নির্ভীক মুজাহিদ, শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, বিচক্ষণ রাজনীতিক, ক্ষণজন্মা সাধক, সময়ের সেরা দরবেশ, মুসলিম উম্মাহর গর্বের ধন শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. ছিলেন জ্ঞান-পাণ্ডিত্য, তাকওয়া-পরহেজগারী, জিহাদ ও দাওয়াত– এক কথায় আল্লাহ পাকের মনোনীত ধর্ম ইসলামের বিজয় ও প্রতিষ্ঠা সাধনের ভুবনে এক কিংবদন্তী পুরুষ। তিনি ছিলেন শাইখুল হিন্দ হযরত মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রাহ. এর যোগ্যতম উত্তরসূরী। যাঁদের অকান্ত পরিশ্রমের ফসল এই স্বাধীন ভারত উপমহদেশ, যাঁদের নাম বর্ণমালার পোষাকে নযরে পড়লেও আতঁকে ওঠে আজ অবধি বৃটিশ শ্বেত ভল্লুকেরা, মাল্টার নির্জন দ্বীপ আবাদ হয়েছিল যাঁদের সাধনার বদৌলতে– তাঁেদরই অন্যতম বীর সেনানী, আপোষহীন বিপ্লবী নেতা, নবী বংশের দীপ্ত প্রদীপ সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.। এই মহামনীষীর ইখলাস, তাওয়াক্কুল, তিলাওয়াত ও রাতভর তাহাজ্জুদের কান্নাপ্লাবিত সাধনা ছিল উপমাময়। পবিত্র কুরআনের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অমলিন ইর্ষণীয় ও সীমাহীন। নিম্নে তাঁরই একটি ঘটনা বর্ণিত হচ্ছে।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে তখন কঠোর আন্দোলন চলছিল। এক পর্যায়ে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী করে বন্দী করা হলো শাইখুল হিন্দ হযরত মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রাহ.কে। তারপর তাকে নির্বাসন দেওয়া হলো আন্দামান দীপপুঞ্জে। স্বীয় উস্তাদ ও শাইখের কষ্টের কথা চিন্তা করে তাঁর একাকী নির্বাসনকে মেনে নিতে পারলেন না প্রিয় শাগরেদ হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.। তিনি বললেন, আমার উস্তাদের সাথে আমাকেও তোমরা নির্বাসনে পাঠাও। আমি তাঁর সাথে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত তাঁর আবেদন মঞ্জুর করল। তাকেও পাঠিয়ে দিল আন্দামান নির্বাসনে। কিছুদিন পর তাঁদের বন্দী জীবনে এলো রহমত ও বরকতের মাস রমজান। হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. প্রিয় শাগরেদ হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.কে ল্য করে গভীর আক্ষেেপর সুরে বললেন, এ রমজানে আমরা হয়তো কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত শুনতে পারব না!
এ কথাটি হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. এজন্য বলেছিলেন যে, তিনি এবং হযরত মাদানী রাহ. কেউ-ই কুরআনে কারীমের হাফেজ ছিলেন না। তাছাড়া এখানো অন্য কোনো হাফেজও ছিলনা; যাকে ইমাম বানিয়ে তাঁরা খতমে তারাবীহ পড়তে পারেন। উস্তাদের কথা শুনে প্রিয় নবীজীর সুন্নতের প্রেম আর আল্লাহর কিতাবের প্রতি অমলিন ভালবাসা উথলে উঠলো হযরত মাদানীর হৃদয়েও। তিনি মুহূর্তকাল মাথা নিচু করে কী যেন ভাবলেন। তারপর আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস ও তাঁর অসীম রহমতের প্রতি ভরসা রেখে বলেই ফেললেন, হযরত! আপনি দোয়া করুন। ইনশাআল্লাহ আমিই খতমে তারাবীহ পড়াব। হযরত আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কীভাবে পড়াবে? তুমি তো হাফেজ নও। জবাবে মাদানী রহ. বললেন, দিনে মুখস্থ করে রাতে পড়াব। হযরত বললেন, ঠিক আছে তাই হবে। রমজানের আগের দিন। হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. কুরআন শরীফ নিয়ে বসলেন। আরশে আযীম থেকে তাঁর উপর বর্ষিত হলো করুণার ধারা। অলৌকিক মুজিযাগ্রন্থ আল কুরআনের এক আশেকের কাছে পরাস্ত হলো মানুষের স্বাভাবিক মাপ-ঝোপের অভিজ্ঞতা। দেখা গেল, সেদিন থেকে হযরত মাদানী রহ. দিনে এক পারা করে মুখস্থ করে ফেলতেন আর রাতে তা তারাবীহের নামাজে স্বীয় শায়েখকে শোনাতেন। এভাবে তিনি ত্রিশ দিনে পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করে হাফেজ হলেন আর আপন উস্তাদের মনের আশাও পুরা করলেন। প্রিয় পাঠক! এই তো হলো কারামত। এই তো হলো উস্তাদ ভক্তির অনন্য নযীর। (সূত্র : বীস বড়ে মুসলমান, মালফুযাতে হাকীমুল উম্মত, আনওয়ারুল আউলিয়া, পৃষ্ঠা-১৪৫)