Site icon খিচুড়ি

চকলেট চকলেট

এক অদ্ভুত মনকাড়া জিনিস।
আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাইকে মুগ্ধ করে ফেলে।
কল্পনা করুন -চারকোণা বার আকৃতির জিনিসটা। কেনিয়ার মাসাই মেয়েদের গায়ের
রঙের মত রঙ। অথবা লিচুর দানার মত। মিষ্টি মন মাতানো ঘ্রান। আস্তে কামড় দিন।
অপূর্ব মিষ্টি স্বাদ। বিভূতিভূষণের ভাষায় মিষ্টি যেন গুড়। জিভ আর টাকরায় জড়িয়ে
গেছে নরম আঠালো স্বাদ। বাদাম থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। সবই
আপনার ইচ্ছা।
আবেশে বুজে গেছে আপনার চোখ।
কি মিয়া জিভে পানি এসে গেছে ?
হ্যাঁ ।এরই নাম চকোলেট।
আমার পিচ্চিবেলায় দামি চকোলেট পাওয়া যেত হাতে গোনা মাত্র কয়েক জায়গায়। আমরা পাড়ার
মুদি দোকান বা বড় দোকানগুলো থেকে চকলেটের নাম করে যা কিনতাম তার আরেক
নাম ছিল লজেন্স।
চিনির একটা রঙের ঢেলা। চকচকে মোড়কে মোড়ান থাকতো
পিচ্চি একটা বাচ্চাকে বড় বিছানার চাদরের মাঝখানে রেখে মাথা আর পায়ের কাছে মুড়ে রাখলে
যেমন হবে, দেখতে ঠিক সেই রকম।
দাম ছিল চার আনা। খুব ভাল হলে আটআনা। নতুন প্রজন্মের অনেকেই বুঝতে পারবে
না চার আনা জিনিসটা আসলে কী ? এটা আসলে ২৫ পয়সা। পিচ্চি একটা মুদ্রা। আমরা
অনেকে সিকি বলতাম। আর ৫০ পয়সা হচ্ছে আটআনা। যাকে আধুলি বলত অনেকে।
সেই সময় একটা আধুলি থাকলে নিজেকে বেশ ধনী মনে হত। কোথায় যে হারিয়ে গেল
সেই মুদ্রাগুলো!
সেই রঙিন ঢেলাটাই চকোলেট নামে চুষতাম। খাওয়া শেষ হলে জিভটা মানুষ খেকো শ্বাপদের
মত লাল হয়ে থাকতো।
একটা চকোলেট গালের ভেতরে রেখেই টইটই করে ঘুরে বেড়িয়েছি কত জায়গা।
মাঝে মাঝে অন্য পাড়ার দুষ্ট ছেলেদের সাথে মারামারি লাগ্লে চকোলেটটা চট করে
হাফ প্যান্টের পকেটে রেখে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম শত্রুপক্ষের উপর।
মারামারি শেষ হলে নিরাপদ জায়গাতে এসে পকেট থেকে চকোলেটটা নিয়ে বাতাসে ঝেড়ে
আবার মুখে পুরে হাঁটা শুরু করতাম।
চকোলেট ইংরেজি শব্দ।
তবে শব্দটা ইংরেজরা চুরি করেছে স্প্যানিশদের কাছ থেকে।
আর লুটপাটের রাজা স্প্যানিশরা শব্দটা লুট করেছে মায়ানদের কাছ থেকে।
প্রাচীন বিলুপ্ত জাতি অ্যাজটেকদের ভাষার নাম ছিল নাহুয়াটল।
এই নাহুয়াটল ভাষায় একটা শব্দ হচ্ছে Cacahuatl । এই শব্দটা থেকেও
চকোলেট শব্দটা এসেছে এমন ধারনাও অনেকের।
চকোলেটের ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে বেশ বিব্রত হয়ে গেলাম। কারন চকোলেট
আবিস্কারের পিছনে বহু বহু গাল গল্প ছড়িয়ে আছে। একেক বইতে একেক রকম
তথ্যও পেলাম। তবে মোটামুটি যা হচ্ছে- যীশুখৃষ্টের জন্মের প্রায় ১১০০ বছর
আগে থেকেই চকোলেট চালু ছিল।তবে তা শুধু পানীয় হিসাবে।
মেক্সিকো আর সাউথ আমেরিকার এলাকাগুলোতে ১৫ থেকে ২৬ মিটার লম্বা এক
ধরনের গাছ হত। গাছটার নাম বেশ গাল ভরা-Theobroma cacao.
এই ক্যাকেও গাছের ফলের বীজ গুড়ো করে পানীয় তৈরি করত মায়ান আর অ্যাজটেকরা।
পান করত অভিজাত শ্রেণীর লোকজন । তাদের ভাষায় এটা হচ্ছে দেবতার খাবার।
আর গ্রিকদের কাছে চকোলেট হচ্ছে- শয়তানের খাবার।
কত বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি।
অনেকের মতে কলম্বাস প্রথম কোকার বীজ নিয়ে আসেন সভ্য জগতে। আবার অনেকের মনে তারও
বহু আগে স্প্যানিশরা কোকার বীজ গুঁড়িয়ে গরম পানীয় হিসাবে ব্যবহার করত।
প্রথম চকোলেটের দোকান খোলা হয়েছিল লন্ডনে। ১৬৫৭ সালের কথা।
দোকানের মালিক ছিলেন এক ফরাসি ভদ্রলোক। দাম ছিল গলা কাটা। এক পাউনড চকোলেটের
দাম পড়ত ১০ থেকে ১৫ শিলিং। খুব ধনীরাই ছিল এই দোকানের খদ্দের।
তখনও তরল পানীয় হিসাবে চকোলেট চালু ছিল।
তাই স্পেনের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অভিডো সেই সময় বলেছিলেন-ধনীরা টাকাগুলো পানিতে
গুলিয়ে খাওয়ার জন্য চকোলেটের দোকানে যায়।
১৭৬৫ সালে জন হানান নামে এক ভদ্রলোক ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে কোকার বীজ আমেরিকাতে
নিয়ে যান। সে সময় জেলেরা মাছ ধরার পারিশ্রমিক হিসাবে কোকার বীজ নেয়া শুরু
করে।
জনপ্রিয় হতে শুরু করে চকোলেট।
নতুন নতুন জিনিস যোগ হয় কোকা পাউডারের সাথে। দুধ-চিনি- ক্যারামেল।
এবং এর পরিপূর্ণ রূপই আজকের চকোলেট বার।
হাজার পদের চকোলেট আছে বাজারে। কিন্তু আপনি যদি বাবুর্চি হন তবে আপনার চোখে
চকোলেট মাত্র তিন ধরনের।
সাদা চকোলেট। মিল্ক চকোলেট ।আর ডার্ক চকোলেট
সাদা চকোলেট স্বাদে ভাল। কোকার পরিমাণ প্রায় নেই। মিল্ক চকলেটে দুধ এবং কোকার পরিমাণ
একটু বেশি। এবং ডার্ক চকলেটে প্রায় ৮৫% পযন্ত কোকার পরিমাণ থাকে। তাই এর স্বাদটা
একটু শক্তিশালী।
প্রায় সব দেশে কোকার বীজ উৎপন্ন হলেও ওয়েস্ট আফ্রিকার দেশগুলোতে সব চেয়ে বেশি হয়।
অর্থাৎ- নাইজেরিয়া, ঘানা আইভরি কোস্ট এইসব…।
এক কালে ইংরেজদের কলোনি ছিল এই দেশগুলো তখনই কোকার চাষ শুরু হয়েছিল।
আমাজন অঞ্চলের রেইন ফরেস্টগুলোতেও কোকা হয় প্রচুর।
১৯৫২ সালের ১লা অক্টোবর নিউ ইয়র্কের ওয়ালড ট্রেড সেন্টারে খোলা হয়- নিউ ইয়র্ক কোকা
একচেঞ্জ। জাতে ক্রেতা আর বিক্রেতারা সহজেই কোকার বীজ কেনা বেচা করতে
পারে।
চালু হয়ে যায় চকলেটের ব্যবসা।
১৯৮০ সালে ছড়িয়ে পড়ে রাশিয়া, চিন, সৌদি আরব সহ সারা দুনিয়াতে।
পুরানো কাগজ পত্রের হিসাব অনুযায়ী ১৯৯০ সালে ৬ লক্ষ টন কোকার বীজ
বেচা হয়েছে বিভিন্ন দেশে।
অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করে কি ভাবে চকলেট ভাল ভাবে সংরক্ষণ করা যায়।
উত্তর- ফ্রিজে।
৬৮ থেকে ৭২ ডিগ্রী ফারেন হাইট খুব ভাল।
তবে সেই সাথে বলে রাখি, চকলেট অনেক দিন ধরে সংরক্ষণ করলে এর মান ভাল থাকে না।
আর যারা রান্না বান্নাতে চকলেট ব্যবহার করতে চান , খেয়াল রাখবেন ব্যাপারটা
একটু কষ্টকর।
কারন চকলেট রান্নায় ব্যবহার করা,যেন ক্যামিকেল বোমা বানানোর মতই।
বেশি তাপ লাগলে পুড়ে কালো ছাই হয়ে যাবে। আর কম. তাপ ব্যবহার করে রান্না করলে
ব্যথ প্রেমিকের হৃদয়ের মত ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।
তবে পিচ্চি একটা কায়দা জানিয়ে দিচ্ছি। কোনও খাবারে
তরল চকলেট ব্যবহারের আগে যদি জ্বাল দিতে হয় তবে ডার্ক চকলেট হলে ১১৫ ডিগ্রী
আর মিল্ক চকলেট হলে ১১০ ডিগ্রী ফারেন হাইট তাপে গরম করবেন। এবং যতক্ষণ
চুলোতে থাকবে কাঠের চামচ দিয়ে হালকা ভাবে নাড়তে থাকবেন। যাতে তলানি
লেগে না যায়।
আর যদি মাইক্রো আভেনে করেন তা হলে চকলেট বারটা টুকরো টুকরো করে
মাত্র ৩০ সেকেন্ড আভেনে রাখুন।
পোষা প্রানীকে কি চকলেট খাওয়ানো ভাল ?
আজ্ঞে না।
দয়া করে এই কাজটি করবেন না।
বিজ্ঞানীদের মতে এটা ওদের ক্ষতিই করে।
বদলে অপ্রিয় কোন বন্ধুকে খাইয়ে দিন। এবং খাতায় লিখে রাখুন- আজ একটা বানরকে
চকলেট খাওয়ালাম। ফিলিং হ্যাপি।
কফির চেয়ে চকলেট কি বেশি ভাল ?
হ্যা-বিজ্ঞানীরা তো তাই বলে। এক কাপ কফিতে দানার প্রকার ভেদে ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম
ক্যাফিন থাকে। কিন্তু প্রায় সম পরিমাণ চকলেটে মাত্র ৩০ মিলিগ্রাম ক্যাফিন থাকে।
উপহার হিসাবে চকলেটের মান কতটুকু ?
আমার তো ধারনা বহুমুত্রের রোগী ছাড়া সবার জন্যই সেরা উপহার হতে পারে চকলেট।
ভ্যালেন্টাইন দিনগুলোতে কত টন চকলেট বিক্রি হয় এক মাত্র খোদাই জানেন।
বিজ্ঞানীদের মতে চকলেটের মিষ্টি স্বাদ আর ক্যাফিন বেশ কিছুটা
উত্তেজিত করে মনোদৈহিক ভাবে।এই জন্যই হয়তো প্রেমিকরা তাদের প্রেমিকাকে
চকলেট দিতে চায় উপহার হিসাবে।ভাবে এতে যদি উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা
হয়ে যায়…ইয়ে মানে…।যা বলছিলাম…।আর কি…।
এক সময় লোকজন ভাবত চকলেট বুঝি খুবই ক্ষতিকর। আসলে তা নয়।
পেনসিলভানিয়ার ইস্কুল অব মেডিসিন আর আমেরিকান ন্যাভাল একাডেমি এই দুই প্রতিসঠান
দীঘ দিন গবেষনা করে দেখেছে-চকলেটের মধ্যে প্রায় ৩০০ ধরনের ক্যামিকেল
রয়েছে যা মানব দেহের জন্য বেশ উপকারি। সবচেয়ে বড় কথা ডার্ক চকলেট নিয়মিত
খেলে ব্লাড প্রেসার অনেক লো হয়ে যায়। আজকাল আর্মি অফিসারদের রেশন হিসাবে
ও চকলেট দেয় আমেরিকানদের। শুরুটা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই।
অসংখ্য ককটেল আর মদে চকলেট ব্যবহার করে এত স্বাদ বাড়ানো হয়।
মেক্সিকোর কালয়া ( Kahlua) আর আয়ারল্যান্ডের বেইলীস এর (Baileys) নাম না বললে
খারাপ দেখায়। অবিশ্বাস্য স্বাদ।
কানে কানে একটা ককটেলের মিক্স জানিয়ে দিচ্ছি। একদম সহজ। লাগবে তরল চকলেট আর
যে কোন ভদকা। গ্লাসে কিছু বরফের কিউব দিয়ে ৬ ভাগ ভদকা এর ১ ভাগ তরল চকলেট
দিয়ে হালকা মিশিয়ে দিলেই হয়ে যাবে ক্লাসিক এই পানীয়টা।
চকলেট দিয়ে আরও হাজারটা মিক্স জানি। সঙ্গত কারনেই লিখলাম না ।
চকলেটের সবচেয়ে ক্লাসিক নন অ্যালকোহলিক পানীয় হচ্ছে চকলেট শেক।
একদম সোজা। যা যা লাগবে আধ কাপ পানি । ২ চামচ সাদা চিনি। আধ লিটার দুধ।
আর দুই কাপ চকলেট আইসক্রিম। মিক্সচার মেসিনে সব কিছু দিয়ে ১ মিনিট মিক্স করুণ।
লম্বা সাদা কাঁচের গ্লাসে ঢালুন। এই ধরনের গ্লাস গুলোকে শেক গ্লাস বলে।
পরিবেশনের আগে উপরে চকলেটের কিছু গুড়ো ছড়িয়ে দিন।
সব কথার শেষ কথা চকলেট খেতে কখনই লেট করবেন না।

Exit mobile version