিবীর জন্য ২০% অক্সিজেন তৈরি করে।
সাউথ আমেরিকা ,আফ্রিকা আর পূর্ব এশিয়ায় প্রতি বছর ১৩ মিলিয়ন হেকটর বনভূমি কেটে চাষের জন্য জমি বানায়।
প্রতি ঘণ্টায় ৪৫০০ একর বনভূমি নষ্ট আগুনে পুড়ে, বা বুল ডোজারের নীচে বা কাঠুরেদের হাতে।
টনে টনে গাছ লাগে কাগজ বানানোর জন্য। আর সেই কাগজের ৭০% জাপান, আমেরিকা আর ইউরোপের লোকজন একাই ব্যবহার করে।
কত ভাবে জলের অপচয় করি আমরা ,ভাবলে অবাক হতে হয়।
টয়লেটে একবার ফ্ল্যাস করলে ৮ লিটার পানি নষ্ট হয়।

সারা দুনিয়ায় যত ইশকুল কলেজ আছে তার অর্ধেক ইশকুল কলেজে ছাত্র ছাত্রীদের জন্য জল পান করার কোন ব্যবস্থা নেই। বুক ভরা তেষ্টা নিয়ে ক্লাস করে ওরা। নেই টয়লেটের ব্যবস্থা। ৭০% জল চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা হয়। আর ২২% কল কারখানায় লাগে।
আফ্রিকায় আর এশিয়ার দেশগুলোতে মা আর বাচ্চারা গড়ে ৩.৭ মাইল হেঁটে গিয়ে রান্না আর খাওয়ার জন্য জল সংগ্রহ করে বাড়ি ফেরে।
১ কেজি চাল উৎপাদন করতে ৫০০০ লিটার জলের দরকার হয়। বছরে ১.৮ মিলিয়ন বাচ্চা মারা যায় অপরিচ্ছন্ন জল পান করে ডাইরিয়ায় ভুগে।
ঠিক এই মুহূর্তে সারা দুনিয়ায় যত হাসপাতাল আছে তার অর্ধেক রোগী দূষিত বা অপরিছন্ন জল থেকে অসুস্থ হয়েছে।
বছরে ৮০ বিলিয়ন ডলারের পানীয় জলের বোতল বিক্রি হয় সারা দুনিয়ায়। আরেকটি ভয়াল দিক হচ্ছে সমুদ্রে জাহাজের তেল ফেলা হচ্ছে অকাতরে।
তেলের স্তর ভাসছে মাইলের পর মাইল জুড়ে । মারা যাচ্ছে ডলফিন, তিমি আর কচ্ছপ। সামুদ্রিক পাখীর ডানায় লেগে যাচ্ছে সেই তেল। ফলে আর উড়তে পারছে না পাখিগুলো। পঙ্গু হয়ে খাবারের অভাবে মারা যাচ্ছে ওরা।
বিপদ সব দিকেই ।

কল কারখানার ধোঁয়া আর বনভূমি কেটে ফেলার জন্য পৃথিবীর তাপ মাত্রা বেড়ে
যাচ্ছে। এর ফলে মেরুর বরফ গলছে। মেরুতে জমা এই বরফের স্তূপকে আইস ক্যাপ বলে। বরফের টুপি।
৭০০০ ফিট মোটা উত্তর মেরুর এই বরফের স্তর। সব বরফ গলে গেলে পৃথিবীর সব সমুদ্রের উচ্চতা ২০০ ফিট বেড়ে যাবে।
ইতিমধ্যে গত ১০০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা ৮ ইঞ্চি বেড়ে গেছে। ফলে কিছু দেশে প্রায় প্রতি বছর বন্যা হয়। মেরুর বরফের স্তর গলছে দ্রুত।
যেই ভাবে গলছে আগামী ২০৪০ সালে উত্তর মেরুতে কোন বরফ থাকবে না। ফলাফল কি হবে অনুমান করতে পারো ?
পুরো পৃথিবীর অর্ধেক ডুবে যাবে সমুদ্রের তলায়। কত কোটি মানুষ মারা যাবে? কত কোটি মানুষ তাদের দেশ হারাবে ?
কল্পনা করতে পারো কি ভয়াল দশা হবে দুনিয়ার ? আমি কল্পনা করতে পারি না।
একটাই পৃথিবী আমাদের। এটাই আমাদের প্রিয় বাসভুমি। এই মহাজগতে পৃথিবীর মত সুন্দর মনোরম গ্রহ আর একটাও নেই।
ঠিক আমাদের মায়ের মত। সেই জন্যই হয়তো প্রাচীন অনেক ধর্মে পৃথিবীকে মা বলেছে ওরা। বিজ্ঞানীরা সবাই মিলে কাজ করছে বিষাক্ত পৃথিবীর অসুথ ভাল করে তোলার জন্য। একটা দিন নিধারন করেছেন পৃথিবীর জন্য। নাম- আর্থ ডে।

প্রতি বছর এপ্রিলের ২২ তারিখ এই আর্থ ডে পালন করা হয়। নিজেরা যদি একটু যত্ন নেই ঠিক হয়ে যাবে এই পরিবেশের ভারসাম্য ।
যদিও এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে হাজার হাজার প্রাণী , উদ্ভিদ আর কীট পতঙ্গ। প্রতি ঘণ্টায় তিনটি প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে যা বছর শেষে ত্রিশ হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। এক দল বিজ্ঞানী আছে যারা পৃথিবীকে ভালবাসেন। তারাই কাজ শুরু করেছেন। পৃথিবীর যত্ন নিতে হবে। উপায় নেই।
ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ নিলে ধীরে ধীরে বড় রকমের পরিবর্তন আসবে। যদি আমরা সবাই চেষ্টা করি। হবেই।
কিছু জিনিস নিজেই করতে পার তোমরা।
১। যে কোন লেখা প্রিন্ট করার আগে আরেক বার বানান ভুল চেক করবে। কারন ,বেশির ভাগ সময় প্রিন্ট করার পর বানান ভুল দেখে মানুষজন হায় হায় করে উঠে। আবার নতুন করে প্রিন্ট করতে হয়। কাগজ, কালি , বিদ্যুৎ বিল সব কিছুর অপচয় হয়। কাগজের দুই দিক ব্যবহার করা দরকার।
প্রিন্ট করা কাগজ ব্যবহার শেষ হলে অন্য পিঠে কিছু লিখবে । ব্যবহার করবে।
বাজারের তালিকা বা অন্য কোন লেখায় ব্যবহার করবে।

২।পশু পাখীর চামড়া বা হাড় ব্যবহার করে যে সব পণ্য উৎপাদন করে সেইগুলো
ব্যবহার করবে না। দশ বছর আগে ১.৫ মিলিয়ন হাতি ছিল সারা দুনিয়ায়। এখন আছে মাত্র ৭ লক্ষ ৫০
হাজার। হাতির দাঁতের লোভে ওদের মারা হয়েছে। আজও মারা হচ্ছে। যত আইভরি বিক্রি হয় ৩০% আমেরিকানরা কেনে। তোমার একটা সুন্দর জামা বা জুতার জন্য বহু দূরে প্রাণ হারাচ্ছে কোন অবলা প্রাণী।

৩। পুরানো কাপড় ফেলে দেবে না বা নষ্ট করবে না। যদি ভাল থাকে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দাও। চাইলে বিক্রি করে দাও। কিন্তু নষ্ট করবে না।

৪। বাইরে কোথাও গেলে বাসা থেকেই জলের বোতল নিয়ে যাবে। যাতে নতুন বোতল কিনে ব্যবহারের পর সেখানে সেখানে ফেলে আসতে না হয়।

৫। প্ল্যাসটিকের ব্যাগ যত কম পার ব্যাবহার করবে। দোকানিকে বলবে কাগজের ব্যাগে দিতে।

৬। দরকার না হলে লাইট বা ফ্যান ব্যবহার করবে না। বিদ্যুৎ বাঁচানোর চেষ্টা করবে। বাইরে যাবার আগে দেখে যাবে খামাখাই কোন আলো বা পাখা চলছে কিনা। বাদলার দিনে এয়ার কন্ডিশন চালানোর মত বিলাসিতা বন্ধ করলেও কাজ দেবে।

৭। জলের কল মেরামত করবে। প্রতি সেকেন্ডে যদি এক ফোঁটা জল পড়ে তবে এক বছরে ২৩০০ গ্যালন জল নষ্ট হবে। কল মেরামত করতে না পারলে সেই কলের নীচে বাউল বা বালতি রাখবে। জল সংগ্রহ করবে। জমা হলে রান্নায় ব্যবহার করবে। বা বাগানের গাছে দেবে। মোদ্দা কথা ব্যবহার করবে।

৮। ফ্রিজের বরফের অংশে যেন ২৫% বরফ জমে না যায়। বার বার ফ্রিজের দরজা খুললে বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয়।

৯। বাথটাবে বা ঝর্নাতে স্নান না করে মগ বালতি দিয়ে স্নান করলে অনেক জল সেভ করা যায়। গড়ে ৩৫০ গ্যালন জল খরচ করে একটা আমেরিকান পরিবার। খরচ আরও কমানো যায় যদি লন্ড্রি মেশিন ভর্তি করে কাপড় দিয়ে লন্ড্রি করা হয়।

১০। দরকার না হলে উজ্জ্বল আলো ব্যবহার করবে না। মাঝে মাঝে বাল্ব পরিষ্কার করবে ন্যাকড়া দিয়ে। ল্যাম্প শেড ও পরিষ্কার রাখবে। আলো বেশি পাবে।

১১। কিছু জিনিসের রিসাইকেল নিজেই কর। চায়ের পাতা, সবজির খোসা এই সব জিনিস ময়লার বিনে না ফেলে বাগানে গর্ত করে ফেল। সার হবে। টবের গোঁড়ায় দিতে পার।

১২। সময় সুযোগ পেলে একটা গাছ অন্তত নিজে হাতে লাগাও। মন ভাল হয়ে যাবে।

১৩। খামাখাই বেশি বেশি পেপার ন্যাপকিন ব্যবহার করবে না।

১৪। দাঁত মাজার সময় জলের ট্যাঁপ খুলে রাখবে না।

১৫। খবরের কাগজ, পুরানো বোতল এই সব ফেলে না দিয়ে ভাঙ্গারির কাছে বিক্রি করবে। প্রায় রোজই ওরা আসে। চেঁচিয়ে বলে- প্পরানা বই খাতা শিশি বোতল থাকলে বিকরী করতে পারেন… ন… ন ।

১৬। গাড়িতে অপ্রয়োজনীয় জিনিস রাখবে না। প্রতি ১০০ পাউনড ওজনের জন্য গাড়ির ফুয়েলের খরচ ১% বেড়ে যায়।

১৭। বাথরুম পরিষ্কারের জন্য বেকিং সোডা আর ব্রাশ ব্যবহার করবে। ক্যামিকেল না করলেই ভাল।

এই তালিকাতা অনেক বড়। তোমরা আরও জানবে আরও শিখবে। চেষ্টা করবে রিসাইকেল করতে। গাছ বুনতে। পরিবেশ আর পৃথিবীকে ভালবাসতে।
কারো ক্ষতি করে ভাল থাকা যায় না। এখন ও সময় আছে মায়াবী এই পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য। আশা করি তোমরা এগিয়ে আসবে। যাতে ভবিষ্যতের পৃথিবী আরও সুন্দর হয়। এই পৃথিবী আমাদের। একে ভাল রাখা আমাদের সবার কাজ।