Site icon খিচুড়ি

তারাপদ বাবুর একদিন

তারাপদ বাবু সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছেন.জিনেরা মিষ্টি খেতে পছন্দ করে।
শুধু তাইনা,যে দোকানেরমিষ্টি একবার ওদের ভাল লেগে যায় সেই দোকানের মালিকের অবস্থা একেবারে পোয়াবারো হয়ে যায়।গভীর রাতে জিনেরা আসে ছদ্মবেশ নিয়ে।বেশিরভাগ সময়ইসাদা পোশাক পরা হুজুর সেজে আসে।দশ পনেরো কেজি মিষ্টি কিনে নেয় একবারে।পরদিন রাতে আবারআসে।আবার দশ-পনেরো কেজি মিষ্টি কিনে নিয়ে যায়।দোকানেরমালিকের অবস্থা পাল্টাতে বেশি সময় লাগেনা।কারন এভাবে চলতেই থাকে।ঘটনা সত্য না মিথ্যা জানার কোনো উপায় নেই।
অথচ এত মানুষের মুখে এই জিনের গল্প শুনেছেন যে বিশ্বাস না করেও উপায় নেই।তারাপদ বাবুর এক বন্ধু ছিল।যাদের মিষ্টির দোকানের নাম রসকুন্ড।তাদের অবস্থাও আগে এত ভাল ছিলনা।কোনো মতে টেনে হিচড়ে চলত তাদের ব্যাবসা।কিন্তু একবার গভীর রাতে নাকি এক মাওলানা টাইপের খদ্দের এসে দশ.কেজি মিষ্টির অর্ডার দিয়েছিল।খদ্দের মিষ্টি নিয়ে চলে যাবার পর তারাপদ বাবুর বন্ধু,অর্থাৎ,দোকানের মালিক তার টেবিলেরউপর পেয়েছিল তিন তিনটে আকবরী মোহর।আর সেগুলো বেচেই তো বড়লোক হয়ে গেল বন্ধু।তারাপদ বাবু ভাবেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।ইস,তার জীবনেওযদি এমন হত।আচ্ছা,জিনেরা কি হিন্দুদের মিষ্টির দোকানে যায়?নাকি শুধু মুসলমানদের মিষ্টির দোকানে যায়?ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেও কোনো কুল কিনারা পাননি তিনি।
শুধু নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মাঝে মাঝে।
দোকানটা খুব একটা চলেনা তারাপদ বাবুর।এর লোকেশনটাই খারাপ।হাট আর ট্রেন ইস্টিশন থেকে বেশ অনেকটাই দূরে তার দোকান।ফলে সেই অর্থে তেমন লোকজন হেটে যায়না দোকানের সামনে দিয়ে।ইস্টিশনের শেষ ট্রেনটা যায় সন্ধ্যা সাতটায়।এর পরই সব নিঝুম।আর হাট তো ভেঙ্গেছে সেই বিকাল ছয়টায়।ব্যাপারীরা বহুদূর থেকে আসে তো,তাই চট জলদি হাটা ধরে বাড়ির দিকে।দু চারজন থামে।ঢোকে দোকানে।ওরা এককাপ দুধ চা আর বড় একটা টোস্ট বিস্কুট খেয়ে যে যারপথ ধরে।গ্রামের মানুষজন তো আর প্রতি সপ্তাহে নিষ্টি কিনবেনা।দরকার কী?কারো মেয়ের জামাই এলে সে নিজেই মিষ্টি কিনে আনে।তাও নেয় ইস্টিশনের সাথের গনেশ বাবুর দোকান থেকেই।
আর এই জন্যেই গনেশ বাবুর দোকানটা দারুনব্যাবসা করছে।অথচ ওদের মিষ্টি আর তারাপদ বাবুরমিষ্টি,আকাশ পাতাল তফাৎ।তারপদ বাবু যদি নিজের ‘গু’দলা করে চিনির সিরার মধ্যে ডুবিয়ে রাখে তবে সেটা গনেশ বাবুর দোকানের মিষ্টির চেয়ে লক্ষ কোটি গুণ ভাল হবে!তাই বেশ মনোদুঃখে দিন কাটছিল বেচারার।
তিনকুলে কেউ নেই তারাপদ বাবুর।বুড়ি এক মা ছাড়া।বউছিল,মারা গেছে বছর পাচেক আগে।বাচ্চা কাচ্চা হয়নি।বিয়েওকরেননি আর।
সেই থেকে দোকান নিয়েই পড়ে আছেন।সেইসকালে এসে ঢোকেন দোকানে। সারাটা দিন ব্যাস্ত থাকেনএটা সেটা নিয়ে।একটা কর্মচারী আছে বটে,পটলা।ওটাকে শতধাতানি দিয়েও লাভ হয়না।কুঁড়ের বাদশা।নড়তে চড়তে দিন শেষকরে ফেলে।সপ্তাহে তিনটা গ্লাস ভাঙ্গে।কাস্টমারের খাবারফেলে দেয় হাত থেকে হর হামেশাই।
তারাপদ বাবু শুধুচোখদুটো গোল্লা গোল্লা করে তাকিয়ে থাকেন।দুর্গা পূজারলাড্ডুর মত।কষে একটা ধমকও দেননা পটলাকে।এসব তারধাতে নেই।বড্ড নরম মনের মানুষ তিনি।আগে মাঝে মধ্যে শুধু রেগে বলতেন,‘পটলারে থাপ্পর দিয়া তরবত্রিশটা দাঁত ফালাইয়া দিমু।’
এতে লাভ হত,পটলা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসত।মাত্র গতকালই এক কাস্টমার এক প্লেট দইয়ের অর্ডার দিয়েছিল।পটলা সেটা পিরিচে করে নেয়ার সময়পা হড়কে গিয়ে উবু হয়ে পড়েছিল অন্য কাস্টমারের গায়ে।দই টইমেখে সেই কাস্টমারকে দেখাচ্ছিল একেবারে দই পিশাচের মত!এমন করলে কি আর কাস্টমার ফেরত আসে?
দিনমান ব্যাস্ত থাকেন তারাপদ বাবু।নিজের হাতে দোকানেরসামনে ঝাঁট দেন।ক্যাশ বাক্স আর কাঁচের আলমারীগুলো যত্নকরে ন্যাকড়া দিয়ে পরিষ্কার করেন।বেশিরভাগ টুল-বেঞ্চিগুলোও নিজে সাফ করেন।কাঁসার এক গ্লাসপানি নিয়ে ছিটিয়ে দেন দোকানের সামনে।যাতে লোকজন হেটে গেলে ধুলা না ওড়ে।সারাজীবনের দক্ষতা আর ভালবাসা দিয়ে তৈরি করেন লাড্ডু,আমিত্তি,জিলিপি,চমচম,কালোজাম,রসগোল্লা আরো কত কী!মাটির চুলার উপর বসিয়ে দেনএকটা ঢাউস কেতলি।যার মুখটা হাতির শুঁড়ের মত।
তারপরতীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করেন কাস্টমারের।গ্রামের বুড়ো দু একজন এসে বসে থাকে।এরা সারাদিন বসে থেকে মাত্র এক কাপ চা খায়।আর হনুমানের মত কান খাড়া করে রেডিওর খবর শোনে।সারাক্ষনই একটা তিন ব্যান্ডেররেডিও বাজে তারাপদ বাবুর দোকানে।ব্যাটারির খরচটা একটুবেশি হলেও রেডিও বন্ধ করতে চাননা তিনি।ভাবেন,থাক,এইখবর শোনার জন্যও দু চারজন কাস্টমার বেশি আসতে পারে।
সন্ধ্যার পর প্রায় মৃত্যুপুরী হয়ে যায় চারদিকটা।উত্তর দিকের খোলা মাঠ থেকে সাঁই-সাঁই করে হিমেল বাতাস আসতে থাকে।জলাভুমি থেকে দলে দলে মশা উড়ে এসে সমবেত সঙ্গীত শুরুকরে।ইস্টিশন বন্ধ।লোকজন নেই।আর পটলা তো সন্ধ্যার পরথেকেই ঘুমে ঢুলতে থাকে।টিমটিমে একটা বাতি জ্বেলে ক্যাশ বাক্স জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন তারাপদ বাবু।পটলাকে ছুটি দিয়ে দেনপ্রায়ই।দোকানে বসে ঘুমে ঢোলা খুবই অলক্ষী।ছুটি পেয়ে পটলাও খুশি।দোকানের পেছনে একটা ছাপড়া মত ঘর আছে।সেটাতে সয়াবিন তেল,আটা,চিনি আর লাকড়ি থাকে।সেটাতেই চটের বিছানা পেতে শোয়া মাত্রই মরে যায় পটলা।জেগে ওঠে পরেরদিন সকালে তারাপদ বাবুর গলা শুনে।
দোকান চালাতে ‘সততাই সর্বত্তম পন্থা’ টাইপের দার্শনিক মনোভাব ধরে রেখেছেন তারাপদবাবু।এই আক্রার বাজারেও যতটা সম্ভব খাঁটি দুধ,ভাল চিনি এবং পাম অয়েলের বদলে সয়াবিন তেল ব্যাবহাত করেন।অনেক দোকানে চায়ের মধ্যে চিনির বাসী সিরা দিয়ে দেয়।সেরকম কখনই করেননা তারাপদ বাবু।তারপরও ততটা নাম যশ করতে পারেননি বেচারা।
দিনগুলো হয়ত এভাবেই কেটে যেত।
শুধু একদিন লম্বা-ফর্সা আরসুট পড়া একজন লোক এসে বড় ঝামেলায় ফেলে দিল তাঁকে।
সেটা ছিল শ্রাবন মাসের মাঝামাঝি।ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল সেই সন্ধ্যায়।দুপুর থেকেই দোকানে খদ্দের নেই।হাট জমে ওঠেনি বৃষ্টির জন্য।কাজেই দিনটা মার গেল।সন্ধ্যার দিকে দু একজন বুড়ো এসে বসত রেডিও শোনার লোভে,তাদেরও পাত্তা নেই।একেবারে কুফা!সন্ধ্যার পরই পটলাকে ছুটি দিয়ে দিলেন তিনি। ঘুমে মাথা ঠুকে যাচ্ছে বারবার টেবিলের উপর।যাক,বৃষ্টি বাদলার দিন,পড়ে পড়ে ঘুমাক।খাটুনি তো আর কম করেনা পিচ্চিটা।একাই বসে রইলেন ক্যাশ বাক্স আগলে ধরে।বাধ্য হয়ে তেজপাতা দিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে চুমুক দিতে লাগলেন ধীরে ধীরে।
এমন সময় লোকটা এসে হাজির হল দোকানে।বেশ রোগা।বয়স বলা কষ্ট।ফর্সা প্রায় মুলোর মত।শ্বেতি রোগী কিনা কে বলবে!কালো সুট পরা।একটা টাইও ল্যাগব্যাগ করছে গলার কাছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে শহুরে লোক।এই গ্রামে কার বাড়িতে এসেছে?চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে?তাহলে গাড়ি কই?লোকটা বেশ হাসি হাসি মুখ করে ঢুকে আয়েস করে বসল একটা টুল টেনে নিয়ে।
খরগোশের মত ব্যাস্তভঙ্গিতে ছুটে গেলেন তারাপদ বাবু।গামছা দিয়ে টেবিল মুছতে মুছতে বললেন,‘চা আর কুকিস দিমুনি সাহেব?’
‘নাহ।’হাসল লোকটা।হাসিটা সুন্দর।গলার স্বরটাও অভিজাত।
‘তয় কী দিমু?’একটু হতাশ হলেন তারাপদ বাবু।এইরে!ব্যাটা বোধহয় বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য ভেতরে এসে আশ্রয় নিয়েছে।বৃষ্টিটা একটু কমলেই হাটা ধরবে।
‘এক কেজি চমচম দিন।’
বুকটা ধড়াস করে উঠল তারাপদ বাবুর। দুর্গা দুর্গা!সারাদিন পর ভগবান তাকে খদ্দের দিয়েছেন।হোক মাত্র এক কেজি।
ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন তারাপদ বাবু।কাগজের বাক্সের ভেতর যত্নকরে প্লাস্টিক রাখলেন।যাতে মিষ্টির সিরা দিয়ে নিউজ প্রিন্ট কাগজের বাক্স নরম না হয়ে যায়।পরে টপ টপ করে চমচম।খসে পড়তে পারে।যত্ন করে চমচমগুলো তুলে ওজন করতে লাগলেন।ওজনে কম দেয়ার জন্য হরেক কিসিমের কায়দা-কানুন আছে।সবই জানেন তারাপদ বাবু।কিন্তু নিজের ব্যাবসায় কখনো সেগুলো ব্যাবহার করেন না।
অন্যকে ঠকিয়ে কী লাভ?ভগবান যাকে দেন এমনিতেই দেন।পাটের সুতলি দিয়ে চমৎকারভাবে মিষ্টির বাক্সটা মুড়ে ফেললেন।তারপর অত্যন্ত বিনয়ের।সাথে তুলে দিলেন কাস্টমারের হাতে।‘কত?’জানতে চাইল ভদ্রলোক।‘দুইশ টাকা,সাহেব।’কোনো কথা না বলে পকেট থেকে টাকা বের করে তারাপদ বাবুরহাতে তুলে দিলেন সাহেব।ভদ্রলোক দামাদামি করেননি।যদিও ইস্টিশনের পাশের দোকানের তুলনায় তার দোকানের সবই সস্তা।তারপরও বহু বিটলে খদ্দের পাওয়া যায়,যারা একশ টাকা কেজি বললেও দামাদামি করবে।
টাকা হাতে তুলে দিয়েই চটপট বাইরে হাটা ধরলেন ভদ্রলোক।যেন খুব তাড়া আছে তার।যদিও বাইরে তখনো বেশ বৃষ্টি পড়ছে।একটু অবাকই হলেন তারাপদ বাবু।বাপরে কী অদ্ভুত লোক!এমনবৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাচ্ছে এমন শশব্যাস্ত হয়ে?কোন গ্রামের লোক?কৌতুহলী হয়ে বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে বাইরে এসে দাড়ালেন তিনি।এবং ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন।
যতদুর চোখ যায় কেউ নেই।অথচ লোকটা মাত্র বাইরে গেছে।আশেপাশে এমন কিছুও নেই যার জন্যে লোকটাকে দেখা যাবেনা।বাড়ি-ঘরগুলোও বেশ দূরে।এই জায়গাটুকুতে শুধু লম্বা দীঘল সবুজকিছু ঘাস এবং কচুক্ষেতে ভর্তি।একটা ডোবা আছে। যেটাতে ব্যাঙ আর মাছ মিলেমিশে থাকে।বড় গাছ বলতে শুধু বড় দুটো তেঁতুল গাছ।ব্যাস,আর সব কিছু ফাঁকা।এসবের মধ্যে যদি একটা বাচ্চা ছাগলদাঁড়িয়ে থাকে,তবে সেটাকেও দেখা যাবে বহু দূর থেকে।অথচ লোকটার কোনো পাত্তাই নেই।হঠাত কেমন ভয় ভয় করতে লাগল তারাপদ বাবুর।রাতের বেলায়কত কিছুই না হেটে বেড়াতে পারে নিঝুম গ্রামের পথে।যাদের নামনিতে নেই।তবে কি তেনাদের কেউ একজন এসেছিল?হতেও পারে।লোকটার শরীর থেকে চমৎকার আতরের গন্ধ ভেসে আসছিল।তাছাড়া এত বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে আসার পরও লোকটার গা ছিল শুকনো খটখটে।এ
ক লাফে দোকানেরভিতরে ঢুকে পড়লেন তারাপদ বাবু।তারপর দ্রুত বন্ধ করতে লাগলেন দোকান।সর্বনাশ!আর দোকান খুলে রাখার।দরকার নেই।তাছাড়া খদ্দের আসবেনা আর হাজার মাথা কুটলেও।বেশিক্ষন লাগল না কাজ গুছিয়ে আনতে।দোকানের ঝাপ তো আগেই বন্ধ করে ফেলেছিলেন।ভেতরেবসে টিমটিমে হেরিকেনের আলোতে যখন টাকা পয়সা গুনতে বসলেন তখন তার শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এল।ক্যাশ বাক্সের ড্রয়ার ভর্তি টাকা! না,ভুল দেখছেন না তিনি।সত্যি সত্যিই অনেকগুলো চকচকে নতুন টাকা দেখা যাচ্ছে।
আতংকে দিশা হারিয়ে ফেলার যোগাড় হল তারাপদ বাবুর।এসবকী ভগবান?কাঁপা কাঁপা হাতে টাকাগুলো গুনলেন তিনি।পাঁচ হাজার টাকা!এল কোত্থেকে?নাকি সবই স্বপ্ন?এখনইভেঙ্গে যাবে।টাকাগুলো মুঠো ভর্তি করে বসে রইলেন।তারপরওগায়েব হলোনা।
এবার দ্রুত ছাতা হাতে বেড়িয়ে পড়লেন তিনি।জলদি বাড়ি ফিরতে হবে।দোকানের ভেতর ভুতুড়ে ব্যাপারস্যাপার হচ্ছে বোধহয়।ঝটপট তালা মেরে ছাতা মাথা তুলে হাঁটতে শুরু করলেন।বাড়ি বেশি দূরে নয়।গ্রামের প্রথম পাঁচ ছয়টা ঘরের পরই তার বাড়ি।বুড়ি মা’টা বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছে।তিনি বাড়ি পৌছালেই উঠে পড়বে।ফোকলা মুখে হাসবে।সকাল বেলা ঘুম ভাঙার পর প্রথমেই বালিশের তলায় হাত দিলেন।নাহ,টাকাগুলো আছেই।কোত্থেকে এল,কিভাবে এল,সে সব আর ভাবছেন না তারাপদবাবু।টাকাগুলো বাস্তব সেটাই তার কাছে আসল।
কাল রাতে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।রাতে ভাতও খাননি।খিদে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।বুড়ি মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে আবার গুনেছেন তিনি।চকচকে নতুন নোটগুলো।
সকাল সকাল দোকানে চলে এলেন তিনি।বরাবর তাই করেন।দোকানের তালা খুলে দুটো আগর বাতি জ্বালান।তারপর নমষ্কারকরে ক্যাশ বাক্সে ভাংতি টাকা রেখে চুলায় আগুন দেন।তার শব্দশুনে চোখ মুখ ডলতে ডলতে পটলা উঠে পড়ে।তারপর দুজনের জন্য চা নাস্তার ব্যাবস্থা করে পটলা।আজওতার ব্যাতিক্রম হলনা।কিন্তু আজ সব কিছু ভজকট হয়ে গেল।
কারণ কাঁচের আলমারীরদিকে তাকাতেই বড় একটা ধাক্কা খেলেন তারাপদ বাবু।এক বউলভর্তি কালো জাম ছিল।কাল রাতেও সিরার মধ্যে ডুব সাতার দিচ্ছিল।আজ শুধু সিরাগুলো দেখা যাচ্ছে।থোম্বা মেরে বসে রইলেন তারাপদ বাবু।অনেকক্ষণ।তারপর এককাপ করে চা আর দুটো সাদা রুটির সাথে গতরাতের বাসি আলুভাজা গরম করে খেয়ে নিলেন দুজন।খাওয়া শেষে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন মিষ্টি বানাতে।আজকে অবশ্য বেশ কিছু কাস্টমার পেলেন।চা বিস্কুট আর দু একটা মিষ্টি।তবে বওনি হিসেবে ভাল।
অন্যদিনের তুলনায় আরও বেশি গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন তিনি।এমন কী পটলা যখন নতুন একটা কাপ ভেঙ্গে ফেলল তখনওতিনি উদাসভাবে বসে রইলেন।শুধু দোকানের এক খদ্দের সতুরবাপ দরদ দেখাতে গিয়ে বলল ‘হমুন্দির পুতের…মইদ্দে একটা লাথি মারো বাবু।এহহে দিল তো নয়া কাপটা ভাইঙ্গা।দেও,ওর…মইদ্দে একটা লাথি দেও।তুমি না পারলে আমি দেই।’
কিছু না বলে হাসলেন তিনি।জানেন তার ভাগ্য বদলাতে শুরুকরেছে।খামোকা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।সারাদিন আর সব দিনের মতই কাজ করলেন দুজনে মিলে।খদ্দেরপেয়েছেন খারাপ না।রাতের বেলা ক্যাশ বাক্সের মধ্যে পেলেন বাড়তি কিছু টাকা।কীভাবে এল সেটা ভাবার কোনো দরকার মনে করলেন না তিনি।যেভাবে সব চলছে চলুক।জানেন,পরদিন সকালে মিষ্টি কম পাবেনকাঁচের আলমারীর ভেতর।
খুশি খুশি মনে দোকান বন্ধ করে বেরুলেন তিনি।এভাবে চলতে থাকলে নতুন একটা কর্মচারী রাখা যেতে পারে।ভাল মিষ্টি বানাতে পারে এমন লোক আছে তার হাতে।ঘোষ পাড়ার এক মেয়েকে মা খুব পছন্দ করে।অনেক দিন ধরে বলছে।নতুন করে কিছু ভাবা যেতে পারে মেয়েটাকে নিয়ে।
আকাশে চমৎকার একটা গোলগাল চাঁদ উঠেছে।জীবনের প্রথম গুণগুণ করে গান গেয়ে উঠলেন তিনি-‘ঘুম ঘুম চাঁদ,ঝিকিমিকি তারা,এই মাধবী রাত।আসেনি বুঝি আর…’

Exit mobile version